শিক্ষিত কর্মী গণতন্ত্র, নৈতিকতা ও ভদ্রতার রক্ষক
এসএম হাসানুজ্জামান
প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রাজনীতি হলো- একটি দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনের মূল স্তম্ভ। এটি শুধু ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যম নয়, বরং গণতন্ত্রের স্থিতিশীলতা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সমাজের উন্নয়ন নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, যেসব দেশে শক্তিশালী, শিক্ষিত এবং দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল রয়েছে, সেখানে দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহজে অর্জিত হয়। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা লক্ষ্য করা যাচ্ছে- শিক্ষিত কর্মীর অভাব।
এই অভাব শুধু দলের কার্যকারিতা প্রভাবিত করছে না, বরং দলের নৈতিকতা, ভদ্রতা এবং সংস্কৃতিবোধকেও হ্রাস করছে। শিক্ষিত কর্মী বলতে আমরা বুঝি সেই ধরনের কর্মী, যিনি শিক্ষার পাশাপাশি নেতৃত্বের সঙ্গে সমন্বয়, বিশ্লেষণ ক্ষমতা, নৈতিক মূল্যবোধ, সাংগঠনিক দক্ষতা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা রাখেন। তারা দলের নীতি ও কর্মকাণ্ডকে সঠিকভাবে বোঝেন, জনগণের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করতে পারেন এবং দলীয় কর্মকাণ্ডকে জনকল্যাণমুখী ও ন্যায়মুখী করতে সহায়তা করেন। কিন্তু যখন রাজনৈতিক দলে পর্যাপ্ত শিক্ষিত কর্মী নেই, তখন অশিক্ষিত বা কম অভিজ্ঞ সদস্যরা দল পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভুল করতে পারে। ফলে দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার অভাব দেখা দেয়, যা জনগণের আস্থাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস প্রমাণ করে যে, দেশে রাজনৈতিক দলগুলো প্রাথমিকভাবে জনগণের কল্যাণ ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল। সেই সময়ের নেতারা শিক্ষিত এবং দায়িত্বশীল কর্মীদের দলীয় কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তারা শুধু ক্ষমতা অর্জনের জন্য নয়, বরং সমাজের শৃঙ্খলা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক দলের প্রণালী পরিবর্তিত হয়েছে। আজকের দলে দেখা যায়, ব্যক্তি স্বার্থ, পারিবারিক প্রভাব, ক্ষমতার লোভ এবং অশিক্ষিত কর্মীর আধিক্য দলের নীতি ও আচরণকে প্রভাবিত করছে।
শিক্ষিত কর্মীর অভাবের কারণে দলের নৈতিকতা ও ভদ্রতা হারিয়ে যায়। এটি কেবল সভা, সমাবেশ বা দলীয় কাজকর্মে নয়, জনসংযোগ, প্রচারণা, বিতর্ক এবং অনলাইন মাধ্যমে দলের আচরণেও দৃশ্যমান হয়। সভা-সমাবেশে অগোছালো আয়োজন, নেতাদের অশোভন বক্তব্য এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ- এসবের পেছনে মূল কারণ হলো- শিক্ষিত ও যোগ্যকর্মীর অভাব। যখন শিক্ষিত কর্মী উপস্থিত থাকে, তারা নেতৃত্বকে পরামর্শ দেন, দলের কর্মকাণ্ডকে সুশৃঙ্খল রাখেন এবং সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করেন। শিক্ষিত কর্মী না থাকলে রাজনৈতিক দল শুধু ক্ষমতার লোভে লিপ্ত হয়। দলের স্বার্থ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম পিছিয়ে পড়ে। এটি দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং জনগণের আস্থা কমিয়ে দেয়। জনগণ দেখবে, নেতৃত্বের সঙ্গে কর্মীরাও দায়িত্বশীল নয়। ফলে রাজনৈতিক সংস্কার, গণতন্ত্র এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হয়।
শিক্ষিত কর্মী থাকলে দল অভ্যন্তরীণ সংঘাত, দ্বন্দ্ব এবং ক্ষমতার দখলকে যৌক্তিকভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম হয়। তারা নেতৃত্বকে পরামর্শ দেন, দলকে সুসংগঠিত রাখেন এবং দলের কর্মকাণ্ডকে জনকল্যাণমুখী করে তোলেন। শিক্ষিত কর্মী শুধু প্রশাসনিক দক্ষতা প্রদান করেন না; তারা দলের নৈতিকতা, ভদ্রতা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতাও বজায় রাখেন। আজকের রাজনৈতিক দলগুলোতে শিক্ষিত কর্মীর সংখ্যা কম। এর ফলে দেখা যায়, দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া, জনসংযোগ এবং প্রচারণা অনেক সময় অগোছালো, অনিয়মিত এবং অকার্যকর হয়। নেতারা প্রায়শই ব্যক্তিগত স্বার্থ ও লোভের দ্বারা পরিচালিত হন। শিক্ষিত কর্মী থাকলে দলীয় কর্মকাণ্ড স্বচ্ছ, কার্যকর এবং জনগণের সঙ্গে সংবেদনশীলভাবে সংযুক্ত হতো।
শিক্ষিত কর্মী শুধু প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রদান করেন না; তারা দলকে সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল করে তোলে। জনসভা, সমাবেশ, অনলাইন প্রচারণা এবং মিডিয়ায় দলের উপস্থিতি তাদের মাধ্যমে ভদ্র, ন্যায়মুখী এবং সংযমপূর্ণ হয়। শিক্ষিত কর্মী না থাকলে অশিক্ষিত কর্মীরা অশোভন আচরণ, ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং অশালীন প্রচারণা চালায়, যা দলের সুনাম ক্ষুণ্ণ করে। শিক্ষিত কর্মীর অভাবের কারণে রাজনৈতিক দল নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয়। নেতৃত্বের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা, অগোছালো কার্যক্রম এবং নীতিমালার অভাব দলের কার্যকারিতা হ্রাস করে। জনগণকে ঠিকভাবে প্রভাবিত করা যায় না, দলের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হয়।
শিক্ষিত কর্মী থাকলে দল শুধু ক্ষমতা অর্জন করে না; তারা জনগণের কল্যাণ ও সমাজের উন্নয়নকেও অগ্রাধিকার দেয়। তারা নেতাদেরকে সমালোচনা এবং পরামর্শ দেন, দলের নীতি বাস্তবায়নে সহায়তা করেন এবং নেতৃত্ব ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করেন। শিক্ষিত কর্মীর উপস্থিতি রাজনৈতিক সংস্কার বজায় রাখার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। তারা দলীয় শৃঙ্খলা, নৈতিকতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষা করেন। পাশাপাশি তারা নেতাদের সঙ্গে জনগণকে সংযুক্ত রাখে, জনসংযোগ স্থাপন করে এবং সামাজিক দায়িত্ব পালনে সাহায্য করেন।
আজকের রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ চিত্র দেখলেই বোঝা যায়, শিক্ষিত কর্মীর অভাব কতটা ক্ষতিকর। নেতারা প্রায়শই স্বার্থপর, অশালীন এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে পড়েন। দলীয় নীতি ও আচরণ অগোছালো হয়ে যায়। শিক্ষিত কর্মী থাকলে দলীয় শৃঙ্খলা বজায় থাকে, নেতৃত্বের আচরণ দায়িত্বশীল হয় এবং দলের সামাজিক ও নৈতিক মর্যাদা বজায় থাকে। শিক্ষিত কর্মীর অভাব শুধু দলের অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ডে প্রভাব ফেলে না; এটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কার, গণতন্ত্র এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। শিক্ষিত কর্মীর ভূমিকা হলো দলকে