উচ্চশিক্ষার হাইব্রিড পথ : নারী ও সমাজের সংকট চক্র

মারিয়া হক শৈলী

প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষাই জাতির অগ্রযাত্রার মূলভিত্তি। এটি শুধু জ্ঞানভাণ্ডার নয়; মানুষের দেহ, মন ও আত্মার পূর্ণ বিকাশের পথপ্রদর্শক। আর এই বিকাশের সর্বোচ্চ কেন্দ্র হলো- বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় শুধু উচ্চশিক্ষা গ্রহনের প্রতিষ্ঠান নয়, এটি গবেষণা, অনুসন্ধান ও সৃজনশীলতার এক অনন্য ভূমি। কিন্তু একটি দেশের অবকাঠামো ও প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম কর্মসংস্থানের সুযোগের সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে অযাচিত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন; দেশের সামগ্রিক ইতিবাচক সম্ভাবনাকে অনিশ্চয়তায় ঠেলে দেওয়ার পাশাপাশি সম্ভাব্য উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার স্বাভাবিক অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করে। ফলস্বরূপ, মানহীনতার চূড়ান্ত পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা শুধু নামমাত্র ডিগ্রি ও সার্টিফিকেটের মোহে ঝুঁকে পড়ে, সংকীর্ণ পথে পারি দিতে চায় উচ্চশিক্ষার গন্তব্য।

বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় দৃষ্টি নিবন্ধ করলে এ দুর্ব্যবস্থারই পুনরাবৃত্তি স্পষ্ট প্রতীয়মান। শিক্ষার মানোন্নয়নের দিকে যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও অনুমোদনের ফলে এই ছোট্ট দেশে অসংখ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭টিতে। তাছাড়া, গত বছরের জুলাই আন্দোলনের পর ছাত্রসমাজকে যুক্তি ও বিনয়ের পথে ফেরানের বদলে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের একের পর এক অযৌক্তিক দাবি মেনে নিচ্ছে। ফলে, মূল্যহীন হয়ে পড়েছে অভিজ্ঞদের জ্ঞান ও সুশিক্ষা এবং আরো একবার প্রকট হয়ে উঠছে রাষ্ট্রের ভঙ্গুর শিক্ষা কাঠামোর বাস্তবতা।

এই ধারাবাহিক প্রবণতারই একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী সাতটি কলেজকে( ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা কলেজ, সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ এবং কবি নজরুল সরকারি কলেজ) এক করে একটি হাইব্রিড বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন। কলেজগুলোর শিক্ষক ও সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীদের মতামত না নিয়ে সাতটি কলেজের গুটিকয়েক স্বঘোষিত শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের সাথে একতরফা আলোচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অত্যন্ত তরিঘরি করে যে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ বা খসড়া প্রকাশ করেছে, সেটি কতটুকু যুক্তিসংগত তা সত্যিই ভাববার বিষয়।

২০১৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি এক সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী এই সাতটি কলেজকে শিক্ষার মানন্নোয়নের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। শুরুতে শিক্ষার্থীরা এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানালেও, কিছুদিন না যেতেই তাদের মুখোমুখি হতে হয় নানান সংকটের। পর্যাপ্ত একাডেমিক ভবন না থাকা, সেশনজট, ক্লাসরুম সংকট, পর্যাপ্ত আবাসন সংকট, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, সম্ভাব্য তারিখ অনুযায়ী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়া, শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষক স্বল্পতা, লাইব্রেরির মানহীনতা, শিক্ষার্থীদের খাতা ম্ল্যূায়নে ঢাবির গুরুত্বহীনতা, পাশাপাশি সমাবর্তনে বৈষম্য- এসব নানান অসুবিধার কথা ঢাবি প্রশাসনকে অভিযোগ কিংবা আলোচনা আকারে জানানো হলেও আসেনি কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন কিংবা কোনো সুদূরপ্রসারী সমাধান।

