প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৮ অক্টোবর, ২০২৫
দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি কিংবা নারী ও শিশু নির্যাতনের খবর। মানুষ আজ নিরাপত্তাহীনতার এক অন্ধকারে দিন কাটাচ্ছে। সরকার ও প্রশাসন চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না বললেও বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। অপরাধ যেন দিন দিন আরও ভয়ংকর, আরও বিস্তৃত হয়ে পড়ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানও অপরাধ বাড়ার সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সংস্থার তথ্য মতে, চলতি বছর (জানুয়ারি-আগস্ট) এই আট মাসে সারা দেশে সবচেয়ে বেশি হত্যা, দস্যুতার ঘটনায় ৪ হাজার ৩১৬টি মামলা হয়েছে। সে হিসাবে গড়ে প্রতি মাসে ৫৪০টি মামলা হয়েছে। মোট মামলার মধ্যে ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা ১ হাজার ৭০২টি এবং ২ হাজার ৬১৪টি খুনের মামলা। এর আগের বছর ২০২৪ সালে ১২ মাসে ডাকাতি-দস্যুতা ও হত্যার ঘটনায় মোট পাঁচ হাজার ৩৩৪টি মামলা হয়েছে। সে বছর প্রতি মাসে গড়ে মামলা হয়েছে ৪৪৫টি। এর মধ্যে ডাকাতি-দস্যুতায় এক হাজার ৯০২টি ও খুনের মামলা ৩ হাজার ৪৩২টি। এই তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর প্রতি মাসে গড়ে ডাকাতি-দস্যুতা ও খুনের ঘটনায় ৯৫টি বেশি মামলা হয়েছে। এর আগের বছর ২০২৩ সালের সঙ্গে তুলনা করলে চলতি বছরের প্রতি মাসে গড়ে ১৬০টি মামলা বেড়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন পুলিশ পরিসংখ্যানে কখনও এসব ঘটনার প্রকৃত তথ্য উঠে আসে না, বাস্তবে এসব অপরাধ আরো বেশি ঘটছে বলে মনে করছেন তারা। রএর আগের বছরে (২০২৩ সালের আগস্ট থেকে গত বছরের জুলাই পর্যন্ত) সারা দেশে ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা হয়েছে এক হাজার ৬১৯টি। এই সময় মাসে গড়ে মামলা হয়েছে ১৩৫টি। পুলিশ সদর দপ্তরের এই হিসাবে আগের বছরের চেয়ে পরের বছরে ৮৩৮টি মামলা বেশি হয়েছে। এ সময় মাসে ৭০টি মামলা বেশি হয়েছে। আবার পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধবিষয়ক মাসিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ১৩ মাসে সারা দেশে সাত ধরনের অপরাধমূলক ঘটনায় ৩৯ হাজার ৯৩৬টি মামলা হয়েছে। এই হিসাবে প্রতি মাসে মামলা তিন হাজার ৭২টি। প্রতিদিন মামলা ১০২টি।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশজুড়ে আশার সঞ্চার হয়েছিল যে, হয়তো এবার পরিস্থিতি বদলাবে। মানুষ নিরাপত্তা পাবে, চাঁদাবাজরা ধরা পড়বে, অপরাধীরা শাস্তি পাবে। কিন্তু সেই আশাগুলো এখন ভেঙে গেছে। অপরাধ আরও বেড়েছে, চাঁদাবাজি আরও বেপরোয়া হয়েছে, মানুষের ভয় আরও গভীর হয়েছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা, পুলিশের মনোবলে ঘাটতি এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, দেশের বর্তমান অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে মূলত তিনটি বড় কারণ কাজ করছে- বেকারত্ব, মাদকাসক্তি ও সামাজিক বৈষম্য। যখন একজন যুবক শিক্ষিত হয়েও কাজের সুযোগ পায় না, তখন সে সহজেই অপরাধের পথে ঝুঁকে পড়ে। অন্যদিকে মাদক আজ শুধু তরুণ সমাজ নয়, পুলিশ, রাজনীতি, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। আর সামাজিক বৈষম্য এমনভাবে বেড়েছে যে, ধনী ও গরিবের মধ্যে দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে। এই বৈষম্যই অপরাধের অন্যতম প্ররোচক হিসেবে কাজ করছে।
এদিকে চাঁদাবাজির ভয়াবহতা এখন নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। দেশের ৬৪ জেলায় প্রকাশ্যে ও নীরবে চলছে চাঁদাবাজি। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাজার, বন্দর, পরিবহন খাত- সবখানেই চাঁদার দাপট। একটি ট্রাক নওগাঁ থেকে ঢাকায় আসার পথে একাধিক পয়েন্টে চাঁদা দিতে হয়। ব্যবসায়ী, দোকানদার, এমনকি সাধারণ পথচারী পর্যন্ত চাঁদাবাজদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। অনেকেই ভয়ে মুখ খুলতে পারছেন না। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে হয়রানি করা হচ্ছে, মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে, এমনকি খুন করা হচ্ছে। সম্প্রতি পুলিশ চাঁদাবাজদের হামলায় গুরুতর আহত হন। এই হামলাকারীরা লাঠি, রড ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। ঘটনাটি প্রমাণ করে, অপরাধীরা এখন এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, তারা আইনরক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রতিও কোনো সম্মান দেখাচ্ছে না। পুলিশের ওপর হামলা মানে রাষ্ট্রের ওপর হামলা, অথচ এই বার্তা যেন এখন কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না।
এদিকে রাজধানী ঢাকাতেও নতুন ধরনের চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে সংগঠিত মব চক্র বিভিন্ন জায়গায় ভয়ভীতি সৃষ্টি করে চাঁদা আদায় করছে। সম্প্রতি যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়া আসাদুর রহমান আকাশ নামের এক ব্যক্তি এই চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তিনি ও তার সহযোগীরা শুধু চাঁদা আদায়ই করছিলেন না, বরং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে নিজেদের রাজনৈতিক বা ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচয় দিচ্ছিলেন। মিথ্যা মামলা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, এমনকি সাংবাদিকদের ওপর হামলা- সবকিছুই ছিল তাদের কর্মকাণ্ডের অংশ। অপরাধ বৃদ্ধির আরও একটি কারণ হচ্ছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। দেশে অপরাধীরা ধরা পড়লেও তাদের অনেকেই রাজনৈতিক প্রভাব, ঘুষ বা দুর্বল তদন্তের কারণে আবার মুক্তি পেয়ে যায়।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কলামিস্ট, রংপুর