কেন বিদেশগামী শ্রমিকরা দালাল চক্রের প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে?

মো. নূর হামজা পিয়াস

প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের একটি বড় অংশ বিদেশে গিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন। পরিবারকে উন্নত করা, সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার প্রত্যাশা থেকেই তারা দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। গ্রামের সাধারণ মানুষ ভেবেচিন্তে এই পথে আসলেও তথ্যের অভাবে তারা প্রতারণার শিকার হন। দালালরা তাদের স্বপ্নকে মূলধন হিসেবে ব্যবহার করে এবং অতিরঞ্জিত সুযোগের আশ্বাস দিয়ে প্রলুব্ধ করে। এভাবে সঞ্চিত টাকার পাশাপাশি ধার-দেনা করে বিদেশে যাওয়ার উদ্যোগ নেন অনেকেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই স্বপ্ন চূর্ণ হয়ে যায়।

দালালচক্র সাধারণত বিদেশে ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে শ্রমজীবী মানুষকে ফাঁদে ফেলে। তারা মিথ্যা কাগজপত্র, জাল ভিসা, ভুয়া প্রশিক্ষণ সনদ এবং অপ্রমাণিত নিয়োগপত্র দেখিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। গ্রামের সাধারণ মানুষ এসব নথির সত্যতা যাচাই করতে পারেন না, ফলে সহজেই প্রতারণার শিকার হন। দালালরা একেকজন থেকে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় এবং অনেক সময় ভিসা না দিয়েই গা-ঢাকা দেয়। এই প্রক্রিয়ায় বহু পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। প্রতারণার কৌশল ক্রমেই বৈচিত্র্যময় হচ্ছে, যা জনসাধারণের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিদেশে যাওয়ার জন্য শ্রমজীবী মানুষরা যখন দালালদের কাছে টাকা দেন, তখন প্রায়শই তাদের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ থাকে না। এই সুযোগে গ্রামকেন্দ্রিক কিছু মহাজন চড়া সুদে টাকা ধার দেয়। দালালদের প্রতারণায় টাকা খোয়া গেলে এই মহাজনদের চাপ ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে আরও কঠিন সংকটে ফেলে। অনেক সময় পরিবারগুলো ঘরবাড়ি, জমিজমা বিক্রি করে মহাজনের ঋণ শোধ করতে বাধ্য হয়। দালাল চক্রের সঙ্গে এই মহাজন চক্রেরও যোগসাজশ থাকতে পারে, যারা জানে যে বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন ব্যর্থ হলে পরিবারগুলো দ্রুত ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য হবে। এই দ্বিমুখী শোষণ দরিদ্রদের জীবনকে স্থায়ীভাবে পঙ্গু করে দেয়।

একজন শ্রমজীবী মানুষ বিদেশে যেতে চাইলে প্রায়শই নিজের দীর্ঘদিনের সঞ্চয় দালালদের হাতে তুলে দেন। শুধু তাই নয়, অনেকে জমি বিক্রি করেন, ঋণ নেন বা সুদে টাকা ধার করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিদেশে কাজ না পেয়ে বা ভুয়া ভিসার কারণে দেশে ফিরতে না পেরে তাদের সর্বস্ব হারাতে হয়। একটি পরিবারের আর্থিক মেরুদণ্ড ভেঙে যায় এবং তারা চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি হন। অনেক সময় দালালদের বিরুদ্ধে মামলা করা হলেও দীর্ঘসূত্রতা ও প্রভাবশালী চক্রের কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা ন্যায়বিচার পান না।

দালাল চক্র এখন সরাসরি কাজ না করে অনেক সময় ভুয়া বা নামসর্বস্ব রিক্রুটিং এজেন্সির আড়ালে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। এই এজেন্সিগুলো খুব দ্রুত অফিস পরিবর্তন করে বা সামান্য জরিমানা দিয়ে আবার নতুন নামে ব্যবসা শুরু করে। তাদের ওয়েবসাইটে মিথ্যা সাফল্যের গল্প ও চাকরির বিজ্ঞাপন দিয়ে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করা হয়। সরকারি নিবন্ধিত এজেন্সির মাধ্যমে যাওয়ার কথা বললেও, তারা আসলে নিজেদের দালালদের মাধ্যমে অবৈধভাবে ভিসা বিক্রি করে। এই ভুয়া এজেন্সিগুলোর দ্রুত শনাক্তকরণ এবং স্থায়ীভাবে তাদের লাইসেন্স বাতিল করা জরুরি, যাতে দালাল চক্র আইনি কাঠামোর সুযোগ নিতে না পারে।

যারা দালালদের মাধ্যমে বিদেশে যেতে সক্ষম হন তারাও অনেক সময় প্রতারণার শিকার হন। প্রতিশ্রুত চাকরির বদলে তারা অমানবিক শ্রম, স্বল্প মজুরি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হন। কিছু ক্ষেত্রে পাসপোর্ট জব্দ করে তাদের অবৈধভাবে আটক রাখা হয়। ফলে বিদেশে গিয়ে তারা প্রবাস জীবনের আনন্দের বদলে দুঃস্বপ্নের মধ্যে পড়েন। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স আশার চেয়ে কম হয় এবং পরিবারের আর্থিক সমস্যা থেকেই যায়। বিদেশের কষ্ট ও অপমানজনক অবস্থার কারণে অনেক সময় তারা দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের দেওয়া সর্বশেষ তথ্য ও অভিযোগের ভিত্তিতে একটি চিত্র পাওয়া যায়। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এবং বিএমইটি’র (BMET) অভিযোগ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রতি বছর গড়ে কমপক্ষে ৫০,০০০ থেকে ৭০,০০০ শ্রমজীবী মানুষ দালাল বা ভুয়া এজেন্সির মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হন।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ অভিবাসন ব্যয়ের দিক দিয়ে অন্যতম, যা প্রতারণার ঝুঁকি বাড়ায়। ভারতে যেখানে প্রতারণার হার কম, সেখানে পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের শ্রমিকের সংখ্যা বেশি হওয়ায় অভিযোগের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। আমাদের দেশে বৈধভাবে যাওয়া শ্রমিকের তুলনায় প্রতারণার শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি উদ্বেগের। এই উচ্চ হারই প্রমাণ করে যে দালাল চক্রের শোষণ কতটা গভীর।

দালালদের প্রতারণার ফলে শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবারের খরচ চালাতে গিয়ে অনেকে ধার-দেনা করে ফেলেন। সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়, মেয়েদের বিয়ে আটকে যায় এবং জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতেও সমস্যায় পড়ে। সমাজে সম্মান হারিয়ে পরিবারগুলো মানসিক কষ্টে ভোগে। অনেক পরিবার দীর্ঘদিন ধরে ঋণের বোঝা টানতে টানতে দারিদ্র্যের ফাঁদ থেকে বের হতে পারে না। এভাবে একটি পরিবারের সঞ্চয়ের পাশাপাশি ভবিষ্যতও ধ্বংস হয়ে যায়।

বাংলাদেশে মানবপাচার প্রতিরোধ আইন থাকলেও এর সঠিক প্রয়োগ না হওয়ায় দালাল চক্র দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে। প্রভাবশালী দালালরা মামলা হলেও অনেক সময় সহজে ছাড়া পেয়ে যায়। গ্রাম ও শহরের মধ্যম পর্যায়ের দালালরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে নতুন শিকার খুঁজে বের করে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে সাধারণ মানুষ দালালদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে ভয় পান। আইনের দুর্বলতা এবং ধীরগতির বিচার প্রক্রিয়া দালালদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করছে। দালাল চক্রের প্রতারণা রোধে বাংলাদেশে প্রধানত ‘মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২’ এবং ‘অভিবাসন আইন ২০১৩’ চালু আছে। অবৈধভাবে শ্রমিক পাঠানো বা প্রতারণা প্রমাণিত হলে আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, যার মধ্যে বড় অঙ্কের অর্থদণ্ড ও দীর্ঘ মেয়াদী কারাদণ্ড অন্তর্ভুক্ত। তবে অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মামলার নিষ্পত্তি অত্যন্ত ধীরগতিতে হয়, যা ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বাধা সৃষ্টি করে। মালয়েশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের মতো গন্তব্য দেশেও শ্রম আইন কঠোর, কিন্তু বাংলাদেশে আইনের প্রয়োগে দীর্ঘসূত্রতা এবং দুর্বল তদারকির কারণে প্রতারকরা সহজেই পার পেয়ে যায়। আইন থাকা সত্ত্বেও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের অভাব এবং উচ্চ আপোষের প্রবণতা এখানে প্রধান সমস্যা।

