অগ্নিকাণ্ডের অর্থনীতি : ক্ষতি দুর্বলতা ও দায়

মুহম্মদ গোলাম রাব্বি

প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রতিটি অগ্নিকাণ্ড শুধু আগুন নয়, এটি আমাদের দায়িত্বহীনতার প্রতিফলন। অগ্নিকাণ্ডে শুধু একটি ইমারত নয়, একটি স্বপ্নও জ্বলে ওঠে। পরিবারের রুটি-রুজি, কর্মচারীদের চাকরি, বিনিয়োগকারীদের আর্থিক সম্পদ সবকিছুই আগুনের লাপলিহানো জিহ্বায় বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু যা সবচেয়ে ভয়ংকরভাবে বিলীন হয়, তা হলো একটি সম্পূর্ণ ইকোসিস্টেমের আস্থা এবং স্থিতিশীলতা। অর্থনৈতিক ভাষায় বলতে গেলে এটি শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি ব্যবস্থাগত ব্যর্থতার প্রকাশ।

গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে যে দ্রুত গতিতে অগ্নিকাণ্ড ঘটছে, তা স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। অফিস বিল্ডিং থেকে শুরু করে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, মার্কেট এবং বিমানবন্দরও যুক্ত হয়। তাহলে বিষয়টি শুধু কয়েকটি ঘটনা নয়, এটি একটি সংকেত। একটি গুরুতর সংকেত যা বলছে আমাদের অবকাঠামো, আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, আমাদের জবাবদিহিতার কাঠামো গভীরভাবে দুর্বল। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে প্রায় ছাব্বিশ হাজারের বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

অর্থনীতিবিদরা সাধারণত একটি ধারণা রাখেন, যে কোনো রাষ্ট্রের উন্নয়নের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই রাষ্ট্রে বিনিয়োগকারীদের আস্থা এবং কর্মচারীদের সুরক্ষার নিশ্চয়তা। আপনার অর্থনীতি যতই বড় হোক না কেন যদি মানুষ নিরাপদ না থাকে, যদি তাদের প্রাণের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন থাকে তাহলে সেটি একটি অনিশ্চিত অর্থনীতি। আর এই অনিশ্চিত অর্থনীতিতে ভালো বিনিয়োগকারীরা আসে না। দক্ষ মানুষরা অন্যত্র চলে যায়। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পায়।

তবে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দিক থেকে বিচার করলেও সমস্যার গভীরতা বোঝা যায়। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পর যখন মানুষ মারা যায়, যখন পরিবার ভেঙে যায়, তখন সমাজের মানসিক ক্ষতিও অপরিসীম। একজন মা যখন তার সন্তান হারায় কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে, সেই ক্ষতির কোনো অর্থনৈতিক পরিমাপ নেই। সেই পরিবার আর কখনও সম্পূর্ণ হয় না এবং এই ধরনের ট্রাজেডি যখন বারবার ঘটে, তখন সমাজে একটি সম্মিলিত বেদনা জন্ম নেয়। মানুষ সরকারের প্রতি আস্থা হারায়। তারা ভাবে তাদের জীবন সত্যিই কি কারো কাছে গুরুত্বপূর্ণ? এই অভ্যন্তরীণ হতাশা একটি অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় বিষ।

আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করার আছে- প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পর যা হয়, তা হলো একটি আপাত পদক্ষেপ এবং তারপর ভুলে যাওয়া। কয়েক সপ্তাহ মিডিয়া কভারেজ থাকে, রাস্তায় প্রতিবাদ হয়, তারপর সবকিছু নীরব হয়ে যায়। এরমধ্যে যারা দায়ী তারা অনেক সময় নিরাপদ থাকে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা অবসর পান বা বদলি হন, কিন্তু শাস্তি কদাচিৎ হয়। এই অপরাধবোধের সংস্কৃতি আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও দুর্বল করে তোলে। যখন কোনো আইন লঙ্ঘনের পরিণতি নেই তখন মানুষ সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নেয় না। যার কারণে এই উদাসীনতা থেকেই বারবার দুর্ঘটনা ঘটে।

২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধসের ঘটনা এখনও আমাদের মনে আছে। সেখানে প্রায় এক হাজার একশোর বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেদিন বাংলাদেশকে প্রশ্ন ছুড়েছিল। তারপর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এসেছিল। বিদেশি ক্রেতারা নিরাপত্তা নিয়ে তোলপাড় করে ফেলে। কিন্তু এক দশক পরেও আমরা দেখছি, একের পর এক অগ্নিকাণ্ড। এর মানে কী? এর মানে হলো আমাদের শিক্ষা হয়নি অথবা শিক্ষা হয়েছে কিন্তু সেটি প্রয়োগ করা হয়নি।

প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পেছনে থাকে একটি অর্থনৈতিক গল্প যা লালসা এবং অবহেলার। যখন একটি ফ্যাক্টরি মালিক জানেন যে ফায়ার সেফটি সিস্টেম লাগালে খরচ পড়বে, তখন তিনি সেটি এড়িয়ে যান। কারণ, এতে তাৎক্ষণিক মুনাফা বাড়ে। যখন একজন অফিস ডেভেলপার জানেন যে নিরাপত্তা নিয়ম মেনে চলা অপেক্ষাকৃত বেশি খরচসাপেক্ষ তিনিও সেই প্রলোভনে পড়েন। যখন সরকারের নিরীক্ষণ বিভাগ জানেন যে একটি নির্দিষ্ট স্থানে নিরাপত্তা ঘাটতি আছে কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এসবের ফলে ঘটে একটি সম্পূর্ণ ব্যবস্থার ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ।

অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে প্রতিটি অগ্নিকাণ্ড একটি বিশাল ক্ষতি হিসেবে আসে শুধুমাত্র তাৎক্ষণিকভাবেই নয়, দীর্ঘমেয়াদিভাবেও। একটি ফ্যাক্টরি যখন পুড়ে যায়, তখন শুধু সেই ফ্যাক্টরির বিনিয়োগ নষ্ট হয় না, হারায় কর্মসংস্থানও। হাজার হাজার শ্রমিক আয়হীন হয়ে যায়। তাদের পরিবারের খাবার নিয়ে প্রশ্ন উঠে। বিক্রেতারা যারা ওই ফ্যাক্টরির জন্য কাপড় সরবরাহ করত তারা হঠাৎ ক্রেতা হারায়। এই ক্ষতি সমাজের একটি বিস্তৃত অংশে ছড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু আরও গভীর ক্ষতি হচ্ছে ব্র্যান্ড ড্যামেজ। যখন বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলো দেখে যে বাংলাদেশে নিরাপত্তা নিশ্চিত নয় তখন তারা তাদের অর্ডার সরিয়ে নেয়। আমাদের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি বিশ্বের দ্বিতীয় বড় রপ্তানিকারক হতে পেরেছে বিশ্বস্ততার কারণে। কিন্তু এক-একটি অগ্নিকাণ্ড সেই বিশ্বাসকে খোদাই করছে। বাজারে আমাদের অবস্থান দুর্বল হচ্ছে। প্রতিযোগীরা এগিয়ে যাচ্ছে।

যার করণে বড় অর্থনৈতিক ক্ষতিটি আসে যখন একটি দেশের সামগ্রিক বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস পায়। বিনিয়োগকারীরা যখন ঝুঁকি বেশি মনে করে তখন তারা তাদের সম্পদ অন্যত্র নিয়ে যায়। স্বল্পমেয়াদে এর প্রভাব না দেখা গেলেও মধ্যমেয়াদে এটি জিডিপির বৃদ্ধি কমায়, কর্মসংস্থান হ্রাস করে এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশের উন্নয়নের গতি থেমে যায়।

এখন প্রশ্ন হলো কে দায়ী, কারা দায়বদ্ধ? একটি অগ্নিকাণ্ডের জন্য কি শুধুমাত্র ফ্যাক্টরি মালিক দায়ী? না, দায়টি বিস্তৃত।

যারা বিল্ডিং পাস করেছে, যারা ইন্সপেকশন রিপোর্ট জানতেন কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নিলেন না, যারা আইন প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে, তারা সবাই কমবেশি দায়ী। কিন্তু গুরুতর দায়টি আছে আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর। কারণ একটি দেশের নিরাপত্তা মান নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ব্যক্তিগত লালসার বিরুদ্ধে সামাজিক সুরক্ষা স্থাপন করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এমন এক জায়গায় আছে যেখানে সুযোগ এবং দায়িত্ব দুটোই বিশাল। একটি দেশ যেখানে তরুণ, উদ্যমী মানুষ আছে, যেখানে বৈশ্বিক চাহিদা আছে, সেই দেশ দ্রুত উন্নয়ন করতে পারে। কিন্তু সেই উন্নয়ন হতে হবে নিরাপদ, টেকসই এবং দায়িত্বশীল। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ড এই দায়িত্বের অপূর্ণতার প্রমাণ। আমাদের প্রয়োজন কঠোর নিয়ন্ত্রণ, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একটি দেশের সত্যিকারের সম্পদ হলো তার মানুষ। আর মানুষ তখনই সৃজনশীল, উৎপাদনশীল হয়, যখন তারা নিরাপদ। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ড আমাদের সেই মূল সত্যটি ভুলিয়ে দেয় এবং প্রতিবার যখন আমরা ভুলি, আমরা শুধু জীবন হারাই না, হারাই আমাদের ভবিষ্যৎ।

মুহম্মদ গোলাম রাব্বি

শিক্ষার্থী, পরিসংখ্যান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়