আরেকবার আদর্শ পেশা হয়ে উঠুক শিক্ষকতা
মো. রায়হান হোসাইন
প্রকাশ : ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
শিক্ষকতা শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে শেখার এবং শেখানোর প্রবল আগ্রহ। আছে প্রতিটি শিক্ষার্থীর ভেতরে লুকিয়ে থাকা প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর প্রত্যয়। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। নৈতিক ও মানবিক নাগরিক গড়ে তোলার স্বপ্নে বিভোর একশ্রেণির স্বপ্নবাজ মানুষ যাদের আমরা শিক্ষক হিসেবে চিনে থাকি। শিক্ষক যিনি অন্যর সন্তানের জন্য দোয়া করেন। অন্যের সন্তানের সাফল্যে খুশি হন, চোখের পানি ফেলেন তিনিই হলেন শিক্ষক। শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদণ্ড।
আর এই মেরুদণ্ড সোজা রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন একজন শিক্ষক। পৃথিবীব্যাপী শিক্ষকতা পেশা কিংবা প্রতিটি শিক্ষককে রাখা হয় সম্মানের সর্বোচ্চ স্থানে। ইসলামেও শিক্ষককে দেওয়া হয়েছে উচ্চমর্যাদা। শিক্ষককে উচ্চ মর্যাদাতে ভূষিত করেছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হযরত মুহাম্মদ (সা.) এরশাদ করেন. তোমরা জ্ঞান অর্জন করো এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব শিষ্টাচার শিখো। তাকে সম্মান করো, যার থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো (আল মুজামুল আউসাত : ৬১৮৪)। মানবজাতির সবচেয়ে বড় শিক্ষক বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজে শিক্ষক হিসেবে গর্ববোধ করতেন। তিনি তার অন্যতম দোয়ায় বলেছেন, হে আল্লাহ! আপনি শিক্ষকদের ক্ষমা করুন, তাদের দীর্ঘ হায়াত দান করুন।
এছাড়া খলিফা হারুনুর রশীদের সন্তান ও তার শিক্ষকের মর্যাদার ঘটনা কার না জানা? ফলে শিক্ষকের মর্যাদা যে অপরিসীম তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শিক্ষকতা পেশাকে বলা হয় আদর্শ বা মহান পেশা। অর্থাৎ তাত্ত্বিক এবং বাস্তবিক সকল পেশার মধ্যে শিক্ষকতা পেশাই সেরা। কেননা, একহন শিক্ষকই পারেন তার দক্ষতা, যোগ্যতা এবং অনুপ্রেরণার মাধ্যমে একটি প্রজন্মকে আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে। শিক্ষকরাই তৈরি করেন একেকজন দক্ষ প্রশাসক, নেতা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, রাজনৈতিক ব্যক্তি ইত্যাদি।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে বর্তমান বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশা বইয়ের পাতাই সেরা বা আদর্শ পেশা হিসেবে অবস্থান করছে। বাস্তবতা হলো বর্তমানে বাংলাদেশের প্রেক্ষপটে এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে যারা সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হওয়ার পরও পরবর্তীতে প্রশাসন বা পুলিশে চাকরি হলে সেখানে যোগদান করছেন। সবাই এখন মহান পেশা নয় বরং ক্ষমতার ব্যবহার বা অপব্যবহার করার সুুযোগ আছে, এমন পেশাতেই সকলে যেতে চান। বাস্তবিক অর্থে বাংলাদেশে বর্তমানে শিক্ষকতা পেশাকে ধরা হয় অন্য চাকরি না পেলে সবাই শিক্ষকতা পেশায় আসেন। আবার অনেকে মনে করেন, শিক্ষকতা পেশায় মূলত আসে কম মেধাবী শিক্ষার্থীরা। অর্থাৎ দেশের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পড়ালেখা করে কেউ আর শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান না। সত্যি বলতে বর্তমানে শিক্ষকদের অবস্থা লাজুক। মাত্র ২ যুগ আগেও এদেশের শিক্ষকদের সম্মান ছিল পিতামাতার পরেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি। কিন্তু মাত্র যুগের ব্যবধানে এদেশে শিক্ষকদের মান এবং গুণ দুইই কমেছে।