ফলস্বরূপ, ২০১৯ ও ২০২৪ সালের ব্যর্থ আন্দোলনের পর আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের উদ্যোগ। দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক ও একাডেমিক সংকটের গিঁট খুলে বাস্তবসম্মত সমাধান খোঁজার পরিবর্তে, বিষয়টি যেন নতুন নামে পুরোনো বিতর্কেরই পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে। আন্দোলনের চাপ ও তৎকালীন উত্তাপের ভেতর দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) হঠাৎই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়-২০২৫’ শীর্ষক এক প্রাথমিক খসড়া- যা বিতর্কের আগুনে নতুন কাঠ যোগ করেছে মাত্র।

প্রকাশিত খসড়াটিতে ফুটে উঠেছে নানা অসংগতি ও অস্পষ্টতা। যেসব কলেজে এখনও উচ্চমাধ্যমিক স্তর বিদ্যমান, সেখানে স্নাতক ও কলেজ শিক্ষার্থীদের সহাবস্থান ভবিষ্যতে মনস্তাত্ত্বিক চাপ ও পারস্পরিক দ্বন্দ্বের কারণ হতে পারে- এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পাশাপাশি শিক্ষক সংকট, অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও প্রশাসনিক বিভাজনের মতো দীর্ঘদিনের সমস্যা, যেগুলোর কোনোটিরই বাস্তবসম্মত সমাধান এই খসড়ায় স্পষ্ট নয়।

আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, ২০২৪ সালের নভেম্বরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল- ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ রেখে সংস্কারের মাধ্যমে সংকট সমাধানের- সেই প্রতিশ্রুতির কোনো প্রতিফলন এই খসড়ায় নেই। বরং ঐতিহ্য রক্ষার আন্দোলন এখন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে গুটিকয়েক শিক্ষার্থীর হাতে, আর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও সার্বজনীন মতামত উপেক্ষা করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তাড়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

এই তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তের পেছনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে- কার স্বার্থে এমন উদ্যোগ? অনেকের ধারণা, ঐতিহ্যবাহী সরকারি কলেজগুলোর অবস্থানকে ক্রমে দুর্বল করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে লাভজনক অবস্থানে রাখার এক নীরব প্রচেষ্টা চলছে। শিক্ষাক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের অসম প্রতিযোগিতা, যেখানে সরকারি কলেজগুলো ধীরে ধীরে প্রান্তিক হয়ে পড়ছে, সেই বাস্তবতায় এই ধারণা পুরোপুরি অমূলক নয়।

এর মধ্যেই প্রকাশিত খসড়ার বিষয়ে মতামত দেওয়ার জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের সময় দেয়া হয়েছে মাত্র সাত কর্মদিবস। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণে এত সীমিত সময় জনমতকে উপেক্ষারই ইঙ্গিত দেয়। জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক- সে সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত জনগণের নয়, প্রশাসনের হয়ে যায়।

শিক্ষার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত জ্ঞানচর্চার অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা, প্রশাসনিক ভারসাম্য রক্ষা করা এবং শিক্ষার্থীদের চিন্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। কিন্তু ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়-২০২৫’ এই খসড়ায় সেই চেতনার কোনো প্রতিফলন নেই। মনে হচ্ছে, রাষ্ট্র সমস্যা সমাধানের বদলে নাম বদলের ভেতর দিয়েই দায় এড়ানোর সহজ পথ বেছে নিয়েছে।

যখন সংস্কারের সুযোগ ছিল, তখন রূপান্তরের এই তাড়াহুড়ো আসলে শিক্ষা নিয়ে আমাদের অস্থির মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। ইতিহাস সাক্ষী- তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত কখনও সমাধান আনে না, বরং সংকটকেই আরও দীর্ঘায়িত করে। নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে, কলেজগুলোর স্বতন্ত্র ঐতিহ্য ও কাঠামোবিলীন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের কোনো যৌক্তিকতা নেই। বরং লক্ষ্য হওয়া উচিত- যে সকল শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পিছিয়ে যায়, তারা যেন উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়। সেই উদ্দেশ্যে কলেজগুলোতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য শিক্ষা প্রদান করা বেশি কার্যকর ও যুক্তিসঙ্গত।

পৃথিবীর অনেক দেশে এমন কলেজ রয়েছে, যা মূলত বিশ্ববিদ্যালয় নয়; কিন্তু শিক্ষার মান ও সেবা বিশ্বমানের। সাতটি কলেজকেও পরিকল্পিত ও সুসংহতভাবে একই ধরনের শিক্ষাকাঠামোর আওতায় আনা সম্ভব। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উন্নত প্রশিক্ষণ, গবেষণা, জীবনমুখী শিক্ষা ও ভবিষ্যত কর্মসংস্থানের সুযোগ দেওয়া হলে, ব্যাঙের ছাতার মতো আরেকটি মানহীন বিশ্ববিদ্যালয়ের বোঝা থেকে রাজধানীর রক্ষা পাবে।

তাছাড়া, সাতটি কলেজে রয়েছে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের ১৪০০ আসন। যেখানে দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তরুণদের স্নাতক শেষে চাকরির নিশ্চয়তা দিতে পারে না, সেখানে এই কলেজগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা মানে শিক্ষা ক্যাডারের এতগুলো আসন বেদখল করা এবং ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত করা- যা একদমই যৌক্তিক নয়।

এছাড়া, সাতটি কলেজের মধ্যে দুটি কলেজ বিশেষভাবে নারীর উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত। রক্ষনশীল পরিবার বা সহশিক্ষায় অনাগ্রহী নারীরা নিরাপদ শিক্ষার আশায় ইডেন মহিলা কলেজ ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি হন। এছাড়া, অনেক নারী এই কলেজগুলোর ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং দেশের সংগ্রামী নারী নেতৃত্বের গৌরবময় অধ্যায়ের অংশ হতে এখানে উচ্চশিক্ষা নিতে আগ্রহী।

যদি এই বিশেষ প্রতিষ্ঠানগুলোতে সহশিক্ষা চালু হয়, তবে নারীর উচ্চশিক্ষার সুযোগ সংকুচিত হওয়ার পাশাপাশি দেশের সংগ্রামী নারীদের ঐতিহাসিক গৌরবও ধীরে ধীরে মুছে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায়, এই দুটি কলেজ বিলিন হয়ে যাওয়া মানে দেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নিজ হাতেই বিলীন করে দেয়া।

মুলত, জুলাই গণআন্দোলনের পর রাষ্ট্র যে সঠিক পথে এগোচ্ছে না, তা স্পষ্ট। আইন ও যৌক্তিকতার চেয়ে মবকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং অভিজ্ঞতার চেয়ে তরুণ শক্তিকে অতিমূল্যায়ন- এসবের জালে রাষ্ট্র ব্যবস্থাই আটকে পড়েছে। সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের আন্দোলন ও নীতি নির্ধারকদের তৎপরতা এই বাস্তবতারই প্রতিফলন।

এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে শিক্ষকদের অশ্রাব্য ভাষায় অপমান, ভিন্নমত প্রদানকারী শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হেনস্থার মতো নানান অনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য- ছাত্রকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা- এখানে তা কার্যত অদৃশ্য। এর দায় অবশ্যই রাষ্ট্র এবং শিক্ষক উভয়কেই নিতে হবে।

সর্বোপরি, যদি এভাবেই অযৌক্তিক আন্দোলন ও ভিত্তিহীন দাবির মুখে নীতি তৈরি হয় এবং অভিজ্ঞতার মূল্যায়নকে উপেক্ষা করা হয়, তবে ভবিষ্যতে আমরা এমন একটি বাংলাদেশ দেখতে পারি- যেখানে যৌক্তিক জ্ঞান নয়, শারীরিক শক্তি ও চতুর কৌশলই রাজনীতি ও সমাজের প্রধান নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠবে। আর সেই দেশে শিক্ষার আসল মান, নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানবিক মূল্যবোধ ক্ষয়ে যাবে- যা একটি সভ্যসমাজের জন্য গভীর সতর্কবার্তার চূড়ান্ত স্বরূপ।

লেখক : শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ।

ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা।