শরীর সুস্থ রাখতে সবকিছু মনের সুস্থতায় অবহেলা!

অলোক আচার্য

প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

স্বাস্থ্য দুই রকম হয়। শরীর এবং মন। এই দুই মিলেই মানুষ। ইংরেজিতে স্বাস্থ্য নিয়ে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। অর্থাৎ স্বাস্থ্যই সম্পদ। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মুল। এই স্বাস্থ্য বলতে বোঝায় সুস্থতা। স্বাস্থ্যের দু’টি অংশ। শরীর এবং মন। একটি অন্যটির পরিপূরক। সুস্থ দেহের সঙ্গে সুস্থ মনের ঘনিষ্ট যোগসূত্র রয়েছে। পূর্ণাঙ্গ সুস্থ বলতে মানবদেহের উভয় অংশকেই বোঝায়। যদিও মন শব্দটি যেহেতু স্পর্শ করা যায় না, বাহ্যিক দৃষ্টিতে সুখ-অসুখ বোঝা যায় না ফলে মানবদেহের এই অংশটি চিরকালই অবহেলিত। আমরা অধিকাংশই শরীর বলতে শুধু শরীরকেই বোঝাই। অসুস্থতা বলতে শরীরের কোনো রোগকে বুঝিয়ে থাকি। তবে মন যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং অসুস্থ থাকতে পারে সেটা বুঝতে পারি না। শরীর সুস্থ না থাকলে মন সুস্থ থাকে না। কোনো কাজে মনোযোগ রাখা কঠিন হয়। আর সুস্থ স্বাস্থ্য বলতে একটি রোগমুক্ত সুন্দর জীবনকে বোঝায়। যদিও একসময় ভ্রান্ত ধারণা ছিল যে স্বাস্থ্য শব্দটির সাথে শরীরের স্থূলাকার বা শীর্ণকার এর একটি সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য প্রকৃতপক্ষে একটি নিরোগ দেহ যা প্রতিটি মানুষ প্রত্যাশা করে। স্বাস্থ্য শব্দটির অর্থ অনেক বড় এবং বিস্তৃত।

মনের সুস্থতার সম্পর্কও ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে, সেটাও বুঝতে পারি না। মন কীভাবে অসুস্থ হতে পারে অনেকের কাছেই বিষয়টি নতুন। অথচ শরীরে যেমন রোগ হয় এবং চিকিৎসা আছে অনুরূপভাবে মনেরও অসুখ হয় এবং চিকিৎসা আছে। ‘মন খারাপ’ শব্দটি আমরা প্রায়ই ব্যবহার করি। বিভিন্ন কারণে আমাদের মন খারাপ হয়। মানসিক রোগ এবং মানসিক রোগের সুস্থতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রচুর টাকা-পয়সা, গাড়ি-বাড়ি থাকলেই তাকে সুখী মনে করার কোনো কারণ নেই। খাদ্যের গুণ যেমন মুখের স্বাদের ওপর নির্ভর করে না, তেমনি স্বাস্থ্য বিষয়টিও শুধু শরীরের ওপর নির্ভর করে না। বরং এটি একটি স্বাস্থ্য বিষয়ে ক্ষুদ্র ধারণামাত্র এবং প্রচলিত ধারণা। মানসিক রোগ এবং এ নিয়ে আমাদের সমাজে ভ্রান্ত ধারণা এবং অজ্ঞানতা এখনও বিদ্যমান।

মানসিক রোগীকে সমাজে অত্যন্ত ক্ষুদ্র চোখে দেখা হয়। তাদের অবহেলা, অশ্রদ্ধা করা হয়। দেশের গ্রামেগঞ্জে মানসিক রোগী দেখা যায়। করোনা-পরবর্তী সময়ে মানসিক চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে নানা কারণে। চাকরি হারানো, দারিদ্র্যতা প্রভৃতি নানা কারণে মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি এখন আগের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এক তথ্যে দেখা যায়, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন আছে এমন মানুষদের মধ্যে মাত্র ৮ ভাগ মানুষ সেবা নিতে পারছেন, ৯২ শতাংশই মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বাইরে রয়েছেন। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা খাতে আমাদের দেশে যে রিসোর্চের ঘাটতি আছে তা এতেই স্পষ্ট হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তথ্য মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ৩ কোটিরও বেশি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন।

পাস হয়েছে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতি-২০২২। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা ২০১৮-১৯ অনুসারে, দেশের প্রায় ১৭ শতাংশ শিশুর প্রাপ্তবয়স্ক এবং ১৪ শতাংশ শিশুর কোনো না কোনো ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে। জরিপ অনুসারে, মানসিক রোগে আক্রান্ত ২৪.২ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা পান সরকারি হাসপাতালে, ৫.৫ শতাংশ প্রাইভেট প্র্যাকটিশনার সাইকিয়াট্রিস্টদের কাছ থেকে, ৩৩ শতাংশ অন্যান্য ডাক্তারদের কাছ থেকে এবং ২.২ শতাংশ হোমিওপ্যাথি এবং ইউনানি ডাক্তারদের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন, যারা পারসো-অ্যারাবিক ঐতিহ্যবাহী ওষুধ অনুশীলন করেন। তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য কর্মীর সংখ্যা মাত্র ১.১৭ জন। এর মধ্যে ০.১৩ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, ০.০১ জন অন্যান্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ০.৮৭ জন মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সেবিকা এবং ০.১২ জন মনোবিজ্ঞানী ও অন্যান্য পেশাদার মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী।

মোট কথা আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা অনেক কম। মানসিক রোগ বিষয়টিকে রোগের পর্যায়ে ফেলতেও চায় না! অনেকে গ্রাম্য ওঝার কাছে যায় মানসিক চিকিৎসার জন্য! আবার মানসিক চিকিৎসকের অপর্যাপ্ততাও এক্ষেত্রে দায়ী। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৩০ সাল নাগাদ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বিষণ্ণতা ব্যাপক আকার নেবে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসছেন না ৯১ শতাংশের বেশি মানুষ। এক জরিপে দেখা গেছে, ১৮ বছরের বেশি বয়সি মানুষের মধ্যে মানসিক সমস্যা রয়েছে ১৯ দশমিক ৩ শতাংশের। আত্মহত্যা বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হলো মানসিক অসুস্থতা। মানসিক অস্থিরতার জেরেই অনেকে আত্মহত্যা করছে। আবার মানসিক সমস্যার পেছনে অতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহারও রয়েছে।

আবার আমরা যাদের সুস্থ চলাফেরা করতে দেখি তাদের কে মানসিক অস্থিরতায় ভুগছে তা শারীরিক রোগের মতো নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কারণ বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে মনের ব্যাপার। এটা কেউ প্রকাশ করতেই চান না। অল্প সংখ্যক মানুষ এর চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং কাউন্সেলিং অথবা চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হন। কারণ অনেকেই জানে না যে মানসিক রোগের আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে, চিকিৎসায় মানসিক রোগী সুস্থ হয় এবং মানসিক রোগ মানেই মানসিক ভারসাম্যহীনতা নয়। একটি টেকসই ভবিষ্যত গঠনে সুস্বাস্থ্যের বিকল্প নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্য সম্পূর্ণরূপে মানসিক, সামাজিক এবং শারীরিক সুস্থতার একটি অবস্থা, শুধু রোগ বা অসুস্থতার অভাব নয় (১৯৪৮)। এখানে একটি ধারণা স্পষ্ট যে সুস্থতা বলতে শরীর এবং মনের এবং সামাজিক অবস্থাকে বোঝানো হয়েছে। আমাদের খাদ্যাভাস, জীবনযাপন পদ্ধতি, দূষণ, সেবা প্রাপ্তি ইত্যাদি নানা কারণে সুস্থ দেহ, মন বা স্বাস্থ্য বিষয়টি হুমকিতে থাকে।

প্রতিদিন ভাত, মাছ, মাংস, শাকসবজি আমরা খেয়ে থাকি। সবচেয়ে বড় কথা হলো- খাদ্যের মাধ্যমে আমাদের স্বাস্থ্য হুমকিতে পরছে। এর প্রভাব আমাদের মনেও পরে। সুস্থ শরীর ছাড়া সুস্থ মন ধারণ করা কঠিন। অথচ মনের গুরুত্ব আমাদের কাছে একেবারেই কম। শরীরের গুরুত্ব বেশি। শরীর অসুস্থ হলে যত দ্রুত তা সারানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠি, মন অসুস্থ হলে ততটাই নীরব থাকি। এটিকে সাময়িক অবস্থা বলে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করি। এই অবহেলাই একসময় মারাত্মক আকার ধারণ করে। দেশে আত্মহত্যার যে প্রবণতা বাড়ছে, সেখানেই বিষণ্ণতার মতো পরিস্থিতি দায়ী। মানসিক চাপ যা সামলাতে অক্ষম আত্মহত্যাকরী ব্যক্তি। আমাদের জীবনযাপনের অভ্যাসও স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়ক হতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ে অজ্ঞানতার কারণে অতীতকাল থেকেই ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। অসুখ শুধু শরীরেই হয়, এই ধারণাই প্রতিষ্ঠিত। আর এক ধরনের অন্ধকারে ছিল মানুষ। আজও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে মানুষের সেই ধারণার খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি। এর কারণ মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে শিক্ষার অভাব, জানার অভাব এবং চর্চার অভাব।

মানসিক অসুখের খুব একটা গুরুত্ব নেই। গুরুত্ব আছে কিন্তু সচেতনতা একেবারেই নেই। শরীরে জ্বর হলে যেভাবে তা সারানোর জন্য ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি করা হয়, বিষণ্ণতার কারণে ডাক্তারের কাছে ছোটে না।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট, পাবনা।