চাঁদাবাজের আস্ফালনে আমাদের করণীয়

ড. মো. আনোয়ার হোসেন

প্রকাশ : ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দেশব্যাপী চাঁদাবাজদের আস্ফালন দৃশ্যমান। চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। প্রতিটি পণ্যবাহী ট্রাক থেকে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে নেওয়া হচ্ছে আরও বেশি। পরিবেশ এতই ভয়াবহ যে, চাঁদা না পেলে মারপিট করা হচ্ছে, এমনকি হুমকি দেওয়া হচ্ছে প্রাণনাশেরও। অনেক ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে পরিবার হতে মুক্তিপণ আদায় করার ঘটনাও ঘটছে। চাঁদাবাজরা লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করছে। ক্ষেত্র বিশেষে আগ্নেয়াস্ত্র ও তাদের হাতে স্থান পাচ্ছে। গণমাধ্যমের বদান্যতায় নতুন দিনের চাঁদা সৈনিকদের সফলতা দেখে আমি বিস্মিত। বোঝাই যাচ্ছে, ব্যবসায়ীরা বড় বিপদে পড়েছেন। ভোক্তা হিসেবে আমরা সবাই বিপদে। চাঁদাবাজির কারণে বাড়ছে অনেক ভোগ্যপণ্যের দাম। পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজির কারণে দ্রব্যমূল্য আরও বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক।

আমরা মুখে বলছি নতুন বাংলাদেশ অথচ সমাজের খারাপ বিষয়গুলো বহাল তবিয়তেই থেকে যাচ্ছে। খুবই দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, চাঁদাবাজরা যেন শপথ নিয়ে রেখেছে যে, বাংলাদেশে এক সরকার যাবে, আর এক সরকার আসবে; কিন্তু মানুষকে শান্তিতে থাকতে দেওয়া যাবে না। এই প্রতিপাদ্যকে মনে লালন করে তাদের মতো করে চাঁদাবাজি এগিয়ে নিয়ে যেতে যেন তারা বদ্ধপরিকর। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে- প্রকৃতি যেন শূন্যস্থান পছন্দ করে না। তাই এখন পলাতক চাঁদাবাজদের জায়গায় নব্যরা পুরোদমে কাজ করছে। তাদের পকেট পূর্ণতার করার যেন এখনই উপযুক্ত সময়। যার অংশবিশেষ এক সময় তাদের পূর্বসূরীরা করত। মনে হচ্ছে, লুকিয়ে থাকা চাঁদাবাজদের তিল তিল করে গড়ে তোলা চাঁদাবাজির দ্বিগুণ সুফল নব্য চাঁদাবাজরা ভোগ করছে। দেশজুড়ে চাঁদার বিস্তার করে তারা বিপুল আয় রোজগারের সুযোগ করে নিয়েছে।

এক সময় জনগণ ভেবেছিল নতুন বন্দোবস্তের পর ভালো কিছু হবে। কিন্তু দেশবাসীকে আশাহত করে নব্য চাঁদাবাজরা ‘বিকল্প’ হয়ে ঠিকই দাঁড়িয়ে গেছে। এ সময়ের চাঁদার সৈনিকরা যেন দুরন্ত চাঁদাবাজির পকেট ভরা নগদ টাকা নিয়ে দৈনিক বাড়ি ফেরে। ফুটপাতের এক দোকানির ভাষ্য মতে, নব্যরা এখন টং দোকান থেকেও ৬০০ টাকা চাঁদা নিচ্ছে। পরিস্থিতি সদৃশ মনে হচ্ছে, এখন দেশে চাঁন্দুয়াতের যুগ চলছে। এরইমধ্যে ব্র্যান্ড নিউরা যেন চাঁদা তোলাকে অনেকাংশে অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। পুরাতনরা পুলিশকে ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখালেও, অধুনারা চার গুণ শক্তি সঞ্চয় করেছে। এখন র‌্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর নাকের ডগায়ও দেদারসে চাঁদাবাজি করছে। পলাতকরা অনেক ক্ষেত্রে সিক্রেট চাঁদাবাজি করলেও, নব্যরা কয়েক ধাপ এগিয়ে যেন এখন ওপেন চাঁদাবাজি করছে। জনগণ ফিসফাস করছে যে- অনেক চাঁদাবাজ না কি চাঁদার টাকায় এ বছর বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স পেতে এরইমধ্যে কয়েক লাখ টাকা ট্যাক্সও দিয়েছে। শিগগিরই তারা বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্সও পেতে পারে।

সচেতন মহল মনে করেন এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ হবে জোর যার মুল্লুক তার, চাঁদাবাজদের জয় জয় কার। ভুক্তভোগীরা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন যে, এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই চাঁদাবাজরা দেশের পুরোদস্তর মালিক বনে যাবে। তখন তারা বলতে হবে না চাঁদা দাও, তখন বলবে ভাড়া দাও। ওয়াকিবল মহল পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করছেন যে, গ্রামে গঞ্জে অনেক ব্যক্তি একসময় সিএনজি বা অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। পটপরিবর্তন হওয়া মাত্রই কতক সিএনজি বা অটোরিকশা বিক্রি করে মোটরসাইকেল ক্রয় করেছে। এখন তারা গ্রামেগঞ্জে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। কেউ বা দেদারসে সরাসরি চাঁদাবাজি করছেন, অনেকে আবার তথ্য সংগ্রহ করে বড় চাঁদাবাজদের দিচ্ছেন। সফলভাবে চাঁদাবাজি সম্পন্ন হওয়ার পর কমিশন পাচ্ছেন। চাঁদাবাজির সঙ্গে কেউবা চুরি ডাকাতিতে নিয়োজিত হয়েছেন। প্রত্যন্ত এলাকায় গভীর রাতে তারা কয়েকটি বাড়িতে কাছাকাছি সময়ে হানা দিচ্ছেন। অনেকে চাঁদাবাজি, চুরি-ডাকাতির সঙ্গে মাদককারবারেও জড়িয়ে পরছেন। কেউবা এমনও বলছেন, পুরোনো চাঁদাবাজরা বেশ কয়েক মাস গর্তে লুকিয়ে থাকলেও এখন উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছে।

এমনও শোনা যাচ্ছে যে, দেশের কোনো কোনো স্থানে নব্য-পুরোনো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চাঁদাবাজিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন প্রান্তে শিগগিরই চাঁদাবাজিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ধার প্রান্তেও পৌঁছে গেছে। এরইমধ্যে চাঁদাবাজি অতীতের সব রেকর্ড ব্রেক করছে বলে মনে হচ্ছে। যা ব্যবসায়ীদের কে অধিক ভাবিয়ে তুলছে। সামাজিকমাধ্যমের কল্যাণে পরিস্থিতির নিরিখে মনে হচ্ছে চাঁদাবাজরা এদিক থেকেও সতর্ক যে, যাতে তাদের চক্ষু লজ্জা আবার না চলে আসে।

ওইদিন মিরপুরে এক চাঁদাবাজ নির্দ্বিধায় বলছেন যে, ব্যবসায়ীরা আমাদের কে দয়ালু হিসেবে জানে। কারণ অতীতে দোকানিরা এককালীন চাঁদা প্রদান করতে হতো। এখন আমরা কিস্তিতে চাঁদা আদায় করি। সে তথাকথিত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছিল যে, লোকে আমাদের তাচ্ছিল্য করে বলে আমরা নাকি পরিশ্রম নির্ভরজীবনধারণ করছি না। চাঁদা তোলা কি কম পরিশ্রম? যা আমাদের ভাবনায় বিষয়। এসব চাঁদাবাজদের অনেকের বিষয়ে লোকজন অতিষ্ঠ হয়ে তাচ্ছিল্য করে কানাকানি করছে, এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিলে। আপাত দৃষ্টিতে নব্যদের মনোবল এতটা চাঙা যে, এসবে তারা যেন কিঞ্চিতও ঘাবড়ে যায় না।

তারা একদমই মনে রাখে না যে, এখন যেমন তাদের পূর্বসূরীরা দৌড়ের ওপর আছে, তেমনি একদিন তাদেরও দৌড়ের ওপর থাকতে হবে। যদিও ইতিপূর্বে তারাও দৌড়ের উপর ছিল। তারা যেন এ দীক্ষা নিয়েছে যে, মানুষমাত্রই দৌড়বিদ। জনগণ এও বলাবলি করছে, নব্য চাঁদাবাজরা নাকি ছ্যাঁচড়া চাঁদাবাজ, কারণ এরা কাউকেই ছাড়ছে না। তাদের চাঁদাবাজিকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে যে, যেন আচিরেই চাঁদাবাজি হবে প্রতিটি গ্রাম-মহল্লা, বাড়ি-ঘর, এমনকি বাদ যাবে না একটি শিশুও।

অর্থাৎ চাঁদাবাজরা বাংলাদেশে এমন এক চাঁদাবাজির রাজত্ব কায়েম করেছেন, এ কারণে দেশে অরাজক অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। আমি এটা তো কিঞ্চিৎ বললাম। প্রকৃত চিত্র অধিক ভয়াবহ। বাস্তবতা হলো- চাঁদাবাজদের শেকড় অনেক গভীরে পৌঁছে গেছে। এসব চাঁদাবাজদের দেখাদেখি কিশোর গ্যাং-রাও চাঁদাবাজিতে আকৃষ্ট হচ্ছে। অনতিবিলম্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চাঁদাবাজি বন্ধ করতে সক্ষম না হলে, কিশোর গ্যাং-রাও অচিরেই বিরক্তির সঙ্গে বলবে এখন কৈশোর যার চাঁদাবাজির শ্রেষ্ঠ সময় তার। যা হবে এ জাতির জন্য অশনি সংকেত ভুক্তভোগীরা বলছেন, পুলিশ প্রশাসন নিষ্ক্রিয় থাকায় চাঁদাবাজরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

বিশেষ করে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি অধিক চলছে। হাজারো ব্যবসায়ী বোবা কান্না করছেন। তাদের কান্নায় বাংলার আকাশ ভারী হয়ে যাচ্ছে। তাদের কান্না কি থামবে না? চাঁদাবাজি বন্ধে করণীয় কি হতে পারে, এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামত নিম্নে সংক্ষিপ্ত আকারে যোগ করা হলো- চাঁদাবাজির ঘটনায় দ্রুত তদন্ত ও অপরাধীদের কঠোর শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা যেতে পারে। চাঁদাবাজি প্রতিরোধের জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স বা স্কোয়াড গঠন করা যেতে পারে, যা শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়েই গঠিত হবে না, বরং বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মীও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। সব বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে চাঁদাবাজি বন্ধে একটি ঐকমত্য তৈরি করা এবং দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে যারা চাঁদাবাজি করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।

বেকারত্ব কমাতে ব্যাংকগুলোকে সহজশর্তে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া এবং উদ্যোক্তা উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। দেশের প্রতিটি বাড়িতে কে কোন পেশায় নিয়োজিত, তাহা খুঁজে বের করা। অর্থাৎ বখাটেদের তালিকা প্রণয়ন করা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অভিভাবকদের উচিত তাদের সন্তানদের দৈনন্দিন গতিবিধির প্রতি সুনজর দেওয়া। 

চাঁদাবাজির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করা, যেন সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে উৎসাহিত হয়। নাগরিকের উচিত চাঁদাবাজির শিকার হলে চুপ না থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো এবং আইনগত ব্যবস্থা নিতে সাহায্য করা। চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে একটি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হওয়া।

নির্বাচনে চাঁদাবাজিতে সংশ্লিষ্ট কাউকে নিজে ভোট প্রদান করা থেকে বিরত থাকা এবং অপরকেও এ বিষয়ে সচেতন করা। আমরা আশা করব, অচিরেই দেশের সর্বত্রই ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজদের কবল থেকে মুক্ত হবেন। এ বিষয়ে অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারের সজাগ দৃষ্টিকাম্য।

চাঁদাবাজি বন্ধে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয়তা বৃদ্ধি, কঠোর আইনের প্রয়োগ, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টি এবং বিশেষ টাস্কফোর্স বা স্কোয়াড গঠন করা জরুরি। একইসাথে, বেকারত্ব কমাতে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে সহজশর্তে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

ড. মো. আনোয়ার হোসেন

প্রাবন্ধিক, কথা সাহিত্যিক, প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল