ফুটবলের এই সিন্ডিকেট আর কত

মো. নূর হামজা পিয়াস

প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সম্প্রতি এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বের ফুটবল খেলায় ঘরের মাঠে আগের ম্যাচে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে হারের পর দল প্রচণ্ড সমালোচিত হয়েছিল। কিন্তু সবকিছু সামলে নিয়ে আবারও নিজেদের টিকে থাকার লড়াইয়ে হংকংয়ের বিরুদ্ধে খেলতে নামে বাংলাদেশ। খেলার নাটকীয় পর্যায়ের শেষ মুহূর্তের দিকে গোল করে ম্যাচ ড্র করার আশায় গ্যালারিতে সব সমর্থক বাঁধভাঙা উল্লাসে ফেটে পড়ে। কিন্তু এই খুশির মুহূর্ত বেশিক্ষণ স্থায়ী ছিল না। খেলার সর্বশেষ সময়ে গোল করে জয় ছিনিয়ে নেয় হংকং। যে হার কখনওই মেনে নেওয়ার মতো নয়।

খেলায় হার-জিত থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু খেলা দেখার মাঝে বারবার কিছু প্রশ্ন মনে আসে, ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে কেন জানানো হয় যে ফর্মে থাকা কোনো খেলোয়াড় স্কোয়াডে নেই? কেন পারফর্ম করার মতো খেলোয়াড়দের বেঞ্চে বসিয়ে রেখে অফ-ফর্মে থাকা প্লেয়ারদেরকেই বারবার এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতে সুযোগ দেওয়া হয়? বিষয়টি কি আসলে কেবল তাদের সামর্থ্যরে অভাব? নাকি এর পেছনে এমন কোনো শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে, যা দেশের ফুটবলের অগ্রগতির জন্য স্থায়ী বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে?

সম্প্রতি বাংলাদেশ ফুটবল হাটি হাটি পা পা করে এগোতে শুরু করেছে। প্রথমে হামজা চৌধুরী, এরপর সামিত সোম, ফাহমিদুল, জায়ান আহমেদ, কিউবা মিচেলদের মতো খেলোয়াড়দের এই দলে আসায় দলটি আগের তুলনায় ফর্ম ফিরে পাচ্ছে, পাচ্ছে নতুন গতি। কিন্তু খারাপ লাগে সেই সকল খেলোয়াড়দের ফের জন্য, যারা তাদের বাইরের দেশের উন্নত ভবিষ্যৎ রেখে শুধু নিজের দেশের হয়ে খেলার জন্য এসেছিলেন ‘অন্ধের দেশে আয়না বিক্রি করতে’।

এত চেষ্টা, এত আশা থাকার পরেও যখন নিজেদের ঘরের মাঠে ম্যাচের হারের স্বাদ পেতে হয়, তখন তা শুধু এক হৃদয়বিদারক দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেকের মুখেই এখন এই কথা প্রচলিত হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশ দল মানেই হতাশা, হোক সেটা ফুটবল কিংবা ক্রিকেট। কিন্তু অতীতে একসময় বাংলাদেশ ফুটবল ছিল এশিয়ার অন্যতম প্রতিশ্রুতিশীল দল। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ কিংবা আবাহনী-মোহামেডানের ম্যাচ মানেই ছিল উৎসব। কিন্তু সেই গৌরব আজ ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ। মাঠের খেলার চেয়ে প্রশাসনিক টানাপোড়েন ও সিন্ডিকেট রাজনীতি আজ ফুটবলের প্রাণশক্তি কেড়ে নিচ্ছে। যে খেলা একসময় একতা আর ভালোবাসার প্রতীক ছিল, তা আজ কিছু লোকের ক্ষমতার খেলায় পরিণত হয়েছে। এই অবনতি শুধুই খেলোয়াড়দের নয়, পুরো জাতির ক্রীড়াসত্ত্বাকে ধ্বংস করছে।

