জাতীয় প্রতীকের দখলযুদ্ধ

এসএম হাসানুজ্জামান

প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতীক মানে শুধু একটি চিহ্ন নয়- এটি এক ধরনের অস্তিত্বের ঘোষণা, আত্মপরিচয়ের প্রতিমূর্তি এবং ক্ষমতার প্রতীকী অনুবাদ। রাষ্ট্র, দল, জনগণ ও নেতৃত্ব- এই চার উপাদানের মধ্যে যোগাযোগের যে সেতু, সেই সেতুর স্তম্ভ গড়ে ওঠে প্রতীকের ওপর। নির্বাচন কমিশনের দরজায় নিবন্ধন প্রত্যাশী দলগুলোর ভিড় যেমন রাজনৈতিক পুনর্জন্মের আকাঙ্ক্ষা, তেমনি প্রতীকের জন্য তীব্র আকুতি প্রকাশ করে রাজনৈতিক অস্তিত্বের নিরাপত্তাহীনতাকেও। আর এই প্রেক্ষাপটে ‘শাপলা’ নামক প্রতীকের চারপাশে যে তর্ক, তীব্রতা ও তত্ত্ব-রাজনীতি জড়িয়ে পড়েছে, তা কেবল কোনো দলের প্রতীক চাওয়ার কাহিনি নয়- এটি রাষ্ট্রের প্রতীক ব্যবহারের নৈতিক সীমানা, সাংবিধানিক সংযম এবং রাজনৈতিক রুচির এক সম্মিলিত পরীক্ষা।

প্রতীকের দার্শনিক ব্যাখ্যা : প্রতীক রাজনীতিতে যেমন পরিচয়ের বাহন, তেমনি গণমনে আস্থার ভরসাও। কোনো প্রতীক যখন দলীয় পতাকার মতো জাতিসত্তার সঙ্গে মিলিত হয়, তখন সেটি এক ধরনের আবেগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে ভোটারদের বড় অংশ এখনও প্রতীককেন্দ্রিক- দলের নাম নয়, তারা ভোট দেয় ‘ধানের শীষ’, ‘নৌকা’, ‘লাঙল’ বা ‘ট্রাক’-এ। তবে এই প্রতীকগুলোর গভীরে থাকে দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস, আদর্শের চিহ্ন এবং ক্ষমতার বীজ। একজন বিশ্লেষকের ভাষায়- প্রতীক হচ্ছে সেই নীরব ভাষা, যার মাধ্যমে রাজনীতি জনগণের সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু যখন সেই ভাষা নিয়ে লড়াই শুরু হয়, তখন রাজনীতি আর জনতার মধ্যকার সম্পর্ক রূপ নেয় এক প্রকার বিশ্বাসঘাতকতায়।

শাপলা বিতর্কের সাংবিধানিক পরিধি : বাংলাদেশের সংবিধান প্রতীকের মর্যাদা নিয়ে নির্দিষ্ট বিধান রেখেছে। রাষ্ট্রীয় প্রতীক হিসেবে ‘পানিতে ভাসমান শাপলা’ কেবল একটি ফুল নয়, এটি মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশের পুনর্জাগরণের প্রতীক- জাতীয় জীবনের এক বিমূর্ত রূপ। এই প্রতীকের চারপাশে ধানের শীষ, পাটগাছের পাতা ও তারকা মিলিত হয়ে তৈরি করেছে জাতির ভিজ্যুয়াল পরিচয়, যার মধ্যে নিহিত আছে উৎপাদন, শ্রম, স্বপ্ন ও শান্তির প্রতীকী অনুষঙ্গ। অতএব, কোনো রাজনৈতিক দল যদি এই জাতীয় প্রতীককে নিজের দলীয় পরিচয়ে রূপ দিতে চায়, সেটি কেবল প্রশাসনিক আপত্তির বিষয় নয়- এটি এক ধরনের সাংবিধানিক অবমাননা এবং জাতীয় প্রতীক আত্মসাতের প্রচেষ্টা। তবু নতুন প্রজন্মের দল এনসিপি যখন ঘোষণা দেয়, ‘শাপলাই চাই, অন্য কিছু নয়,’ তখন বিষয়টি কেবল প্রতীকের দাবিতে সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি পরিণত হয় প্রতীকী প্রতিরোধে। এনসিপি মনে করে, জাতীয় প্রতীক ব্যবহারে কোনো আইনগত বাধা নেই- এ এক রাজনৈতিক কৌশল, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের ‘জাতীয়তাবাদী উত্তরাধিকার’-এর দাবিদার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু এই অবস্থান রাষ্ট্রীয় প্রতীককে দলীয় সীমানায় টেনে আনার এক বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত তৈরি করছে।

ধানের শীষ ও লাঙলের ঐতিহাসিক আবর্ত : বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধানের শীষ যেমন ক্ষমতার রূপক, তেমনি লাঙল ইতিহাসের কৃষিজীবী সমাজের প্রতীক। ধানের শীষ এক সময় ভাসানী ন্যাপের হাতে ছিল- একটি আন্দোলননির্ভর দল, যারা জাতীয়তাবাদের আদর্শিক কাঠামো তৈরি করেছিল। স্বাধীনতার পর এই প্রতীক চলে যায় বিএনপির হাতে, জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক পুনর্গঠনের হাত ধরে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শীষ হয়ে ওঠে বিরোধিতার প্রতীক, আপসহীনতার ভাষা। অন্যদিকে, লাঙল- যা একদা শেরেবাংলা ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির পরিচায়ক ছিল- এরশাদের হাতে এসে হয়ে যায় জাতীয় পার্টির প্রতীক। কৃষক রাজনীতির ঐতিহ্য বদলে তা রূপ নেয় ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রতীকে। এখন যখন জাতীয় লীগ দাবি করছে, লাঙল তাদের ঐতিহ্যগত সম্পদ, তখন বিষয়টি শুধু প্রতীক পুনরুদ্ধারের নয়- এটি রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের বৈধতা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নও। এই দ্বন্দ্বগুলো আসলে প্রতীকের সীমারেখায় দলীয় ইতিহাসের সংঘর্ষকেই প্রতিফলিত করে- যেখানে প্রতীক শুধু পরিচয়ের বাহন নয়, বরং ইতিহাসের স্মারক হয়ে ওঠে।

প্রতীকের মালিকানা ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা : বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন ২০০৮ সালে দলীয় নিবন্ধন পদ্ধতি চালু করে। সেই থেকে প্রতীক হয়ে ওঠে দলীয় স্বত্বাধিকারভুক্ত একটি আইনি সম্পদ। একবার কোনো প্রতীক বরাদ্দ হলে, সেটি অন্য দলের জন্য উন্মুক্ত থাকে না। তবে এই নিয়মের আগে প্রতীক ব্যবহারে কোনো বাধা না থাকায় ইতিহাসে দেখা গেছে, একই প্রতীক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দলের হাতে ঘুরে বেড়িয়েছে- আনারস, বাইসাইকেল, গোলাপ ফুল কিংবা ধানের শীষ- সবই কখনও না কখনও অন্য দলের পক্ষে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু আধুনিক রাজনীতিতে প্রতীকের এই ঘুরপাক আর সহজ নয়। এখন এটি এক ধরনের আইনি একচেটিয়া অধিকার।

সুতরাং, এনসিপি যখন দাবি তোলে যে নির্বাচন কমিশন ‘ইচ্ছাকৃতভাবে শাপলাকে প্রতীকের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেনি,’ তখন তারা আসলে এই আইনি প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তবে নির্বাচন কমিশনেরও দায়িত্ব ছিল শুরু থেকেই বিষয়টি স্বচ্ছভাবে ব্যাখ্যা করা- জাতীয় প্রতীক কোনো দলের প্রতীক হতে পারবে না, এই নীতিগত অবস্থান যদি স্পষ্টভাবে জানানো হতো, তাহলে বিতর্কটি এই পর্যায়ে আসত না। আজ ইসিকে কেবল প্রশাসনিক সংস্থা নয়, বরং গণতন্ত্রের প্রতীকী ন্যায্যতার রক্ষাকবচ হিসেবে দেখা হচ্ছে। তার সিদ্ধান্ত যদি স্বচ্ছতার ঘাটতিতে ভোগে, তাহলে তা শুধু এক দলের নয়, পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট করে।

প্রতীক ও জনপ্রিয়তার ভ্রান্ত ধারণা : রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই মনে করে প্রতীকই জনপ্রিয়তার মূল উৎস। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। প্রতীকের সৌন্দর্য বা জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গে তার মিল দলকে জনপ্রিয় করে তোলে না। উদাহরণস্বরূপ, গোলাপ ফুলের মতো নান্দনিক প্রতীক ধারণ করেও কোনো দল জাতীয় রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। কারণ ভোটাররা শেষ পর্যন্ত দল নয়, বিশ্বাসযোগ্যতা, আদর্শ ও নেতৃত্বকেই বিচার করে। তবু প্রতীকের প্রতি অতিরিক্ত অনুরাগ এক ধরনের রাজনৈতিক মনোবিকার সৃষ্টি করে- যেখানে প্রতীকই হয়ে ওঠে অস্তিত্বের একমাত্র প্রমাণ, আর আদর্শ, নীতি, কর্মসূচি হয়ে পড়ে গৌণ। এনসিপি যে দৃঢ়ভাবে বলছে ‘শাপলা না পেলে আন্দোলন,’ সেটি প্রতীকের প্রতি অতি-নির্ভরতারই প্রতিফলন।

প্রতীক রাজনীতি বনাম আদর্শ রাজনীতি : বাংলাদেশের রাজনীতি ক্রমে প্রতীকের রাজনীতিতে পরিণত হচ্ছে। একদিকে নৌকা, অন্যদিকে ধানের শীষ ইত্যাদি- এই প্রতীকবাদের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে বাস্তব রাজনৈতিক কর্মসূচি, নৈতিকতা ও আদর্শ। নতুন প্রজন্মের দলগুলো, বিশেষ করে এনসিপির মতো সংগঠনগুলো, যদি একই পথ অনুসরণ করে, তবে তাদের ভবিষ্যৎও হবে পুরনো দলগুলোর প্রতীকী ছায়ার পুনরাবৃত্তি।

রাজনীতির ইতিহাসে দেখা গেছে, প্রতীক তখনই শক্তিশালী হয় যখন সেটি জনমানসে নির্দিষ্ট কোনো মূল্যবোধ বা সংগ্রামী অর্থ বহন করে। ধানের শীষ টিকে গেছে কারণ এটি এক সময় স্বৈরাচারবিরোধী প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছিল; লাঙল টিকে গেছে কারণ এটি কৃষক রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। শাপলা যদি সত্যিই জনগণের হৃদয়ে জায়গা করতে চায়, তাহলে সেটিকে প্রতীকের সৌন্দর্য নয়, রাজনৈতিক দর্শনের প্রতীক হিসেবে দাঁড় করাতে হবে।

জাতীয় প্রতীকের পবিত্রতা ও রাজনৈতিক দায়িত্ব : রাষ্ট্রের প্রতীক হলো জাতির অভিন্ন ঐক্যের প্রতীক। এটি কোনো দল, মত বা ব্যক্তির সম্পত্তি নয়। জাতীয় প্রতীকের সঙ্গে দলীয় প্রতীকের সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠ হয়, রাষ্ট্রীয় পরিচয় তত বিভক্ত হয়ে পড়ে। ইতিহাসে আমরা দেখেছি, রাষ্ট্রীয় প্রতীককে দলীয় সীমানায় টেনে আনা মানেই জাতীয় চেতনাকে সংকুচিত করা। এমন উদাহরণ পাকিস্তানের রাজনীতিতে যেমন দেখা গেছে- চাঁদণ্ডতারা প্রতীকের অপব্যবহার এক সময় ধর্মীয় একচ্ছত্রতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল- তেমনি ভারতের কিছু আঞ্চলিক রাজনীতিতেও জাতীয় প্রতীককে দলীয় প্রচারণার অংশ বানানো হয়েছে, যার ফলাফল হয়েছে সাংবিধানিক সংকট। বাংলাদেশে শাপলাকে কেন্দ্র করে যদি একই ধরনের প্রতীকি রাজনীতি শুরু হয়, তবে এটি ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত তৈরি করবে। কারণ একবার জাতীয় প্রতীক দলীয় প্রতীকে পরিণত হলে, রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতার নৈতিক ভিত্তি নষ্ট হয়।

প্রতীক ও গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা : গণতন্ত্রের সৌন্দর্য প্রতীকের বৈচিত্র্যে নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ন্যায্যতায়। যে দেশে প্রতীকের জন্য আন্দোলন হয়, অথচ আদর্শ ও কর্মসূচি অনুপস্থিত থাকে, সেই দেশে গণতন্ত্র কেবল আনুষ্ঠানিকতার রূপ নেয়।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কলামিস্ট, রংপুর