শিশুর ডিভাইস আসক্তির ভয়াবহতা

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার

প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

তথ্যের অবাধ প্রবাহ, প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ডিজিটাল প্রযুক্তিকে মানুষের হাতের মুঠোয় এমনভাবে পৌঁছে দিয়েছে যে, এগুলো ছাড়া জীবন পরিচালনা করা অসম্ভব, আর এর বিশাল প্রভাব পড়ছে শিশুর ওপর। সংসার সামলাতে মা-বাবার চাকরি করা এখন একটি বাস্তব বিষয়। ফলে অনেক মা-বাবাকে তার সন্তান থেকে দীর্ঘসময় দূরে থাকতে হয়। এ সময়টায় শিশুর একাকিত্বের একমাত্র সঙ্গী প্রযুক্তি। বাইরে খেলার জন্য পর্যাপ্ত মাঠ নেই, তাই মোবাইল ফোন কিংবা ট্যাব তাদের জীবনসঙ্গী। অর্থাৎ সন্তান তার মা-বাবার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা শিশু অধিকার সনদের পরিপন্থি। মোবাইল ফোনের মধ্যে থাকা ট্রান্সমিটিং ডিভাইস থেকে যে অদৃশ্য রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি তরঙ্গ (রেডিয়েশন) নির্গত হয়, তার লেভেল প্রতি কিলোগ্রামে ১.৬ ওয়াটের বেশি হলে মানবদেহে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। দেখা দেয় অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যে ‘স্ক্রিন অ্যাডিকশন’। গবেষণায় প্রতীয়মান, অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা দিনে পাঁচ থেকে আট ঘণ্টা ডিজিটাল যন্ত্র নিয়ে মেতে থাকে। ফলে বাইরে বেড়াতে যাওয়া, খেলাধুলা করা, মুখোমুখি বসে আড্ডা দেওয়া ইত্যাদি ফেস-টু-ফেস ইন্টার‌্যাকশনে আগ্রহ কমে যাচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১১তম ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজেসে (আইসিডি) স্মর্টফোন ও কম্পিউটারে গেম খেলার নেশাকে গেমিং ডিজঅর্ডার হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অনেক দেশ গেমিং আসক্তিকে একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করেছে। প্রতিটি পরিবারই আজ চিন্তিত তাদের সন্তানদের আচার-আচরণ ও খিটখিটে মেজাজ নিয়ে। শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘক্ষণ টিভির পর্দা, মোবাইল ফোন কিংবা ট্যাবলেটের মতো ছোট স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকলে চোখের দৃষ্টি ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। তাই এসব গেম নিয়ে সমাজতত্ত্ববিদ, মনোরোগ চিকিৎসক এবং সাইবার বিশেষজ্ঞদের চিন্তার কোনো অন্ত নেই, কারণ এ ধরনের ‘ভাইরাস গেম’ হিংসাত্মক আচরণকে প্রশ্রয় দেয়। এমনকি গেমের নিয়ম মানতে গিয়ে মৃত্যুও হয়েছে অনেকের। পাবজির মতো গেমের শিশুমনে কী প্রভাব পড়ছে, তা কারও অজানা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির তিন মনোবিজ্ঞানী পরিচালিত তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম গ্রেডের ১ হাজার ৩২৩ ছেলেমেয়ের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, যেসব ছেলেমেয়ে দৈনিক দুই ঘণ্টার বেশি টিভি বা ভিডিও গেম দেখে, তারা গড় হারের দেড়গুণ থেকে দ্বিগুণের বেশি মনঃসংযোগ সমস্যায় পড়ে। শিশু মনোবিজ্ঞানী ডগলাস জেনটাইলের মতে, ভিডিও গেমগুলোয় দ্রুত দৃশ্য বদল, আলো-শব্দণ্ডক্যামেরার অ্যাঙ্গেলের সর্বক্ষণ পরিবর্তন ও কম্পন এমনভাবে হয়ে থাকে যে, শিশুর মনে ও মস্তিষ্কে তা স্থায়ী হয়ে যায়। এ অবস্থায় শিশু যখন ক্লাসরুমে যায়, তখন সেখানে এ ধরনের কিছু না পেয়ে শিক্ষকের নিরস পাঠদানের প্রতি মনঃসংযোগ থাকে না। ডিজিটাল ডিভাইস ও ইন্টারনেটের অজুহাতে লেখাপড়া, খেলা ও বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে তারা দিনরাত ডুবে থাকে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মের অন্ধকার জগতে।

ইংল্যান্ডে শিশু বিশেষজ্ঞ স্যালি পেইন তার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, ডিজিটাল ট্যাব ও স্মার্টফোন ব্যবহারের অবাধ সুযোগ পেয়ে শিশুর মধ্যে কলম বা পেনসিল ব্যবহারের ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে যাচ্ছে। একসময় শিশু দেখত তার বাবা-মা কলম দিয়ে বাজারের ফর্দ লিখতেন, এখন তারা দেখে বাবা-মা মোবাইল ফোনে টেক্সট করছেন। ২০১৬ সালের অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব ছাত্র হাতে লেকচার নোটস লেখেন, তারা পরে সেগুলো অনেক ভালো মনে রাখতে পারে এবং তাদের ধারণা অনেক পরিচ্ছন্ন থাকে। কিন্তু কম্পিউটার বা ট্যাবে যারা নোটস নেন, তারা অনেক লিখতে পারলেও মনে রাখতে পারেন না। ডিজিটাল আসক্তিতে শিক্ষার্থীরা মানসিক ও শারীরিকভাবেও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের মধ্যে বিষণ্নতা, খিটখিটে স্বভাব, উগ্রতা, হঠাৎ রেগে যাওয়া, অপরাধপ্রবণতা, উদ্বেগ, একাকী থাকতে ইচ্ছা করা, বুদ্ধির বন্ধত্ব, ভালো কথার নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া, স্মৃতিশক্তি হ্রাস, মানসিক উন্মাদনা, কল্পনাশক্তি হ্রাস, স্কুলে যেতে ইচ্ছা না করা, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা, চোখের সমস্যা, কম ঘুম, অতিরিক্ত ওজন ও আত্মকেন্দ্রিকতা ইত্যাদি লক্ষণীয়। আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস এবং আরও কিছু দেশে স্কুলে মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে বা এর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এ পদক্ষেপগুলোর মূল উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্মার্টফোনে আসক্তি রোধ, মনোযোগ বৃদ্ধি করা এবং পড়াশোনায় ব্যাঘাত কমানো।

প্রযুক্তি যেমন বিজ্ঞানের একটি অবিস্মরণীয় আবিষ্কার তেমনি এর ঝুঁকিও অনেক। আর তা যদি হয় শিশুর ক্ষেত্রে, তাহলে তা ভবিষ্যতের জন্য হুমকি। একটি শিশু যখন খুব সহজেই হাতের মুঠোয় স্মার্টফোন পেয়ে যায়, তখন সে নানা খারাপ সমবয়সির সঙ্গে মিশতে থাকে, যা তাকে ধীরে ধীরে বিপথে নিয়ে যেতে পারে। সেজন্য কোন বয়সে কতক্ষণ ডিজিটাল ডিভাইসের সঙ্গে কাটানো উচিত, তা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে, প্রথম ৩ বছর পর্যন্ত শিশুর ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার থেকে বিরত থাকা ভালো। ডিভাইসের পরিবর্তে শিশুকে মুখে ছড়া, গান, গল্প শোনানো উচিত। ৩-৮ বছরের শিশুর জন্য মাঝেমাঝে ১০-১৫ মিনিটের জন্য বড়দের তত্ত্বাবধানে গান, ছড়া, গল্প বা শিশু উপযোগী বিষয়গুলো দেওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সারা দিনে ৩-৫ বছরের শিশুর জন্য সর্বোচ্চ ৪০ মিনিটের মধ্যে স্ক্রিনিংয়ের (মোবাইল, টিভি, ট্যাব, কম্পিউটার বা এ ধরনের যে কোনো ডিভাইস) সময়সীমা রাখতে হবে।

ছোট শিশুর ক্ষেত্রে যে কোনো কিছু স্ক্রিনে দেখার সময় সেটা থামিয়ে শিশুর সঙ্গে ওই বিষয়ে কিছুক্ষণ পরপরই কথা বলা ভালো। সেটা দ্বিমুখী যোগাযোগ নিশ্চিত করে। ৫-৮ বছরের শিশুর যদি অনলাইনে ক্লাস করতে হয়, তখন খেয়াল রাখতে হবে যেন একটানা ৪০ মিনিটের বেশি সে স্ক্রিনের সামনে না থাকে। প্রয়োজনে ১০-১৫ মিনিট বিরতির পর আবার ৪০ মিনিট থাকতে পারবে। সারা দিনে এই সময়সীমা ২ ঘণ্টার মধ্যে থাকা ভালো। যে কোনো শিশুর জন্য প্রথম থেকে ডিভাইস ব্যবহার একটি নিয়মের মধ্যে রাখতে হবে। শিশু বড়দের দেখেই শিখবে, তাই বড়দেরও ডিভাইস ব্যবহারে সময়সীমা মেনে চলা উচিত।

প্রযুক্তি ছাড়া আমরা অচল। বড়দের পাশাপাশি ছোটরাও এই প্রযুক্তির কাছে বন্দি। অবশ্য অনেক সময় শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি নানাভাবে তাকে সাহায্য করে। ছোট শিশুরা একা একা অক্ষর চিনতে পারে ট্যাবের সাহায্যে। খেলার ছলে বাসায় বসে নিজের পড়া শেষ করতে পারে। ক্লাসের পড়া থেকে শুরু করে নানা ধরনের অনুশীলনী এবং হোমওয়ার্ক-প্রজেক্টের কাজের তথ্য জোগাড় করতে পারে এ প্রযুক্তির মাধ্যমে। সাধারণ জ্ঞানের ক্ষেত্রেও ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি শিশুকে সাহায্য করে নানাভাবে। বাইরের দেশগুলোয় কী হচ্ছে তা সে জানতে পারে। তাকে সামাজিক হয়ে উঠতে সাহায্য করে এই প্রযুক্তি। বলা যায়, মা-বাবার অনুপস্থিতিতে প্রযুক্তিই তাদের কাছে আশীর্বাদ। কিন্তু অতিমাত্রায় মোবাইল ও ডিভাইস আসক্তি শিশুর ভবিষ্যৎ মেধা বিকাশে যে বড় অন্তরায়, তা স্পষ্ট।

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার

অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়