রাষ্ট্রের সন্ধিক্ষণে এক্সিট নয়, জবাব চাই

এসএম হাসানুজ্জামান

প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এমন এক দোলাচলে দাঁড়িয়ে, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপই অনিশ্চিত, প্রতিটি সিদ্ধান্তই সংশয়ের আবরণে ঢাকা। জাতীয় নির্বাচন যতই সন্নিকটে আসছে, ততই রাজনৈতিক আকাশে জমছে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ। জনগণের আশাবাদী মুখে এখন ছায়া ফেলেছে অবিশ্বাসের রেখা। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের কয়েকজন সেফ এক্সিট খুঁজছেন- এমন খবর এখন শুধু গুজব নয়, বাস্তবতার গন্ধ ছড়াচ্ছে। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের বক্তব্য যে ‘কিছু উপদেষ্টা নিরাপদ প্রস্থান চাইছে,’ সেটি ইঙ্গিত করছে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ এক গভীর সংকটের। প্রশ্ন এখন একটাই- যারা জনগণের আস্থায় দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তারা কি সেই আস্থাকে ভঙ্গ করতে চলেছেন? নাকি তারা বুঝতে পেরেছেন, দায়িত্বের চেয়ে স্বার্থই এখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক্সিট শব্দটি নতুন নয়, বরং দায় এড়ানোর সংস্কৃতি হিসেবে এটি গভীরভাবে প্রোথিত। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর খুনিরা বিদেশে আশ্রয় নেয়, যা ছিল প্রথম রাষ্ট্রীয় দায়মুক্তির উদাহরণ। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যার পরও অনেক সামরিক কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক সহযোগী নিরাপদ থেকে গেছেন। ২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন সম্পন্ন করে এমনভাবে বিদায় নেয় যেন তাদের কোনো দায়ই নেই। সাম্প্রতিককালে শেখ হাসিনার জুলাই আন্দোলনের মুখে সামরিক প্রহরায় দেশত্যাগও এই ধারারই পুনরাবৃত্তি- রাজনৈতিক ব্যর্থতার মুখে নৈতিক পশ্চাদপসরণ। ইতিহাস যেন বারবার একইভাবে নিজেকে প্রকাশ করছে, শুধু চরিত্র বদলাচ্ছে, রূপ বদলাচ্ছে, কিন্তু প্রবণতা একই- দায় এড়ানোর সংস্কৃতি।

তবে এই ইতিহাসে একটিমাত্র ব্যতিক্রম দেখা যায় তারেক রহমানের ক্ষেত্রে। তাঁর বিদেশযাত্রা ছিল চিকিৎসার প্রয়োজনে, কিন্তু সেটি পরিণত হয়েছিল রাজনৈতিক নির্বাসনে। তবুও তিনি সেই নির্বাসন থেকে ফিরে এসে রাজনীতিকে অনলাইনের মাধ্যমে নতুন পথে দাঁড় করিয়েছেন। তার অনলাইন প্রত্যাবর্তন দায় গ্রহণের এক ভিন্ন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এই প্রেক্ষাপটে বর্তমান উপদেষ্টাদের সামনে এখন দুটি পথ- দায় এড়ানোর অথবা দায় গ্রহণের। কোনটি তারা বেছে নেবেন, সেটিই নির্ধারণ করবে আগামী দিনের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা।

বর্তমান সরকারের উপদেষ্টাদের মূল দায়িত্ব ছিল জুলাই সনদের বাস্তবায়ন- যে সনদ জনগণের হাতে ক্ষমতার মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এই প্রতিশ্রুতি কাগজেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল, তা আজ ব্যর্থতার কুয়াশায় ঢাকা। উপদেষ্টাদের মনে এখন যে ভয় কাজ করছে তা শুধু প্রশাসনিক নয়, রাজনৈতিকও। পিআর বা Proportional Representation পদ্ধতির নির্বাচন নিয়ে তারা গভীর দ্বিধায় ভুগছেন। এই পদ্ধতিতে সংসদের আসন ভাগ হবে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে, অর্থাৎ কোনো একক দল পুরো নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারবে না। বড় দলগুলোর আধিপত্য ভেঙে যাবে, বিকল্প নেতৃত্বের সুযোগ তৈরি হবে। কিন্তু এই পরিবর্তন মানে অনেকের জন্য অস্তিত্ব সংকট। তাই দেখা যাচ্ছে, কেউ কেউ এখন পিআর বাস্তবায়নের চেয়ে পুরোনো ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে বেশি আগ্রহী, কারণ সেটিই তাদের জন্য নিরাপদ।

বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রিক। যেখানে ক্ষমতা মানেই প্রভাব, আর প্রশাসন মানেই আনুগত্য। পিআর পদ্ধতি এই ধারণাটিকেই ভেঙে দেয়। এখানে জনগণের ভোট প্রকৃত অর্থে সংসদের আসন নির্ধারণ করে, দল নয়। ফলে নেতৃত্ব নির্ভর রাজনীতিতে এটি এক বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন। কিন্তু এই বিপ্লবের সামনে দাঁড়িয়ে উপদেষ্টারা যে ভয় পাচ্ছেন, তা মূলত রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা নয়, বরং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও প্রভাব হারানোর আশঙ্কা। রাষ্ট্রে যে পরিবর্তনের ডাক উঠেছিল, সেটি এখন যেন প্রশাসনিক কৌশলের জালে বন্দি।

জুলাই সনদ ছিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রচিন্তার পুনর্গঠনের ঘোষণা। জনগণ হবে রাষ্ট্রের মালিক, প্রশাসন হবে সেবক, আর নীতিনির্ধারণে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। কিন্তু সেই সনদ এখন প্রশাসনিক আলমারির গহীনে ঘুমিয়ে আছে। বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, বিদেশি প্রভাব ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কৌশলগত হিসাব। যে নথি একসময় জনগণের আশা জাগিয়েছিল, আজ সেটিই পরিণত হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ প্রতীকে। জনগণ ভাবছে- এটি কি সত্যিই রাষ্ট্র পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি ছিল, নাকি শুধু সময় কেনার এক রাজনৈতিক কৌশল?

এখন আলোচনায় এসেছে নতুন গণভোট- পিআর পদ্ধতির বৈধতা যাচাইয়ের উদ্যোগ। এটি শুনতে গণতান্ত্রিক শোনালেও বাংলাদেশের ইতিহাস জানায়, গণভোট অনেক সময় গণতন্ত্রের চেয়ে প্রহসনের মুখোশে পরিণত হয়। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান ও ১৯৮৫ সালে এরশাদের গণভোট- দুটিই ছিল ক্ষমতা বৈধ করার হাতিয়ার। তাই জনগণের মনে প্রশ্ন- এবারের গণভোটও কি সেই প্রহসনের পুনরাবৃত্তি হবে? তবুও আশা আছে, যদি এই গণভোট প্রকৃত অর্থে স্বচ্ছ হয়, তাহলে এটি হতে পারে গণতন্ত্রের নবজাগরণ। জনগণের মতামত সত্যিকার অর্থে প্রতিফলিত হলে বাংলাদেশে রাজনীতির নতুন অধ্যায় শুরু হতে পারে। কিন্তু যদি এটি হয় ক্ষমতা পুনর্বিন্যাসের কৌশল, তবে রাষ্ট্র আবারও প্রবেশ করবে গভীর সংকটে, যেখানে দায়হীনতা ও ভীতির সংস্কৃতি পুনরায় জেগে উঠবে।

আজ প্রশাসন নিজেই নিজের মধ্যে অবিশ্বাসে আক্রান্ত। কর্মকর্তারা জানেন না, আগামীকাল তাদের পদ থাকবে কি না। রাষ্ট্রযন্ত্র যখন অনিশ্চয়তায় ভোগে, তখন ন্যায়নীতি হারিয়ে যায় এবং দায়িত্ববোধ রূপ নেয় ভয়-প্রবণতায়। তখন কেউ উদ্যোগ নেয় না, বরং সবাই নিরাপত্তার খোঁজে নীরব থাকে। এই নীরবতাই আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের মূল উৎস। জনগণ দেখছে, তাদের প্রতিনিধি আর রাষ্ট্রের সেবক- দুজনেই ভয়ে নিঃশব্দ।

অন্যদিকে জনগণের মনস্তত্ত্বেও বদল এসেছে। অভ্যুত্থানের পর মানুষ ভেবেছিল দুর্নীতি ও দলীয়করণের যুগ শেষ হবে। কিন্তু মাত্র এক বছরেই সেই স্বপ্ন ভেঙে পড়েছে। মানুষ এখন বলছে, ‘আমরা কাকে বিশ্বাস করব?’ - এটাই সবচেয়ে ভয়ংকর প্রশ্ন। কারণ বিশ্বাস হারানো জনগণই হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সবচেয়ে বড় হুমকি। জনগণের এই হতাশা যদি বাড়তে থাকে, তবে আবারও আন্দোলনের অগ্নিশিখা জ্বলবে, কারণ ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে- যখন রাষ্ট্র নীরব হয়, তখন রাস্তাই কথা বলে।

উপদেষ্টাদের সামনে এখন ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত। তারা চাইলে আজই দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক নতুন অধ্যায় খুলতে পারেন। তারা যদি জুলাই সনদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেন, গণভোটকে জনগণের অংশগ্রহণের প্রকৃত মঞ্চে পরিণত করেন, তবে তারা ইতিহাসে দায়বদ্ধ নেতৃত্বের প্রতীক হয়ে থাকবেন। কিন্তু যদি তারা সেফ এক্সিট বেছে নেন, তবে ইতিহাস তাদেরও সেই একই অন্ধকার অধ্যায়ে স্থান দেবে, যেখানে দায়ের চেয়ে ভয়, নৈতিকতার চেয়ে স্বার্থ বড় হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা এক ভয়ংকর সত্যের দিকে ইঙ্গিত করছে- রাষ্ট্র এখন ভয় ও দ্বিধার মধ্যে বন্দি। অথচ রাষ্ট্রের টিকে থাকার একমাত্র উপায় হলো সাহস, সত্য ও দায়বদ্ধতা। গণতন্ত্র কখনও পালিয়ে বাঁচে না; গণতন্ত্র টিকে থাকে জবাবদিহির মধ্য দিয়েই। যারা পালায়, তারা ইতিহাস থেকে মুছে যায়; যারা দাঁড়ায়, তারাই ইতিহাস লেখে।

তাই আজ প্রয়োজন এক্সিট নয়- উপস্থিতি; প্রয়োজন পলায়ন নয়- দায়িত্ব; প্রয়োজন নীরবতা নয়- জনগণের কণ্ঠস্বর। রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে উপদেষ্টাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে- তারা ইতিহাসের দায় নেবেন, নাকি ইতিহাসের দায়ী হবেন। কারণ রাষ্ট্র তখনই শক্তিশালী হয়, যখন নেতৃত্ব ভয় নয়, ন্যায়ের পথে হাঁটে। জনগণের হাতে রাষ্ট্রের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিই হতে পারে আজকের বাংলাদেশের পরিত্রাণ।

গণতন্ত্রের প্রকৃত অর্থই হলো জবাবদিহি। এক্সিট নয়, প্রয়োজন জবাব; নীরবতা নয়, প্রয়োজন সাহস; স্বার্থ নয়, প্রয়োজন দায়িত্ববোধ। কারণ যারা সত্যকে ভয় পায়, তারা শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের অন্ধকারে হারিয়ে যায়। আর যারা ভয়কে জবাব দেয় সত্য দিয়ে, তারাই গড়ে দেয় জাতির ভবিষ্যৎ। আজকের বাংলাদেশ সেই সিদ্ধান্তের সামনে দাঁড়িয়ে- ভয়ের রাজনীতি না দায়বোধের গণতন্ত্র- রাষ্ট্র কোন পথে হাঁটবে, সেটিই নির্ধারণ করবে আমাদের আগামী প্রজন্মের ভাগ্য।

এসএম হাসানুজ্জামান, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কলাম লেখক, রংপুর সদর, রংপুর