মা ইলিশ রক্ষায় জেলেদের অভিজ্ঞতা আমলে নিতে হবে
মো. শামীম মিয়া
প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ শুধু একটি প্রজাতি নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পান্তা-ইলিশ এখন যেমন পহেলা বৈশাখের ঐতিহ্য, তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও ইলিশের অবদান বিশাল। বাংলাদেশের মোট মাছ উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ আসে ইলিশ থেকে এবং লাখো মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে এই মাছের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই রুপালি ইলিশ এখন নানা ঝুঁকির মুখে। অতিরিক্ত আহরণ, জলবায়ু পরিবর্তন, নদীর দূষণ ও প্রজননস্থল ধ্বংসের কারণে ইলিশের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে সরকার প্রতিবছর মা ইলিশ রক্ষার জন্য ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ৪ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত এই সময়ের মধ্যে ইলিশ ধরা, বিক্রি, পরিবহন ও মজুত- সবকিছুই সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। উদ্দেশ্য একটাই- মা ইলিশকে নিরাপদে ডিম ছাড়ার সুযোগ দেওয়া, যাতে পরবর্তী মৌসুমে উৎপাদন বাড়ে।
তবে বাস্তবতার চিত্রটি এর চেয়ে অনেক জটিল। উপকূলীয় এলাকার অভিজ্ঞ জেলেদের অভিযোগ, নিষেধাজ্ঞার সময় নির্ধারণে তাদের মতামত বা বাস্তব অভিজ্ঞতা কোনোভাবে আমলে নেওয়া হয় না। ফলে প্রজননকাল সঠিকভাবে চিহ্নিত না হওয়ায় নিষেধাজ্ঞার মূল উদ্দেশ্য অনেক সময় ব্যর্থ হয়ে যায়। তাদের দাবি, এখন যে সময় সরকার নিষেধ ঘোষণা করেছে, তখন ইলিশের পেটে পুরোপুরি ডিম তৈরি হয় না। বরং নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পরই ডিম পরিপক্ক হয়ে যায় এবং তখনই নদীতে নামলে মা ইলিশ ধরা পড়ে জালে। এতে করে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলেও মা ইলিশ বাঁচে না, বরং আরও ক্ষতি হয়।
অন্যদিকে, মৎস্য গবেষক ও সরকারি কর্মকর্তারা বলেন, নিষেধাজ্ঞার সময় নির্ধারণ করা হয় বহু বছরের গবেষণালব্ধ তথ্য ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে। তাদের মতে, ইলিশের পেটে ডিম তৈরি হওয়ার পর তা পরিপক্ব হতে প্রায় ১৮ থেকে ২২ দিন সময় লাগে। আর এই সময়েই নিষেধাজ্ঞা জারি রাখলে সর্বাধিক সুফল পাওয়া যায়। অর্থাৎ, সরকার ও গবেষকদের দৃষ্টিতে সময় নির্ধারণ সঠিক।
কিন্তু এখানে তৈরি হয়েছে এক মৌলিক দ্বন্দ্ব। গবেষক ও নীতিনির্ধারকরা যে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তা কাগজ-কলমে নিখুঁত হলেও, নদীর বুকে প্রতিদিন জীবন কাটানো জেলেদের অভিজ্ঞতা বলছে ভিন্ন কথা। বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও শরীয়তপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের নদীপাড়ের জেলেরা বলছেন, প্রকৃতির চরিত্র এখন বদলে গেছে। আগে সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় ছিল মা ইলিশের প্রজনন মৌসুম। কিন্তু এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেই সময় পিছিয়ে গেছে। অক্টোবরের শেষ বা নভেম্বরের শুরুতে ইলিশ ডিম ছাড়ছে- এমন প্রমাণ তারা নিজের চোখে দেখছেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শুধু ইলিশের জীবনচক্রে নয়, নদীর ওপরেও পড়েছে ভয়াবহভাবে। নদীর তাপমাত্রা বেড়ে গেছে, লবণাক্ততার মাত্রা পাল্টে গেছে, স্রোতের দিক বদলে গেছে, এমনকি বৃষ্টিপাতের ধরনও অস্বাভাবিকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ায় এখন অনেক জায়গায় পানির গভীরতা কমে গেছে, পলি জমে নৌপথ সরু হয়ে পড়েছে। আগে যেখানে নদীর অগভীর অংশে মা ইলিশ ডিম ছাড়ত, এখন সে জায়গা হারিয়ে গেছে। ফলে তারা তুলনামূলক গভীর ও ঠান্ডা পানিতে চলে যাচ্ছে, যা প্রজননের সময়ও পিছিয়ে দিচ্ছে।
ইলিশ হলো অ্যানাড্রোমাস প্রজাতির মাছ, অর্থাৎ এটি সমুদ্রে বাস করলেও প্রজননের সময় নদীতে উঠে আসে। প্রজননের জন্য প্রয়োজন মিঠা পানি, নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও প্রবাহমান স্রোত। কিন্তু সাগরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ও নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ায় ইলিশের এই অভ্যাসে এসেছে পরিবর্তন। আগে চাঁদপুর, ভোলা ও পটুয়াখালীর নদীগুলো ছিল মূল প্রজননক্ষেত্র, এখন দেখা যাচ্ছে অনেক ইলিশ আর নদীতে ঢুকছেই না, সাগরসংলগ্ন মোহনাতেই ডিম ছাড়ছে। অর্থাৎ তাদের আচরণগত পরিবর্তন ঘটেছে, যা পুরোনো গবেষণার পরিসংখ্যান দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এমন অবস্থায় সরকারের নির্ধারিত ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা যদি প্রকৃত প্রজনন সময়ের সঙ্গে না মেলে, তাহলে এর সুফলও পাওয়া যাবে না। বরং বিপরীতে, মা ইলিশ রক্ষার নামে জেলেরা কষ্ট পাবেন, কিন্তু মাছ বাঁচবে না। তাই এখন সময় এসেছে সরকার, গবেষক ও জেলেদের অভিজ্ঞতাকে একত্রে বিবেচনা করার।
জেলেদের অভিজ্ঞতা কোনো তাত্ত্বিক জ্ঞান নয়; এটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নদীর বুকে জন্ম নেওয়া বাস্তব জ্ঞান। তারা জানেন কখন নদীর স্রোত বাড়ে, কখন পানির তাপমাত্রা কমে, কখন বাতাসের দিক পাল্টায়- এবং এর প্রতিটি পরিবর্তনের সঙ্গে ইলিশের আচরণের সম্পর্ক কী। এক জেলে হয়তো কোনো গবেষক নয়; কিন্তু প্রতিদিন নদীর বুকে লড়াই করে টিকে থাকার অভিজ্ঞতা তাকে প্রকৃতির এক বিশেষ পাঠক বানিয়েছে। এই বাস্তব জ্ঞানকে অগ্রাহ্য করা মানে প্রকৃতিকে অস্বীকার করা।
ভোলার এক প্রবীণ জেলে বলেছিলেন, ‘আমরা নদীর পানি দেখে বুঝে যাই ইলিশ আসবে কি না। নদীর ঘোলা ভাব, স্রোতের গতি, বাতাসের দিক- সবই বলে দেয়। এখন সরকার যেই সময়ে মাছ ধরা বন্ধ করে, তখন নদীতে ইলিশের পেটে ডিমই থাকে না। পরে যখন নিষেধ উঠে যায়, তখনই ডিম ছাড়ার সময় হয়। তখন আমরা জাল ফেললে মা ইলিশ ধরা পড়ে।’
এই কথার মধ্যে লুকিয়ে আছে বাস্তবতার কঠিন সত্য। প্রকৃতি স্থির নয়, তাই কোনো নীতিও স্থির হতে পারে না। বৈজ্ঞানিক গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু সেই গবেষণার সময়সীমা ও প্রেক্ষাপটকে নিয়মিত আপডেট করতে হয়। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে ইলিশের প্রজননকাল যদি পরিবর্তিত হয়, তাহলে পুরোনো সময়সূচির ওপর নির্ভর করা অবাস্তব।
এখন প্রশ্ন হলো- এই নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় জেলেদের অভিজ্ঞতাকে কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়? বিশ্বের অনেক দেশেই এরইমধ্যে ‘কমিউনিটি বেসড ফিশারি ম্যানেজমেন্ট’ বা জনগণনির্ভর মৎস্যব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু হয়েছে। এই পদ্ধতিতে স্থানীয় জেলেদের সরাসরি অংশগ্রহণ থাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে। তারা মাঠপর্যায়ে যা পর্যবেক্ষণ করেন, সেটি গবেষকদের হাতে যায়, আর গবেষকরা তা বিশ্লেষণ করে নীতিনির্ধারকদের সামনে উপস্থাপন করেন। ফলে নীতিটি হয় বাস্তবভিত্তিক, মানবিক ও বৈজ্ঞানিক। বাংলাদেশেও এই পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে।
ইলিশ সংরক্ষণের সময় শুধু প্রজননকেই নয়, জেলেদের মানবিক বাস্তবতাকেও বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ তারা নদীতে না নামলে তাদের পরিবার উপার্জনহীন হয়ে পড়ে। সরকার যদিও প্রতি বছর খাদ্য ও অর্থ সহায়তা দেয়, বাস্তবে তা সব জেলে পান না। অনেক সময় সহায়তা পৌঁছাতে দেরি হয়, কোথাও আবার অনিয়ম হয়। ফলে অনেকে বাধ্য হয়ে আইন ভাঙেন। রাতের অন্ধকারে তারা মাছ ধরতে যান, ধরা পড়লে জাল, নৌকা ও মাছ জব্দ হয়, মামলা হয়, জেল খাটতে হয়। এতে শুধু একজন জেলের নয়, পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়ে।
যদি সরকারের উদ্দেশ্য সত্যিই মা ইলিশ রক্ষা হয়, তবে সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য জেলেদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের সঙ্গে শত্রুতা নয়, সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তাদের অভিজ্ঞতাকে মূল্য দিতে হবে। নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার আগে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। যদি দেখা যায়, ইলিশের প্রজনন মৌসুম পরিবর্তিত হয়েছে, তাহলে সেই অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞার সময়ও সমন্বয় করতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ফুলছড়ি সরকারি কলেজ ও কলামিস্ট, আমদিরপাড়া, জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধা
