আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে

মো. নূর হামজা পিয়াস

প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ পরিবেশ, নির্বাচনকালীন স্থিতিশীলতা এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা সবই নির্ভর করে সুসংহত আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার ওপর। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অপরাধের ধরন ও প্রবণতা দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে। সাইবার অপরাধ, মাদক পাচার, কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি, চাঁদাবাজি ও অনলাইন প্রতারণা সব মিলিয়ে সমাজে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করছে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত এক বছরে অপরাধের সংখ্যা ১৮ শতাংশ বেড়েছে, যা সরকারের জন্য সতর্ক সংকেত।

এক সময় দেশের আইনশৃঙ্খলা সমস্যা সীমাবদ্ধ ছিল ডাকাতি, খুন বা চুরি পর্যন্ত। কিন্তু এখন অপরাধের ধরণ বদলে গেছে। প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে সাইবার অপরাধ, ডিজিটাল প্রতারণা ও ভুয়া তথ্য প্রচারের মতো অপরাধ বেড়ে গেছে বহুগুণে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এই নতুন ধরনের অপরাধ মোকাবিলায় সক্ষম হতে হচ্ছে। অপরাধীরা এখন স্মার্টফোন, এনক্রিপটেড অ্যাপ, ডিজিটাল মুদ্রা ও অনলাইন লেনদেনের মাধ্যমে অপরাধ পরিচালনা করছে। ফলে অপরাধ দমন কৌশলেও আধুনিকায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর সীমান্ত অপরাধের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। মাদক পাচার, অস্ত্র চোরাচালান, মানব পাচার এবং অবৈধ অনুপ্রবেশের মতো আন্তঃসীমান্ত অপরাধ অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি) সক্রিয় থাকলেও, দীর্ঘ ও অরক্ষিত সীমান্তের কিছু অংশ অপরাধীদের জন্য সহজ করিডোর হিসেবে কাজ করে। এই অপরাধগুলো অভ্যন্তরীণ অপরাধ চক্রকে অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করে শক্তিশালী করে তোলে।

একটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যত দৃঢ়, তার আইনশৃঙ্খলাও তত সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে যায়। নির্বাচনের আগে বা পরবর্তী সময়ে সহিংসতা, সংঘর্ষ, মিছিল-মিটিং এবং গুজব ছড়ানো এই পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তোলে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসে দেশের বিভিন্ন জেলায় ৪০০টির বেশি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। এতে প্রাণহানি ঘটেছে ৩২ জনের, আহত হয়েছে ৪০০ জনেরও বেশি। এসব ঘটনা ইঙ্গিত দেয় যে রাজনৈতিক সমঝোতা না থাকলে সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মূল শক্তি শুধু প্রশাসন নয়, জনগণও এর একটি অপরিহার্য অংশ। যদি জনগণ সচেতন ও সহযোগিতাপূর্ণ হয়, তবে অপরাধীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। গ্রামের চৌকিদার ব্যবস্থা, শহরের কমিউনিটি পুলিশিং, পাড়া-মহল্লায় সচেতনতামূলক সভা এসব উদ্যোগ অপরাধ কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। পুলিশ সদর দপ্তরের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, যেখানে জনগণের অংশগ্রহণ বেশি, সেখানে অপরাধের হার ২৭ শতাংশ কম।

সুতরাং রাষ্ট্রের উচিত জনগণকে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার অংশীদার হিসেবে যুক্ত করা।

বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রশাসনিক সংস্থা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ডিবি, কোস্টগার্ড ও গোয়েন্দা বিভাগ। কিন্তু তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব প্রায়ই দেখা যায়। অনেক সময় একই ঘটনার তদন্ত একাধিক সংস্থা করে, ফলে জটিলতা তৈরি হয়। তাই কার্যকর সমন্বয় প্রক্রিয়া গড়ে তোলা এখন জরুরি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে গঠিত নিরাপত্তা বিশ্লেষণ টাস্কফোর্সকে আরও সক্রিয় করতে হবে, যাতে মাঠপর্যায়ে নির্দেশনাগুলো দ্রুত বাস্তবায়িত হয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে অপরাধ তথ্য বিশ্লেষণ (Crime Data Analysis) একটি অপরিহার্য হাতিয়ার। বাংলাদেশে এখনও অনেক থানার অপরাধের তথ্য ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়, যেখানে আধুনিক ডেটা অ্যানালিটিক্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করা হচ্ছে না। অপরাধের প্রবণতা, সময় ও স্থানের ভিত্তিতে তথ্য বিশ্লেষণ করে ‘ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা কৌশল’ (Predictive Policing) তৈরি করা সম্ভব। ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতিটি থানাকে একটি ডিজিটাল ডেটাবেসের আওতায় এনে তথ্যভিত্তিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ বাড়লেও, অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাইবার নিরাপত্তা জ্ঞান এবং ডিজিটাল প্রমাণ সংগ্রহের দক্ষতা সীমিত। সাইবার অপরাধের মামলাগুলোতে ফরেনসিক বিশ্লেষণ, ডিজিটাল ডেটা পুনরুদ্ধার এবং অপরাধীদের এনক্রিপশন ভাঙার সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। ফলে অনেক অপরাধী প্রমাণ না থাকার কারণে সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়। সাইবার ফরেনসিক ল্যাবগুলোর আধুনিকায়ন, বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক সাইবার নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা জরুরি।

বেসরকারি খাত এবং করপোরেট নিরাপত্তা এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, শিল্প কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ এবং হ্যাকিংয়ের মতো ঘটনাগুলো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত হবে বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরাপত্তা সংক্রান্ত পরামর্শ প্রদান করা এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগের একটি শক্তিশালী চ্যানেল তৈরি করা। কর্পোরেট নিরাপত্তা জোরদার হলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিবেশ উন্নত হবে এবং জাতীয় অর্থনীতি সুরক্ষিত থাকবে।

একটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিনির্ভর করে ব্যবসায়িক পরিবেশের স্থিতিশীলতার ওপর। আইনশৃঙ্খলা দুর্বল হলে বিনিয়োগকারীরা ভয় পায়, বিদেশি বিনিয়োগ কমে যায়, কর্মসংস্থান হ্রাস পায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৫ সালের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, আইনশৃঙ্খলার অস্থিরতার কারণে গত বছরে বেসরকারি বিনিয়োগ ১২ শতাংশ কমেছে। সুতরাং আইনশৃঙ্খলা শুধু নিরাপত্তার বিষয় নয়, এটি অর্থনৈতিক উন্নয়নেরও মূল শর্ত।

বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের বিস্তার।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে, একটি ভুয়া খবরই কখনও কখনও সহিংসতা বা বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়। ২০২৫ সালের জুন মাসে একটি ভুয়া ধর্মীয় গুজবের কারণে খুলনায় সংঘর্ষে আহত হয় ৩৫ জন। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাইবার নিরাপত্তা বিভাগকে আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। পাশাপাশি জনগণকে অনলাইন সচেতনতা শিক্ষা দিতে হবে, যাতে তারা তথ্য যাচাই না করে কিছু বিশ্বাস না করে।

বাংলাদেশ পুলিশ, র‌্যাব ও অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি। তাদের আধুনিক সরঞ্জাম, ফরেনসিক ল্যাব, সাইবার সিকিউরিটি ইউনিট এবং মাঠপর্যায়ের প্রশিক্ষণ আরও উন্নত করতে হবে। ২০২৫ সালের মার্চে প্রকাশিত পুলিশ রিফর্ম কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৩টি জেলাতেই এখনো প্রযুক্তিনির্ভর তদন্ত কাঠামো পুরোপুরি চালু হয়নি। এই সীমাবদ্ধতা কাটাতে হলে বাজেট বাড়ানো, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে।

দেশের কারাগারগুলোর ব্যবস্থাপনা এবং অপরাধীর পুনর্বাসনের দিকে নজর দেওয়া জরুরি। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত ভিড়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং অপরাধীদের মধ্যে নতুন নেটওয়ার্ক তৈরি হওয়ার সুযোগ কারাগারকে অপরাধের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পরিণত করছে। অনেক সময় কারাগার থেকেই অপরাধীরা বাইরে সিন্ডিকেট পরিচালনা করে। কারাগার আধুনিকায়ন, বন্দীদের জন্য কারিগরি ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা এবং মানসিক পুনর্বাসন কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কেবল বাহিনীর দায়িত্ব নয়, এটি রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছার ওপরও নির্ভর করে। দুর্নীতি, দলীয় প্রভাব বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা অপরাধ দমনে বড় বাধা। যদি প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে না পারে, তাহলে অপরাধীরা উৎসাহিত হয়। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। জনগণকে বুঝতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা মানে সরকারের পক্ষ নেওয়া নয়, বরং রাষ্ট্র ও সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখা।

অপরাধ দমন কার্যকর করতে হলে বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর বিচার শেষ হতে বছরের পর বছর লেগে যায়। এতে অপরাধীরা আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে পার পেয়ে যায়। ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৩৫ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালগুলোকে সক্রিয় করে মামলা নিষ্পত্তির সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে। বিচারপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ফিরলে অপরাধের হার স্বাভাবিকভাবেই কমে আসবে।

ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে ট্রাফিক আইন অমান্য ও সড়কের বিশৃঙ্খলা এক ধরনের দৈনন্দিন নৈরাজ্য তৈরি করেছে। এটি একদিকে যেমন দুর্ঘটনার হার বাড়ায়, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে আইন অমান্যের প্রবণতা জন্ম দেয়। ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ও নিয়মিত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিলে সমাজে আইন ভাঙার সংস্কৃতি দৃঢ় হয়।

তরুণদের মধ্যে কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি ও মাদকাসক্তি এখন বড় সামাজিক সংকটে পরিণত হয়েছে। চাকরির অভাব, পরিবারে নজরদারির ঘাটতি এবং সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে এই সমস্যাটি ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। ২০২৫ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু রাজধানীতেই ১২০টির বেশি কিশোর গ্যাং সক্রিয়। তরুণ সমাজকে অপরাধের বাইরে রাখতে হলে খেলাধুলা, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও নৈতিকতা চর্চাকে গুরুত্ব দিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার অংশ হিসেবে যুব উন্নয়ন কার্যক্রম বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অপরাধের জন্য অবশ্যই কঠোর শাস্তির বিধান আছে। বাংলাদেশে মূলত দণ্ডবিধি ১৮৬০, অস্ত্র আইন ১৮৭৮ এবং সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩-এর মতো আইনগুলো ব্যবহার করা হয়। খুন, ডাকাতি, চাঁদাবাজির মতো সাধারণ অপরাধে কারাদণ্ড থেকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত শাস্তি নির্ধারিত। সাইবার অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছর কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড-এর বিধান রয়েছে।

তবে, এই আইনগুলোর প্রয়োগে দুর্বলতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক প্রভাব, সাক্ষী ও প্রমাণের অভাব এবং প্রশাসনের কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতির কারণে অপরাধীরা প্রায়শই সহজে পার পেয়ে যায়, ফলে আইনের কার্যকর প্রয়োগ সীমিত হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতার মূলে শুধু প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক সমস্যা নয়, জনগণের মানসিক দুর্বলতা ও আইনের প্রতি উদাসীনতাও অনেকাংশে দায়ী। বেশিরভাগ নাগরিক ক্ষুদ্র দুর্নীতি (যেমন: ট্রাফিক আইন অমান্য করা, সামান্য ঘুষ দেওয়া) বা অনিয়মকে দৈনন্দিন জীবনের অংশ হিসেবে মেনে নিয়েছেন। তারা তাৎক্ষণিক সুবিধা পেতে আইন ভাঙতে দ্বিধা করেন না। ফলে, সমাজে এক ধরনের ‘আইন-অমান্যের সংস্কৃতি’ গেড়ে বসেছে, যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজকে আরও কঠিন করে তোলে। এই মানসিকতা পরিবর্তন করতে হলে প্রাথমিক স্তর থেকে নৈতিক শিক্ষা ও নাগরিক দায়িত্ববোধ নিশ্চিত করা জরুরি। ব্যক্তিগত সচেতনতা ও সম্মিলিত প্রতিবাদই আইনের শাসন ফিরিয়ে আনার প্রথম ধাপ।

বাংলাদেশ একটি বহু ধর্ম ও সংস্কৃতির দেশ। এখানে সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষা করা আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার মূল উপাদান। ধর্মীয় উসকানি বা গুজবের মাধ্যমে সমাজে বিভাজন তৈরি করা হলে আইনশৃঙ্খলা দ্রুত ভেঙে পড়ে। ২০২৫ সালে রমজান মাসে ভুয়া সামাজিক মিডিয়া পোস্টের কারণে দেশের তিনটি জেলায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। তাই ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায় প্রশাসনের পাশাপাশি সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। গণমাধ্যম আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভুয়া তথ্যের বিপরীতে সত্য তথ্য তুলে ধরা, জনসচেতনতা তৈরি করা এবং অপরাধের মূল কারণ উদ্ঘাটন করা এসব ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা অপরিহার্য। ২০২৫ সালের তথ্যমন্ত্রণালয়ের গবেষণা অনুযায়ী, দায়িত্বশীল সংবাদ পরিবেশন অপরাধ দমনে অন্তত ১৫ শতাংশ ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই রাষ্ট্রের উচিত হবে স্বাধীন সাংবাদিকতা নিশ্চিত করা এবং গণমাধ্যমকে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা প্রদান করা।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার জন্য প্রয়োজন সমন্বিত ও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম এবং জনগণ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শুধু কঠোর আইন নয়, সমাজে নৈতিকতা, শিক্ষা ও নাগরিক দায়িত্ববোধও জাগ্রত করতে হবে। আমরা যদি আইনের শাসনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিই, তাহলে কেবল অপরাধ দমনই নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে জনগণের আস্থা ও অংশগ্রহণই হবে স্থায়ী শান্তির ভিত্তি।

লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