সুসংগঠিত রাখা, নেতাদের পরামর্শ দেওয়া এবং জনগণের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করা। তারা দলের নৈতিকতা ও ভদ্রতাকেও রক্ষা করেন। অতএব, রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এখন সময় এসেছে- শিক্ষিত কর্মীকে দলের মূল স্তরে অন্তর্ভুক্ত করার। শুধু নেতৃত্ব নয়, শিক্ষিত কর্মীর উপস্থিতিই দলকে সংহত, দায়িত্বশীল, কার্যকর এবং সামাজিকভাবে সম্মানিত করে। শিক্ষিত কর্মী থাকলে দল শুধু ক্ষমতা অর্জন করে না, বরং সমাজের কল্যাণকেও অগ্রাধিকার দেয়। দেশের গণতন্ত্র, রাজনৈতিক সংস্কার এবং সামাজিক ন্যায়ের জন্য শিক্ষিত কর্মীর উপস্থিতি অপরিহার্য। তাদের অভাব থাকলে রাজনৈতিক দল অগোছালো, অশালীন এবং স্বার্থপর হয়ে পড়ে। শিক্ষিত কর্মীর মাধ্যমে নেতৃত্বকে সমন্বিত করা যায়, দলীয় নীতি বাস্তবায়ন করা যায়, এবং জনগণের আস্থা বজায় রাখা যায়। শেষ কথায় বলা যায়, শিক্ষিত কর্মীর অভাব রাজনৈতিক দলে শুধু কার্যকারিতা নয়, ভদ্রতা, নৈতিকতা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতাকেও হারিয়ে দেয়। তাই দেশের রাজনৈতিক সংস্কার, গণতন্ত্র এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য শিক্ষিত কর্মীকে রাজনৈতিক দলের হৃদয়ে আনতেই হবে।
শুধু আইন বা নিয়মের প্রয়োগে নয়, শিক্ষিত কর্মীর উপস্থিতি এবং নেতৃত্বের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলকে কার্যকর, ভদ্র এবং নৈতিকভাবে শক্তিশালী করা সম্ভব। শিক্ষিত কর্মী হলো- রাজনৈতিক দলের প্রাণ, শৃঙ্খলা ও ভদ্রতার রক্ষক। শিক্ষিত কর্মীর উপস্থিতি রাজনৈতিক দলের স্থায়িত্ব, নেতৃত্বের কার্যকারিতা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং জনগণের আস্থা নিশ্চিত করে। তারা নেতৃত্বকে দিকনির্দেশনা দেন, দলের নীতি বাস্তবায়ন নিশ্চিত করেন এবং রাজনৈতিক পরিবেশকে সুশৃঙ্খল রাখেন। তাদের অবদান ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল সুসংগঠিত ও জনমুখী হতে পারে না।
আজকের সময়ে শিক্ষিত কর্মী Political party -এর সবচেয়ে বড় শক্তি। তারা শুধু দলের জন্য নয়, দেশের গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায় এবং জনগণের কল্যাণ রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিক্ষিত কর্মীর অভাব রাজনৈতিক দলকে অশৃঙ্খল, অশালীন এবং স্বার্থপর করে।
এই কারণেই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য শিক্ষিত ও যোগ্য কর্মী গড়ে তোলা এবং তাদের নেতৃত্বের সঙ্গে সমন্বয় করা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষিত কর্মী থাকলে দলীয় কর্মকাণ্ড সুশৃঙ্খল, ন্যায়মুখী এবং জনগণের জন্য দায়িত্বশীল হয়। তারা নেতৃত্বকে পরামর্শ দেন, দলের নৈতিকতা বজায় রাখেন এবং রাজনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। শেষপর্যন্ত, শিক্ষিত কর্মীর উপস্থিতি রাজনৈতিক দলকে শুধুমাত্র শক্তিশালী করে না, বরং নেতৃত্বের নৈতিকতা, দলের শালীনতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং জনগণের আস্থা নিশ্চিত করে। তাই দেশের গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য শিক্ষিত কর্মীর উপস্থিতি অপরিহার্য। শিক্ষিত কর্মী Political party -এর প্রাণ, শৃঙ্খলা এবং ভদ্রতার রক্ষক।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, ও কলাম লেখক, রংপুর