এর পেছনে অবশ্য বেশ কিছু কারণও রয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য শিক্ষক নিয়োগে প্রশ্নফাঁস, নিয়োগে অনিয়ম, স্বজনপ্রীতির মতো অসংখ্য খবর পত্রিকার পাতায় কিংবা টিভির পর্দায় হরহামেশাই দেখা যায়। আবার শিক্ষকদের নৈতিক স্খলন ঘটার খবরও কম নয়। শিক্ষার্থীদের সামনে সত্য না বলা কিংবা শিক্ষক হয়েও কোনো রাজনৈতিক দলের নির্লজ্জভাবে তোয়াচ করাও শিক্ষকদের মানক্ষুণ্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ। অন্যদিকে শিক্ষকদের একটা বড় অংশ ক্লাসে না পড়িয়ে প্রাইভেট কিংবা কোচিংয়ে ডাকার যে সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন এর ফলেও শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সম্মানের স্থানে রাখতে পারছেন না। এছাড়া শিক্ষকতা পেশার একটা মূলমন্ত্র হলো শিক্ষক মানেই সারাজীবনের ছাত্রত্ব গ্রহণ করা। যা আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি। শিক্ষককে যে আধুনিক জ্ঞানের সঙ্গে সবসময় সম্পৃক্ত থাকতে হয়, সেটাও আমাদের উপলব্ধির বাইরে। ফলে নতুন নতুন জ্ঞানের ক্ষেত্রে যে আগ্রহ অতীতের শিক্ষকদের মধ্যে দেখা যেত তা আর এখন দেখা যায় না বললেই চলে।
অন্যদিকে শিক্ষকদের দিক থেকে বরাবরই একটা বিষয়ে অভিযোগ এসেছে- তা হলো শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বা সম্মানী। সত্যি বলতে বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা পৃথিবীর অনেক উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে অনেক বেশি খারাপ অবস্থা। বিশেষ করে যারা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন, তাদের সম্মানী মোটেও সম্মানজনক বা সন্তোষজনক নয়।
ফলে এখন আর প্রকৃত অর্থে যারা শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান তারা আসতে পারছেন না। এতে করে দেশে তো সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়ছে; কিন্তু ছাত্র-শিক্ষকের যে সম্পর্ক সে সম্পর্কে ভাটা পড়েছে। এমতাবস্থায়, প্রশ্ন আসতেই পারে শিক্ষকতা কি আসলেই মহান পেশা?
তবে স্বস্থির বিষয় হলো- আবারও হয়তো শিক্ষকতা পেশা মহান হয়ে উঠবে। যার কিছু নমুনা আমরা ইদানীং দেখতে পাচ্ছি। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি আইন বিভাগে ফাইকা তাহজিবা নামে একজন প্রভাষক পদে যোগদান করেন। তিনি সহকারী জজ পরীক্ষায় ৭ম স্থান অধিকার করার পরও শিক্ষকতা পেশা বেঁছে নেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি ভাইরাল হলে তিনি মানুষের কাছে থেকে বেশ প্রশংসা পেয়েছেন। এছাড়া বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস স্ট্যাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রকিব উদ্দিন ভূইয়ার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যিনি ছোটবেলার লালিত স্বপ্ন বিসিএস ক্যাডার হওয়া হলেও ২৮তম বিসিএস পুশিল ক্যাডারে ১০ম স্থান অধিকার করলেও পরে তিনি শিক্ষকতা পেশা বেছে নেন। বর্তমান এমন অনেক রকিব-তাহজিবাদের মতো মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশা বেঁছে নিয়ে নতুন দিনের সূচনা করছেন।
সুতরাং বর্তমান বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশা আবারও হয়ে উঠুক মহান পেশা। যে পেশা পুনরায় তার অস্তিত্ব ফিরে পারে। শিক্ষক হবেন শিক্ষার্থীর পরম বন্ধুর এবং আস্থার জায়গা।
লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট প্রভাষক, সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজ, বরিশাল
