কন্যার চোখে বিশ্ব ও আমাদের দায়বদ্ধতা
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ভোরের আলোয় একটি কন্যাশিশু স্কুলের পথে হাঁটে- বইভর্তি ব্যাগ হাতে, মুখে স্বপ্নের ঝলক। কিন্তু সেই স্বপ্নের পথ কতটা নিরাপদ, কতটা সমান, কতটা উজ্জ্বল- এই প্রশ্নই প্রতি বছর ১১ অক্টোবর আমাদের সামনে ফিরে আসে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবসের মাধ্যমে।
জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০১২ সাল থেকে দিবসটি পালিত হচ্ছে। ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ রেজুলেশন ৬৬/১৭০ পাসের মাধ্যমে ১১ অক্টোবরকে ‘আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই- বিশ্বজুড়ে মেয়েদের অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করা এবং লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য দূর করা।
এই দিবসের তাৎপর্য শুধু প্রতীকী নয়; এটি আমাদের বিবেকের দরজায় ধাক্কা দেয়। একটি কন্যাশিশু যখন শিক্ষা, চিকিৎসা বা নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হয়, তখন পুরো সমাজ পিছিয়ে পড়ে। কারণ কন্যাশিশুই আগামী মা, শিক্ষক, উদ্যোক্তা, বিজ্ঞানী- একটি জাতির প্রাণশক্তির ধারক।
বিশ্বে কন্যাশিশুর চিত্র: বিশ্বজুড়ে কন্যাশিশুরা এখনও নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
শিক্ষা : প্রায় ১৩৩ মিলিয়ন মেয়ে শিশু স্কুলের বাইরে। শিক্ষার অভাবে তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন থেকে বঞ্চিত। শিক্ষার অভাব তাদের আত্মনির্ভরতা ও সমান সুযোগের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে।
সহিংসতা : ১৫-১৯ বছর বয়সি মেয়েদের মধ্যে প্রতি চারজনের একজন শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার। সহিংসতার ফলে কিশোরীরা শিক্ষাগত এবং সামাজিক অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়।
বাল্যবিবাহ : ২০-২৪ বছর বয়সি তরুণীদের এক-পঞ্চমাংশ কন্যা বয়সেই বিবাহিত। বাল্যবিবাহ কিশোরীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক জীবনকে দীর্ঘমেয়াদিভাবে প্রভাবিত করে। যুদ্ধ, দারিদ্র্য ও উদ্বাস্তু জীবনে মেয়েরা আরও ঝুঁকির মুখে পড়ে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হওয়া তাদের সম্ভাবনাকে সীমিত করে। UNICEF -এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বৈষম্য এবং সহিংসতার কারণে মেয়েরা তাদের সম্ভাবনার ৩০-৪০% পর্যন্ত হারায়।
স্বাস্থ্য ও পুষ্টি : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, কন্যাশিশুদের মধ্যে পুষ্টিহীনতা, রক্তাল্পতা ও শিশু-মাতৃমৃত্যু উচ্চ মাত্রায় আছে। স্বাস্থ্য সেবা ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে না পারার ফলে মেয়েদের দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনা ক্ষুণ্ণ হয়।
মানসিক স্বাস্থ্য : সামাজিক কুসংস্কার, শিক্ষাগত চাপ, সহিংসতার আশঙ্কা ও আত্মমর্যাদা সংক্রান্ত ভয় কিশোরী মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট : বাংলাদেশে মেয়েদের শিক্ষায় ও স্বাস্থ্যখাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও চ্যালেঞ্জ বহুমাত্রিক।
বাল্যবিবাহ : ২০-২৪ বছর বয়সি নারীদের ৫১.৪% ১৮ বছরের আগেই বিবাহিত। আইন থাকলেও সামাজিক চাপ ও দারিদ্র্য বাল্যবিবাহের হার কমাতে ব্যর্থ। বাল্যবিবাহের কারণে মেয়েরা শিক্ষাজীবন ত্যাগ করে এবং আত্মনির্ভর হওয়ার সুযোগ হারায়।
শিক্ষা ও অংশগ্রহণ : মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের শিক্ষা সম্পন্ন করার হার প্রায় ৫৯%। ডিজিটাল প্রযুক্তি, ল্যাব সুবিধা ও নিরাপদ অবকাঠামোর অভাবে শিক্ষার মান ও অংশগ্রহণ সীমিত। গ্রামীণ এলাকায় স্বাস্থ্যবান্ধব টয়লেট, নিরাপদ পরিবহন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত না থাকায় মেয়েরা বিদ্যালয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। STEM (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত) শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি হলেও এখনও সীমিত।
স্বাস্থ্য ও পুষ্টি : কন্যাশিশুদের মধ্যে পুষ্টিহীনতার হার ৩১%। রক্তাল্পতায় ভোগে প্রায় অর্ধেকের বেশি কিশোরী। কৈশোরে পুষ্টির অভাব মানসিক স্বাস্থ্য, শিক্ষাগত অর্জন এবং শারীরিক বিকাশকে প্রভাবিত করে। স্বাস্থ্য শিক্ষা, আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্ট, মাসিক-স্বাস্থ্যবান্ধব স্কুল পরিবেশ ও পরামর্শক সেবা নিশ্চিত করা জরুরি। মানসিক সুস্থতা : শিক্ষার চাপ, সামাজিক মানসিকতা ও সহিংসতার আশঙ্কা মেয়েদের মানসিক চাপ বৃদ্ধি করে। মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং কিশোরী-বন্ধুত্বপূর্ণ সেবা প্রয়োজন।
সহিংসতা ও নিরাপত্তা : প্রতিবছর নারী ও কন্যাশিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা অপর্যাপ্ত আইনি প্রতিকার ও সামাজিক সচেতনতার কারণে বাড়ছে। মেয়েদের নিরাপদ পরিবেশ, নির্যাতন রোধে কার্যকর নীতি ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয় অপরিহার্য।
প্রতিবন্ধকতা ও সংকট- সামাজিক কুসংস্কার ও মানসিকতা : মেয়েদের সম্ভাবনা সীমাবদ্ধ মনে করা, নিরাপত্তার নামে শিক্ষায় বাধা।
অবকাঠামোগত ঘাটতি : স্বাস্থ্যবান্ধব টয়লেট, নিরাপদ পরিবহন ও ডিজিটাল সুযোগের অভাব। নীতির দুর্বল বাস্তবায়ন : আইন থাকলেও প্রয়োগ কম।
অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা : দারিদ্র্য ও আয়ের সীমাবদ্ধতা মেয়েদের শিক্ষাগত ও সামাজিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে।
স্বাস্থ্য সমস্যা : পুষ্টিহীনতা, কৈশোরকালীন স্বাস্থ্য সংকট, মাতৃমৃত্যু ঝুঁকি।
দুর্যোগ ও বাস্তুচ্যুতি : বন্যা, সাইক্লোন ও উদ্বাস্তু জীবনে মেয়েরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে।
আন্তর্জাতিক তুলনা ও অভিজ্ঞতা : দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বাল্যবিবাহের হার এখনও বেশি; বাংলাদেশে ৫১% হলেও ভারতের নির্দিষ্ট রাজ্যে ৫০-৬০% পর্যন্ত। আফ্রিকার কিছু দেশে স্কুলে মেয়েদের অংশগ্রহণ কম, তবে আইন ও সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি দেখা গেছে। নরওয়ে, ফিনল্যান্ড ও কানাডার মতো দেশে মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নেতৃত্ব বিকাশে সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হয়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নীতি আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী উন্নত করা গেলে মেয়েদের সম্ভাবনা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।
নীতিগত পরামর্শ : মেয়েদের জন্য নিরাপদ শিক্ষা পরিবেশ নিশ্চিত করা। স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়। STEM শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়ানো। সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক মানসিকতা পরিবর্তন ও আইনি প্রয়োগ জোরদার করা।
করণীয় ও দায়িত্ব- কন্যাশিশুর করণীয় : অধিকার সচেতনতা ও শিক্ষায় অবিচল থাকা। আত্মবিশ্বাস, নেতৃত্বগুণ ও প্রযুক্তি দক্ষতা অর্জন। স্বাস্থ্য সচেতনতা ও সামাজিক অংশগ্রহণ বাড়ানো।
অভিভাবক ও পরিবার : মেয়ের মতামত শোনা ও মূল্যায়ন। সমান সুযোগ নিশ্চিত করা ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি। সামাজিক কুসংস্কার ও ভয় দূর করা।
রাষ্ট্র ও নীতি প্রণেতা : বাল্যবিবাহ ও সহিংসতা রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ। স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টিতে মেয়েদের অগ্রাধিকার। নিরাপদ বিদ্যালয়, পরিবহন ও ডিজিটাল সুযোগ নিশ্চিত। মেয়েদের নেতৃত্ব ও উদ্যোক্তা বিকাশে বিনিয়োগ।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : জেন্ডার সচেতনতা ক্লাব, স্বাস্থ্য পরামর্শক কক্ষ ও নিরাপদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি। শিক্ষকদের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস ও নেতৃত্ব গড়ে তোলা। শিক্ষামূলক কর্মসূচি ও মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা প্রদান।
কন্যা শিশু দিবস নিয়ে বিভ্রান্তি : আমাদের দেশে শিশুদের জন্য বেশ কয়েকটি দিবস উদযাপন করা হয়। শিশু বিষয়ে একাধিক দিবস থাকায় অনেকের কাছে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। যেমন আমাদের দেশে কন্যা শিশু দিবস মোট ৩ দিন বা ৩ বার উদযাপন করা হয়। তাই ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে নিজের এবং অন্যদের সেই বিভ্রান্তি দূর করার চেষ্টা থেকে এই লেখা। চলুন দিবসগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে নেই।
বিভ্রান্তি যেভাবে তৈরি হলো : বিগত কয়েক বছর পূর্বে ভারতে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ নাগাদ ‘কন্যা দিবস’ উদযাপন করতে দেখা যায়। ভারতীয়দের সঙ্গে মিল রেখে আমাদের দেশেও ব্যক্তি পর্যায়ে (বিশেষত ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে) সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবার কন্যা শিশু দিবস পালনের প্রচলন শুরু হয়।
যা উপরে উল্লিখিত তিনটি দিবসের বাহিরে পালন করা হচ্ছে। কিন্তু দিবসটি মোটেও ভারত বা বাংলাদেশের ‘জাতীয়’ বা জাতিসংঘ ঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস’ নয়। এই দুই দেশেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দুটি কন্যা শিশু দিবস উদযাপন করা হয়। তাই নতুনভাবে আরেকটি দিবস পালনের কোনো যৌক্তিকতা নেই বরং এটি উদযাপন এর ফলে আমাদের মূল দিবস দুটি তার গুরুত্ব হারাচ্ছে বলে আমি মনে করি।
কারা তৈরি করলো এই বিভ্রান্তি : সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবার যে কন্যা দিবস উদযাপন করা হয় তা মূলত শুরু করে ‘আর্কিস লিমিটেড’ নামে ভারতীয় শুভেচ্ছা কার্ড নির্মাণকারী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তারা কন্যা শিশু সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে দিবসটি সৃষ্টি করেছে বলে দাবি করলেও এটি মূলত তাদের কার্ডের ব্যবসা বাড়াতে একটি প্রচারণা বলে অনেকে মনে করেন। ফলে দিবসটি ভারতে জাতীয় দিবসের মর্যাদা পায়নি।
কিন্তু ‘আর্কিস লিমিটেড’ সুচতুর ভাবে ‘আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস’ দাবি করে। উল্লেখ্য জাতিসংঘ ঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক কন্যা দিবস ১১ অক্টোবর, যা ২০১২ সাল থেকে উদযাপিত হচ্ছে এবং ভারত সরকার কর্তৃক ঘোষিত জাতীয় কন্যা দিবস ২৪ জানুয়ারি যা ২০০৮ সাল থেকে ভারতে উদ?যাপন হচ্ছে। বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বরকে ‘জাতীয় কন্যা শিশু দিবস’ হিসেবে পালন করে। তাহলে আমাদের দেশে হঠাৎ করে সেপ্টেম্বও মাসের শেষ রবিবার কন্যা দিবস পালনের যৌক্তিকতা কোথায়?
পরিশেষে, ১১ অক্টোবর আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রতিটি কন্যাশিশু একেকটি সম্ভাবনার আলো। তাদের চোখে যে স্বপ্ন, সেটিই আগামী বাংলাদেশের মুখ। কন্যাশিশুকে করুণা নয়, সম্মান ও সুযোগের অধিকার দিতে হবে। যখন প্রতিটি কন্যাশিশু নিরাপদ, শিক্ষিত ও আত্মবিশ্বাসী হবে, তখনই দেশ সত্যিকারের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জন করবে। আমাদের দায়িত্ব হলো আজ থেকেই নীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সচেতনতা নিশ্চিত করা।একটি দেশে প্রতিটি মেয়ে বলবে না, ‘আমি শুধু মেয়ে।’ বরং গর্বের সঙ্গে বলবে, আমি ভবিষ্যৎ।
লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
