উত্তম খাদ্য ও টেকসই ভবিষ্যতের দিগন্তে

এসএম হাসানুজ্জামান

প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

খাদ্য শুধুমাত্র আমাদের দৈনন্দিন ক্ষুধা মেটানোর মাধ্যম নয়; এটি মানবজীবনের দীর্ঘমেয়াদি সুস্থতা, জ্ঞান, উৎপাদনশীলতা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার এক অপরিসীম বিনিয়োগ। খাদ্যের সঙ্গে আমাদের জীবনযাত্রা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং পরিবেশ গভীরভাবে সংযুক্ত। ‘হাতে হাত রেখে, উত্তম খাদ্য ও উন্নত ভবিষ্যতের দিকে’- এই বছরের প্রতিপাদ্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, একক প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়; বৈশ্বিক সহযোগিতা, সমন্বিত নীতি, প্রযুক্তিনির্ভর উদ্ভাবন এবং সামাজিক সচেতনতার সমন্বয়ে একটি টেকসই খাদ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন।

শুধু উৎপাদন বৃদ্ধি করলেই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না; খাদ্যের পুষ্টি, মান, দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য উপকারিতা এবং সুষম খাদ্য গ্রহণের নিশ্চয়তাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই বাস্তবতা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ভিন্ন আকারে প্রতিফলিত হচ্ছে।

বৈশ্বিক খাদ্য পরিস্থিতি ও উদ্বেগের মিছিল : জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে প্রায় ৬৭ কোটি মানুষ পর্যাপ্ত খাদ্য না পেয়ে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ছিল। আফ্রিকায় প্রতি পাঁচজনের একজন ক্ষুধার্ত, যা প্রায় ৩০ কোটি মানুষকে প্রভাবিত করছে। পশ্চিম এশিয়ায় প্রায় চার কোটি মানুষ এখনও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রায় ৩২ কোটি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছেন। লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলেও কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তবে বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ এখনো অপরিসীম।

খাদ্যের অভাবে শিশুদের পুষ্টির ঘাটতি, নারী ও শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর শারীরিক দুর্বলতা এবং স্বাস্থ্য ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এই পরিস্থিতি শুধু খাদ্যশৃঙ্খলের সমস্যাই নয়; এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও একটি গভীর হুমকি। ক্ষুধার্ত সমাজে শিক্ষার মান হ্রাস, কর্মক্ষমতা কমে, এবং দারিদ্র্য ও অসাম্য ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। বৈশ্বিক সহযোগিতা, কার্যকর নীতি এবং প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান এই সংকট মোকাবিলার একমাত্র উপায়।

আইপিসিসি-এর প্যারিস প্রতিবেদন সতর্ক করে বলছে, বর্তমান কৃষি উৎপাদন ও পরিবেশগত প্রবণতা বজায় থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন প্রায় ২০ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। এই হ্রাস শুধু খাদ্যের অভাবই নয়, স্বল্প-পুষ্টিকর ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণের প্রবণতাকেও বাড়াবে, যা দীর্ঘমেয়াদে মানব স্বাস্থ্য ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।

বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা, চ্যালেঞ্জ ও অগ্রগতি : বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তানির্ভর করছে প্রধানত কৃষি উৎপাদন, পশুপালন, মৎস্য চাষ এবং সুষম বণ্টনের ওপর। ২০২৩ সালে দানাদার খাদ্য উৎপাদন প্রায় ৬ কোটি ৪৩ লাখ মেট্রিক টন, যার মধ্যে ধান ৫ কোটি ৮৬ লাখ টন। বোরো মৌসুমে উৎপাদন ছিল ২ কোটি ১০ লাখ টন, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কিছুটা কম। তবে শুধুমাত্র উৎপাদন বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়; খাদ্যের পুষ্টিগুণ নিশ্চিত করা, বিশেষত শিশু ও নারী জনগোষ্ঠীর জন্য, সমান গুরুত্বপূর্ণ।

দেশে প্রায় পাঁচ কোটি গবাদিপশু রয়েছে, যা দুধ ও মাংস উৎপাদনের মূল উৎস। ২০২৩-২৪ সালে দেশীয় দুধের উৎপাদন প্রায় ১২.৫ মিলিয়ন টন এবং মাংসের উৎপাদন প্রায় ৩.২ মিলিয়ন টন। সঠিক লালন-পালন এবং খাদ্য সুষমতা নিশ্চিত করলে দেশের প্রোটিনের চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ সম্ভব।

মৎস্য উৎপাদনও বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ২০২৪ সালে দেশীয় মৎস্য উৎপাদন প্রায় ৪.৭ মিলিয়ন টন, যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ জলাশয় থেকে ২.৫ মিলিয়ন টন এবং সমুদ্রপথ থেকে ২.২ মিলিয়ন টন আহরণ করা হয়েছে। মৎস্য ও সবজি রপ্তানিও বৃদ্ধি পেয়েছে; ২০২৪-২৫ সালে প্রায় ৫৮ হাজার মেট্রিক টন, যা আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ বৃদ্ধি।

খাদ্য নিরাপত্তা শুধু পরিমাণের বিষয় নয়; সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য নিশ্চিত করাও সমান জরুরি। শিশুদের ভিটামিন, খনিজ ও প্রোটিনের অভাব দূর করতে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের নিশ্চয়তা অপরিহার্য। এছাড়া, নারীদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্য রক্ষা করতে প্রয়োজন সচেতন খাদ্যাভ্যাস এবং সমন্বিত খাদ্যনীতি।

তরুণ প্রজন্ম ও কৃষি, একটি অপরিহার্য সংযোগ : বাংলাদেশে ১৫-২৯ বছর বয়সীদের প্রায় পৌনে পাঁচ কোটি এবং সম্প্রতি প্রায় ১৭-২০ শতাংশ তরুণ কৃষি বা খামারে কাজ করছেন। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তরুণদের কৃষিতে সম্পৃক্ত করা অপরিহার্য। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, উদ্ভাবনী চাষাবাদ এবং স্থায়ী কৃষিকৌশল গ্রহণ করে তরুণরা খাদ্য উৎপাদন ও পুষ্টিমূল্য বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সচেতনতার বৃদ্ধির কারণে কার্যকর খাদ্যের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৪ সালে এর বাজারমূল্য প্রায় ২৪৬ বিলিয়ন ডলার, যা ২০৩৩ সালের মধ্যে দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে। অর্থাৎ খাদ্য উৎপাদন, পুষ্টি এবং বাজারের চাহিদা- এই তিনটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে তরুণদের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত : বর্তমান বিশ্বে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের ভূমিকা অপরিসীম।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা, উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি পুষ্টি নিশ্চিত করা, এবং খাদ্য অপচয় হ্রাসের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি অন্যতম উপায়। উদ্ভাবনী কৃষিকৌশল, ডিজিটাল ফার্মিং, স্যাটেলাইট ও ড্রোন প্রযুক্তি, এবং বৈজ্ঞানিক বীজ ও সার ব্যবহার করে উৎপাদন ও পুষ্টি মান উন্নয়ন করা সম্ভব।

বৈশ্বিকভাবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার, বেসরকারি খাত, নাগরিক সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ অপরিহার্য। খাদ্য নীতি প্রণয়ন, লজিস্টিক ও সরবরাহ চেইনের উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি সম্প্রসারণের মাধ্যমে শুধু উৎপাদন নয়, সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব।

পুষ্টি সচেতনতা ও সামাজিক অবকাঠামো : খাদ্য নিরাপত্তা শুধুমাত্র খাদ্য উৎপাদনের বিষয় নয়; এটি সামাজিক অবকাঠামো, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। পুষ্টিসচেতনতা বৃদ্ধি, খাদ্যজনিত রোগ প্রতিরোধ, এবং শিশুর সম্পূর্ণ পুষ্টি নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সম্প্রসারিত স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা কর্মসূচি এবং খাদ্য সম্প্রসারণ নীতি। বিশেষ করে, নারী ও শিশুদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে শিক্ষিত মা, সচেতন পরিবার এবং সক্রিয় সামাজিক নীতি অপরিহার্য।

কৃষি ও পরিবেশের ভারসাম্য : খাদ্য উৎপাদন এবং পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা না করলে খাদ্য নিরাপত্তা টেকসই হবে না। অতিরিক্ত রাসায়নিক সার, অযথা পানি ব্যবহার এবং অব্যবস্থাপনার কারণে মাটি ও জলাশয়ের উর্বরতা হ্রাস পায়। পরিবেশবান্ধব কৃষি, জৈবসার ব্যবহার এবং পানি সংরক্ষণী চাষাবাদ নিশ্চিত করলে দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য উৎপাদন এবং পুষ্টি বৃদ্ধি সম্ভব।

সাম্প্রতিক উদাহরণ ও প্রভাব : বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ও পুষ্টি পরিস্থিতি এভাবে ধারাবাহিকভাবে উন্নয়নশীল হলেও, বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের প্রভাব এড়ানো যায় না। বিশ্ববাজারে খাদ্যের দাম বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা- সবই চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থিত। এই প্রেক্ষাপটে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি সমন্বিত ও বৈশ্বিক কৌশল গ্রহণ জরুরি।

হাতে হাত রেখে, উত্তম খাদ্য ও উন্নত ভবিষ্যতের দিকে : বিশ্ব খাদ্য দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে খাদ্য শুধু মানব জীবনের অপরিহার্য অংশ নয়; এটি সামাজিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পরিবেশের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। শুধু উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল নীতি যথেষ্ট নয়; খাদ্যের পুষ্টি, স্বাস্থ্যকরতা, সুষমতা, এবং দীর্ঘমেয়াদী টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা সমান গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য দরকার সমন্বিত নীতি, তরুণদের সম্পৃক্ততা, প্রযুক্তিনির্ভর উদ্ভাবন এবং সামাজিক সচেতনতা। বৈশ্বিক সহযোগিতা, পরিবেশ-সচেতন কৃষি এবং পুষ্টিসচেতন নীতি গ্রহণের মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে, প্রতিটি মানুষ- চাই সে শহরে হোক বা গ্রামে- স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে সক্ষম হবে।

খাদ্য উৎপাদন, পুষ্টি এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে আমরা একটি টেকসই, স্বাস্থ্যসম্মত এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি। এই লক্ষ্য অর্জনে রাষ্ট্র, জনগণ, বিজ্ঞানী এবং তরুণ প্রজন্ম- সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। ১৬ অক্টোবরের এই দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, হাতে হাত রেখে আমরা একটি উত্তম খাদ্য ও উন্নত ভবিষ্যতের দিকে এগোতে পারি।

খাদ্য নেই, জীবন নেই- এটি শুধু স্লোগান নয়, এক গভীর বাস্তবতা। আমাদের প্রত্যেকের সচেতনতা, সামাজিক নীতি এবং প্রযুক্তিনির্ভর উদ্ভাবনই পারে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে মানবতার দীর্ঘমেয়াদি সুস্থতা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে। আজকের বিশ্ব খাদ্য দিবস আমাদের শপথ করায়- কোনো মানুষ ক্ষুধার্ত থাকবে না, কোনো শিশু অপুষ্টিতে ভুগবে না এবং কোনো নারী স্বাস্থ্যহীন জীবনের শিকার হবে না।

হাতে হাত রেখে, উত্তম খাদ্য ও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে- এটি আমাদের সংগ্রাম, আমাদের প্রতিজ্ঞা এবং আমাদের দায়িত্ব।

এসএম হাসানুজ্জামান

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কলাম লেখক, রংপুর