সরকারি পর্যায়ে বিদেশে বৈধভাবে শ্রমিক পাঠানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সঠিক তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছায় না। ফলে মানুষ দালালদের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং বিএমইটির (বিউরো অব ম্যানপাওয়ার এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং) কার্যক্রম থাকলেও তাতে স্বচ্ছতা ও তদারকির ঘাটতি রয়েছে। দালালচক্র এই সীমাবদ্ধতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকাংশেই রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল। প্রতি বছর প্রায় দুই কোটি মানুষ বিদেশে গিয়ে কাজ করে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। কিন্তু দালাল চক্রের প্রতারণার কারণে এই রেমিট্যান্সের সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যারা প্রতারণার শিকার হয়ে বিদেশে যেতে ব্যর্থ হন, তারা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারেন না। বরং তাদের পরিবার ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়। ফলে জাতীয় অর্থনীতিতেও একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

মানবপাচার একটি বৈশ্বিক সমস্যা। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই দালাল চক্র সক্রিয় রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও ইউরোপে অবৈধভাবে শ্রমিক পাঠানোর জন্য বাংলাদেশকে একটি ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আন্তর্জাতিক চাহিদা ও অভিবাসন নীতির জটিলতার কারণে মানুষ দালালদের কাছে বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিদেশে আটক শ্রমিকদের মুক্ত করতে হলে সরকারকে অনেক কূটনৈতিক চাপ সামলাতে হয়। যারা দালালদের প্রতারণার শিকার হন তারা শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। পরিবারের সঞ্চয় হারানোর অপরাধবোধ, সমাজে অপমানিত হওয়ার ভয় এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা তাদের গভীর মানসিক কষ্টে ফেলে। অনেক সময় তারা হতাশায় আত্মহত্যার পথও বেছে নেন। বিশেষ করে গ্রামের মানুষরা সমাজে সম্মান হারানোর ভয়েই সবচেয়ে বেশি মানসিকভাবে ভোগেন। এই ট্রমা থেকে মুক্তি পেতে দীর্ঘ সময় লাগে এবং এর প্রভাব পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়ে।

দালালদের প্রতারণার শিকার হয়ে বা বিদেশে খারাপ কর্মপরিবেশের কারণে যারা দেশে ফিরে আসেন, তাদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। এই প্রত্যাবর্তনকারী শ্রমিকরা শুধু আর্থিক ক্ষতি নিয়ে ফেরেন না, বরং তারা মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত থাকেন। তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা থাকা দরকার। এই পুনর্বাসন প্রক্রিয়া কার্যকর হলে তারা নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবেন এবং হতাশা ও দারিদ্র্যের চক্র থেকে মুক্তি পাবেন। এটি সমাজে তাদের পুনঃএকত্রীকরণেও সহায়তা করবে।

দালাল চক্রের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। টেলিভিশন, সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদেশে বৈধভাবে যাওয়ার পথ সম্পর্কে প্রচার করা জরুরি। বিভিন্ন ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা প্রকাশ করলে মানুষ সতর্ক হতে পারে। গ্রাম পর্যায়ে সচেতনতামূলক সেমিনার, কর্মশালা এবং সরকারি প্রচারণা কার্যক্রম চালানো উচিত। সচেতনতা ছাড়া দালালদের ফাঁদ থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।

দালাল চক্রকে রুখতে হলে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেকটি বিদেশগামী শ্রমিককে সরকারি নিবন্ধিত এজেন্সির মাধ্যমে পাঠানো নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামীণ মানুষকে সহজে তথ্য পেতে হলে ইউনিয়ন পর্যায়ে তথ্যকেন্দ্র গড়ে তোলা প্রয়োজন। পাশাপাশি দালালদের বিরুদ্ধে দ্রুতবিচার কার্যকর করতে হবে। সমাজের সব স্তরের মানুষকে সচেতন করতে পারলে শ্রমজীবী মানুষের সঞ্চয় লুট হওয়া অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