বাংলাদেশ ফুটবলে সিন্ডিকেট সংস্কৃতি নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে কিছু প্রভাবশালী কর্মকর্তা ও ক্লাব মালিক একে অপরের স্বার্থ রক্ষা করে ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। তারা কোচ, খেলোয়াড় নির্বাচন, এমনকি রেফারির সিদ্ধান্তেও প্রভাব ফেলেন। জাতীয় দলে কারা খেলবে, কে কোচ হবে সবই এই গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। ফলে যোগ্যতা নয়, তোষামোদই হয়ে উঠেছে সাফল্যের চাবিকাঠি। এর ফলেই প্রকৃত মেধাবীরা বাদ পড়ছে, আর ফুটবল ডুবে যাচ্ছে অদক্ষ ব্যবস্থাপনার অন্ধকারে।

বাংলাদেশে ফুটবল কোচ নির্বাচনে কোনো পেশাদার মানদ- নেই। বরং সম্পর্ক, প্রভাব ও সিন্ডিকেটের অনুমোদনই নির্ধারণ করে কে কোচ হবেন। অনেক সময় অদক্ষ বিদেশি কোচ এনে বিপুল অর্থ খরচ করা হয়, কিন্তু তার কোনো বাস্তব ফল পাওয়া যায় না। আবার স্থানীয় মেধাবী কোচরা সুযোগ পান না কেবল লবিং না থাকার কারণে। ফলে খেলোয়াড়দের দক্ষতা বাড়ানোর বদলে অনুশীলন পরিণত হয় আনুষ্ঠানিকতায়।

জাতীয় দলে কিংবা প্রিমিয়ার লিগে খেলোয়াড় বাছাইয়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রভাবই মুখ্য। অনেক যোগ্য তরুণ খেলোয়াড় ক্লাব পর্যায়ে ভালো খেললেও, নির্বাচনি সিন্ডিকেট তাদের উপেক্ষা করে। আবার যাদের সঙ্গে ক্লাব কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, তারা স্থান পায় দলে। এই অনৈতিক প্রক্রিয়া শুধু মেধাকে হত্যা করছে না, তরুণ প্রজন্মকে হতাশ করে খেলাধুলা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করছে।

এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (অঋঈ) ক্লাব ফুটবলের পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করতে ক্লাব লাইসেন্সিংয়ের ওপর জোর দেয়। কিন্তু বাংলাদেশে ক্লাব লাইসেন্সিং প্রক্রিয়ায় নিয়মের শিথিলতা দেখা যায়। অনেক ক্লাবই তাদের আর্থিক স্বচ্ছতা, অবকাঠামো বা যুব উন্নয়ন কর্মসূচি সংক্রান্ত মানদ- পূরণ না করেও লাইসেন্স পেয়ে যায়। এই শিথিলতা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এরফলে লিগের মান বাড়ে না, বরং দুর্বল ক্লাবগুলো খেলাধুলার পরিবর্তে রাজনীতির কেন্দ্র হিসেবে টিকে থাকে। লাইসেন্সিং প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং কঠোর মানদ- আরোপ করা হলে অযোগ্য ক্লাবগুলো এমনিতেই ঝরে পড়বে এবং ফুটবলে পেশাদারিত্ব ফিরবে।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) পরিচালনায় বছরের পর বছর ধরে স্বচ্ছতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। বাজেট, প্রজেক্ট খরচ বা টুর্নামেন্ট আয়োজন সবখানেই অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থার দেওয়া তহবিল সঠিকভাবে ব্যবহারের কোনো জবাবদিহিতা নেই। অনেক সময় খেলোয়াড়দের প্রাপ্য সম্মানী বিলম্বিত হয় বা কমিয়ে দেওয়া হয়। এই দুর্নীতিপূর্ণ প্রশাসনই আসলে সিন্ডিকেট সংস্কৃতির মূল চালিকা শক্তি।

সিন্ডিকেট হলো এক ধরনের অদৃশ্য ক্ষমতাকেন্দ্র বা চক্র, যা বাংলাদেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ স্তরে শিকড় গেড়ে বসে আছে। এই প্রভাবশালী গোষ্ঠীটি মূলত কিছু কর্মকর্তা ও ক্লাব মালিকদের দ্বারা গঠিত, যাদের মূল লক্ষ্য ফুটবলের উন্নয়নের চেয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করা। সিন্ডিকেটের কারণে জাতীয় দলে কোচ ও খেলোয়াড় নির্বাচন হয় মেধার ভিত্তিতে নয়, বরং তোষামোদ বা আর্থিক লেনদেনের ভিত্তিতে। ফলে দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় এবং দেশের ফুটবল আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছানোর বদলে হতাশার গর্তে তলিয়ে যেতে থাকে। দেশের প্রথিতযশা ক্লাবগুলো এখন আর ফুটবল উন্নয়নের কেন্দ্র নয়, বরং রাজনীতির ঘাঁটি। ক্লাবের সভাপতিত্ব মানে সামাজিক প্রভাব ও রাজনৈতিক অবস্থান জোরদার করা। ফলে খেলোয়াড়দের উন্নয়নের চেয়ে ক্লাব কমিটির অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্লাবগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে জাতীয় লিগগুলোও মান হারাচ্ছে, আর ফুটবলাররা হারাচ্ছে অনুপ্রেরণা ও স্থিতিশীলতা। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে খেলোয়াড়দের বেতন বকেয়া থাকা, ম্যাচ স্থগিত হওয়া কিংবা মাঠের নিম্নমান সবই সাধারণ দৃশ্য। টেলিভিশন সম্প্রচার ও দর্শক আকর্ষণের মতো বিষয়গুলোতেও প্রশাসনের গাফিলতি স্পষ্ট। ফলে লিগের মান ও আকর্ষণ ক্রমশ কমে যাচ্ছে। একটি সুষ্ঠু পেশাদার কাঠামো না থাকায় খেলোয়াড়রা বিদেশে সুযোগ খুঁজে চলে যাচ্ছেন, দেশীয় প্রতিযোগিতা হয়ে পড়ছে প্রাণহীন। দেশের নানা প্রান্তে হাজারো তরুণ ফুটবলার প্রতিদিন স্বপ্ন দেখে জাতীয় দলের হয়ে খেলার। কিন্তু সিন্ডিকেটের বাঁধায় তারা প্রতিভা প্রদর্শনের সুযোগই পায় না। স্থানীয় টুর্নামেন্টগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে অনিয়মের ছড়াছড়ি। ফলে ফুটবল একসময় যে খেলাটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করত, এখন তা হতাশা আর অন্যায়ের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যম মাঝে মাঝে এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও, তা সাময়িক সাড়া ফেলে। কারণ প্রভাবশালীদের চাপ ও বিজ্ঞাপন নির্ভরতার কারণে অনেক সময় সাংবাদিকরা মুখ খুলতে পারেন না। ফলে সত্য উদঘাটনের উদ্যোগ ধীরে ধীরে থেমে যায়। অথচ মিডিয়া যদি একসঙ্গে শক্ত অবস্থান নেয়, তাহলে ফুটবল ফেডারেশনের জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব। সরকারি পর্যায়ে ফুটবলের উন্নয়ন নিয়ে নীতিগত কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই। অবকাঠামো উন্নয়নে কিছু উদ্যোগ থাকলেও, তদারকি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করায় তা ব্যর্থ হয়। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল ফুটবলকে পুনরুজ্জীবিত করতে জাতীয় নীতিমালা গ্রহণ করা, কিন্তু সেখানে রাজনৈতিক প্রভাবই বেশি দেখা যায়। ফলে জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতাও ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। আধুনিক প্রশিক্ষণ, ফিটনেস, ডায়েট, ও ট্যাকটিক্যাল জ্ঞানের ঘাটতি প্রকট। অন্যদিকে, সিন্ডিকেটের কারণে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের পরিকল্পনা কার্যকর হয় না। ফুটবলের উন্নয়নে দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রফেশনাল টিম ম্যানেজমেন্ট, যা এখনও অধরাই রয়ে গেছে। সবকিছু হতাশার নয়। এখনও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মেধাবী তরুণ খেলোয়াড় উঠে আসছে। কিছু একাডেমি ও স্থানীয় কোচ নিজস্ব উদ্যোগে ফুটবলকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।

লেখক : আইন বিভাগ, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