ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ আনুগত্য

রাফায়েল আহমেদ শামীম

প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

গাজার আকাশে এখন কোনো শব্দ নেই- না বোমার, না ড্রোনের, না আর্তনাদের। কিন্তু এই নীরবতা শান্তি নয়; এটি এক গোপন শ্বাসরুদ্ধ নীরবতা, যেন মৃত মানুষের শহরে সামান্য বিরতির মতো। শিশুরা আজও ঘুমাতে ভয় পায়, হাসপাতালগুলো এখনও ওষুধহীন, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা মানুষের গন্ধ এখনও বাতাসে ভেসে বেড়ায়। যুদ্ধ থেমে গেছে- কিন্তু অন্য এক যুদ্ধ, রাজনৈতিক ও নৈতিক যুদ্ধ, এখনও চলছে; সেই যুদ্ধের মূলে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ ইসরায়েলপ্রীতি।

ট্রাম্পের ভাষায়, ‘মধ্যপ্রাচ্যের নতুন ভোর’- এ এক রাজনৈতিক কবিতা মাত্র। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এমন ভোর বারবার এসেছে, কিন্তু সূর্য ওঠার আগেই রক্তে ডুবে গেছে দিগন্ত। ১৯৫৬, ১৯৬৭, ১৯৭৩ সালের যুদ্ধ, অসলো চুক্তি, ক্যাম্প ডেভিড, আনাপোলিস- সবই প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যত চুক্তি হয়েছে, তার কোনোটিই টেকসই শান্তি এনে দিতে পারেনি। কারণ, প্রতিবারই ন্যায়ের পরিবর্তে রাজনীতি, মানবাধিকারের পরিবর্তে কৌশল এবং মানবতার পরিবর্তে মিত্রস্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে।

ইসরায়েল- মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ‘কৌশলগত সন্তান’ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র বুঝেছিল, তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করতে হলে দরকার একটি শক্তিশালী ঘাঁটি- যেখানে পশ্চিমা মূল্যবোধের ছদ্মাবরণে তারা সামরিক, অর্থনৈতিক ও গোয়েন্দা আধিপত্য বজায় রাখতে পারবে। সেই ঘাঁটিই হলো ইসরায়েল। জন্মলগ্ন থেকেই ইসরায়েল ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক প্রকল্প- একটি সামরিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরীক্ষাগার, যা আরব জাতীয়তাবাদ ও সোভিয়েত প্রভাবের বিরুদ্ধে পশ্চিমা প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এই সম্পর্ক পরিণত হয় অন্ধ আসক্তিতে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ইসরায়েল হয়ে ওঠে ‘অস্পৃশ্য পবিত্র গরু’- যাকে সমালোচনা করা মানে আত্মহনন। রিপাবলিকান বা ডেমোক্র?্যাট, কেউই সেই ঝুঁকি নেয় না। ইসরায়েলি লবি, বিশেষ করে AIPAC, মার্কিন রাজনীতিকে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলেছে যে, আজ কংগ্রেসের অর্ধেক সদস্যই ইসরায়েল নীতির সমালোচনায় মুখ খুলতে ভয় পান।

ধর্মীয় রাজনীতির ছায়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নীতি : ইভানজেলিকাল খ্রিস্টান গোষ্ঠী বিশ্বাস করে- ইসরায়েল হলো বাইবেলিয় ভবিষ্যদ্বাণীর অংশ। ‘হোলি ল্যান্ড’ এর নিয়ন্ত্রণ তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই গোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল ভোটশক্তির মালিক। রিপাবলিকান দল তাদের ওপর নির্ভরশীল। ফলে, যে প্রশাসনই ক্ষমতায় আসুক, ইসরায়েলের প্রতি অন্ধ সমর্থন তার রাজনৈতিক বেঁচে থাকার শর্তে পরিণত হয়।

এই অন্ধ সমর্থন শুধু ধর্মীয় বা নৈতিক নয়- এটি অর্থনৈতিকও। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর ইসরায়েলকে দেয় প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা, যা ২০২৪ সালের গাজা যুদ্ধ চলাকালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ বিলিয়ন ডলারে। এই অর্থের একটি অংশ ব্যবহৃত হয়েছে সেই বোমা তৈরি করতে, যা গাজার শিশুদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।

মানবাধিকার ও বাস্তবতার দ্বৈত মানদ- : যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকে শেখায় মানবাধিকার, গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। কিন্তু যখন ইসরায়েল হাসপাতাল বোমা মারে, সাংবাদিক হত্যা করে, বা জাতিসংঘের স্কুলে আশ্রয় নেওয়া শিশুদের ওপর মিসাইল ছোড়ে- তখন যুক্তরাষ্ট্রের কণ্ঠ নীরব হয়ে যায়। বরং তারা বলে, ‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে।’ প্রশ্ন হলো- ফিলিস্তিনিদের কি কোনো আত্মরক্ষার অধিকার নেই? এই দ্বৈত মানদ- যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থানকে ভঙ্গুর করে দিয়েছে। আজ মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ যুক্তরাষ্ট্রকে আর মানবতার রক্ষাকর্তা হিসেবে দেখে না; দেখে এক দ্বিমুখী শক্তি হিসেবে, যে স্বাধীনতার ভাষায় দখলদারকে রক্ষা করে।

ট্রাম্প প্রশাসন : উপনিবেশবাদের নব সংস্করণ : ট্রাম্প প্রশাসনের ‘শান্তিচুক্তি’ মূলত একটি রাজনৈতিক প্রহসন। এটি ফিলিস্তিনিদের জন্য নয়, বরং ইসরায়েলের বিজয়পত্র। হামাসের নিরস্ত্রীকরণ, সুড়ঙ্গ ধ্বংস, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিষিদ্ধকরণ- সবকিছুই একতরফা শর্ত। পশ্চিম তীরের দখল বা জেরুজালেমের মর্যাদা নিয়ে একটিও বাস্তব আলোচনা হয়নি। এর চেয়েও ভয়াবহ হলো, এই চুক্তি কার্যকর করার জন্য গঠিত হয়েছে একটি ‘বোর্ড’, যার নেতৃত্বে রয়েছেন ট্রাম্প নিজেই। এই বোর্ডের নৈতিক বা আন্তর্জাতিক বৈধতা নেই, কিন্তু তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে ফিলিস্তিনিদের ভবিষ্যৎ। এটি আধুনিক উপনিবেশবাদের এক পরিশীলিত সংস্করণ- যেখানে বন্দুকের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় কূটনীতি, আর লুণ্ঠনের পরিবর্তে ‘শান্তি প্রক্রিয়া’ নামের মুখোশ।

ইসরায়েল : উন্মাদ রাষ্ট্রের বাস্তবতা : আজকের ইসরায়েল এক নিরাপত্তাহীন রাষ্ট্র নয়; বরং এটি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ ও সামরিক গর্বে উন্মত্ত এক শক্তি। তাদের রাজনৈতিক দর্শন এখন ‘দখলই নিরাপত্তা’- যা ইতিহাসের প্রতিটি উপনিবেশবাদী শক্তির নীতি ছিল।

গাজার ওপর ধারাবাহিক বোমাবর্ষণ, পশ্চিম তীরে নতুন বসতি নির্মাণ, ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীদের হত্যা- সবই সেই দর্শনের বহিঃপ্রকাশ। তবুও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অটুট। কারণ ইসরায়েল কেবল মধ্যপ্রাচ্যে নয়, আমেরিকার অভ্যন্তরেও একটি প্রতীক- ‘আমাদের ছোট ভাই’, ‘আমাদের গণতান্ত্রিক দুর্গ’, ‘আমাদের ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমি।’ এই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক রোমান্টিসিজম যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তিবাদী পররাষ্ট্রনীতিকে ক্ষতবিক্ষত করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে বিরোধী স্রোত : তবে সব আমেরিকান এক নয়। সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ৪১ শতাংশ নাগরিক ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে ‘গণহত্যার কাছাকাছি’ মনে করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাস্তায়, সংবাদমাধ্যমে- ফিলিস্তিনের পক্ষে এক নতুন তরঙ্গ উঠছে। তরুণ প্রজন্ম বিশেষভাবে সমালোচনামুখর। কিন্তু প্রশাসন এই আন্দোলনগুলোকে দমন করছে ‘ইহুদি বিদ্বেষ’ অভিযোগে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও একাডেমিক স্বাধীনতা আজ যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই সংকুচিত। গাজা যুদ্ধের সময় শত শত অধ্যাপক ও সাংবাদিক চাকরি হারিয়েছেন শুধু ইসরায়েলবিরোধী মন্তব্য করার কারণে।

রাফায়েল আহমেদ শামীম, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কলাম লেখক, গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা