জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস : সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ

তরিকুল ইসলাম

প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সঠিক আইনের অভাব বা দুর্বল বাস্তবায়নের কারণে পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা শেষ হচ্ছে না। এতে দেশের সড়কগুলো দিন দিন আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। প্রতি বছর হাজারো মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে বা আহত হচ্ছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-এর তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৩ হাজার ৩৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ২ হাজার ৯৪৩ জন নিহত হয়েছেন। গত বছর দেশে ৫ হাজার ৮৫৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৪৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিআরটিএ-এর তথ্যমতে, দেশে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ জন সড়কে নিহত হচ্ছেন। তবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি।

এই প্রেক্ষাপটে, আগামী ২২ অক্টোবর সারা দেশে পালিত হতে যাচ্ছে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘মানসম্মত হেলমেট ও নিরাপদ গতি, কমবে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি’। প্রতি বছর ব্যাপক আয়োজনের মাধ্যমে দেশে জাতীয়ভাবে নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করলেও কমানো যাচ্ছে না সড়কে মৃত্যুর মিছিল। সড়কে মৃত্যুর ছিছিল কমাতে প্রয়োজন ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে, প্রতি বছর বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩১ হাজার ৫৭৮ জনের মৃত্যু হয়। অন্যদিকে বিআরটিএর হিসাব মতে, প্রতিবছর দেশে গড়ে প্রায় ৫ হাজার মানুষ মারা যায় ও ১০ হাজারের বেশি বিভিন্ন মাত্রায় আহত এবং পঙ্গুত্ব বরণ করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত ‘গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন রোড সেফটি ২০২৩’-এ আরও বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২১ হাজার ৩১৬ জনের। তবে, পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়েছে মৃত্যু হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৩৭৬ জনের। একইভাবে ২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে ২৪ হাজার ৯৪৪ জনের মৃত্যুর কথা বলা হলেও পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়েছে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৬৩৫ জনের। ২০২১ সালের রিপোর্টে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে মৃত্যু হয়েছে ৩১ হাজার ৫৭৮ জনের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০১৬ সালে প্রতি লাখে মৃত্যুহার ছিল ১৫.৩ শতাংশ এবং ২০২১ সালে এই মৃত্যুহার ছিল প্রতি লাখে ১৯ জনের মতো।

প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে যানবাহনের চালক ও যাত্রী। বাদ যাচ্ছে না পথচারীও। কোনোভাবেই সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না। যানবাহনের অতিরিক্ত গতি, মাদক গ্রহণ করে গাড়ি চালানো, সড়কের সাইন-মার্কিং-জেব্রা ক্রসিং চালক ও পথচারীদের না মানার প্রবণতাকে বড় কারণ সড়ক দুর্ঘটনা। এছাড়া যথাস্থানে সঠিকভাবে ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ না করা এবং ব্যবহারোপযোগী না থাকা, রাস্তায় হাঁটা ও পারাপারের সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা, হেডফোনে গান শোনা, চ্যাট করা, সড়ক ঘেঁষে বসতবাড়ি নির্মাণ ও সড়কের ওপর হাটবাজার গড়ে ওঠায় পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে।

আমাদের বর্তমান সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এবং সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২ মূলত সড়কে পরিবহনের জন্য আইন এবং সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিধিমালা। তাই পরিবহন ব্যবস্থাপনার জন্য তৈরি এ আইনে সাম্প্রতিক সংশোধনীর সময়ে গতি নিয়ন্ত্রণ, হেলমেট ও সিটবেল্টের মতো কিছু বিষয় সংযোজন করা হলেও তা সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু ও বড় ধরনের আঘাত থেকে রক্ষার করার জন্য পর্যাপ্ত নয়। সড়ক পরিবহন আইনে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি অনেকটা উপেক্ষিতই থেকে গেছে। এ জন্য সড়কে প্রাণহানি কমাতে সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন জরুরি।

ওয়ার্ল্ড হেলথ র‌্যাঙ্কিং অনুসারে, সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত ১৮৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম। সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ও তার সঠিক প্রয়োগ ব্যতীত দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো বা রোধ করা সম্ভব নয়। সঠিক আইন ও তার প্রয়োগের ফলে সড়ক দুর্ঘটনা, যা বর্তমানে একটি বড় সমস্যা, তা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা যেতে পারে।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-এর ২০২০-২০৩০ সালের পরিকল্পনায় বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা ৫০ শতাংশ নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ৫টি রিস্ক ফ্যাক্টর: সিট বেল্ট, অতিরিক্ত গতি, স্ট্যান্ডার্ড হেলমেট, ড্রিংক ড্রাইভিং, শিশু আসন চিহ্নিত করা হয়েছে। এই অতি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো অর্জনের মাধ্যমে সবার জন্য নিরাপদ, সুরক্ষিত, সহজলভ্য ও টেকসই জীবন নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘ। এছাড়া জাতিসংঘ সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম পাঁচটি পিলারও চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হলো: সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ যানবাহন, নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী এবং সড়ক দুর্ঘটনা পরবর্তী করণীয়। বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তায় এই বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করতে হলে আইনের যথাযথ প্রয়োগ অপরিহার্য। এর জন্য প্রয়োজন একটি ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’।

সড়কে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবপক্ষের সদিচ্ছা থাকতে হবে। একই সঙ্গে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে যেসব সংস্থা কাজ করেন তাদের সঙ্গে একযোগে কাজ করলে সহজেই জাতিসংঘের সেফ সিস্টেম এপ্রোচ অনুয়ায়ী সড়ককে নিরাপদ করা সম্ভব হবে। আর এটি করা গেলে সহজেই ২০৩০ সালের মধ্যে যে সড়ক দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।

সড়কে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেইফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচের আলোকে নিরাপদ সড়ক সংক্রান্ত আলাদা আইন প্রণয়ন ও এর যথাযথ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। এসব পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কাছে আমার দাবি, সড়ক নিরাপত্তার সংস্কার ভাবনায় সমন্বিত সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করতে হবে।

আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ সড়কের বিশৃঙ্খলা। রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের যান চলাচল করে। বিশেষ করে বর্তমানে দুই ও তিন চাকার গাড়ির আধিক্যে দুর্ঘটনা আরও বেড়েছে। উপরন্তু নেই সড়ক পরিবহন আইনের যথাযথ প্রয়োগ। নিরাপদ সড়ক যতটা না, কাঠামোগত বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল, তার অধিক নিয়ম-শৃঙ্খলা মানার ওপর প্রতিষ্ঠিত। সরকারের আইন প্রয়োগের পাশাপশি আমাদের সকলরেই উচিত সড়কে আইন-শৃঙ্খলা মেনে চলা। সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সড়ক নিরাপদ হবে সবার জন্য এটিই প্রত্যাশা।

তরিকুল ইসলাম

অ্যাডভোকেসি অফিসার (কমিউনিকেশন) স্বাস্থ্য সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন