মানব রচিত আইন থেকে শরিয়া আইন উত্তম
মুহাম্মদ জামাল উদ্দিন
প্রকাশ : ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মানুষকে সুষ্ঠ, সুন্দর, স্বাধীন এবং সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য যে নিয়মণ্ডকানুন তৈরি ও প্রয়োগ করা হয় তাকে আইন বলে। এই পৃথিবীতে আইন দুইভাবে সৃষ্টি হয়েছে যথা- ১. স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত আইন ২. মানব রচিত আইন। শরিয়া আইন আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামের অপরিহার্য আইন। মুসলমানদের একমাত্র নির্ভরযোগ্য আইন হচ্ছে শরিয়া আইন, যা কোরআন ও হাদীসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইসলামী শরিয়া আইন হলো- একটি জীবন পদ্ধতি ও ধর্মীয় অনুশাসন যা মুসলমানদের ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে সঠিক নির্দেশনা প্রদান করে। শরিয়া আইনের মূলভিত্তি হলো- পবিত্র কোরআন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ। শরীয়ার আইনের উদ্দেশ্য হলো মানুষকে আল্লাহর নির্দেশিত পথে জীবনযাপন করতে সাহায্য করা। মানুষের সার্বিক কল্যাণকামিতাই শরীআতের মূল উদ্দেশ্য। ইসলামি শরীয়া আইনের ভিত্তি হলো আইন সকলের জন্য সমান। এই আইনে ধনী-গরিব, রাজা-প্রজা সকলের জন্য আইন সমান। যার ফলে, শরীয়া আইন মুসলিম উম্মাহকে একসূত্রে গেঁথে রাখে।
ইসলামি আইন শরীয়াকে অস্বীকার করা মানে আল্লাহর আইন, স্বার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্বকে অস্বীকার করা। শরীয়া আইন মানার অর্থ আল্লার আইন কাঠামোকে মানা। শরীয়া আইন অমান্য করা মানে তাওহীদ ও রিসালাতের মূল নীতির পরিপন্থি। পৃথিবীতে মানুষের তৈরি আইন পরিবর্তনশীল আর শরীয়া আইন অপরিবর্তনশীল। শরীয়া আইন আল্লাহ প্রদত্ত আইন। মানুষের হাত দেওয়ার ক্ষমতা নেই। পশ্চিমা আইন তথা মানুষের তৈরি আইনে ওকিল কেনা যায় এবং অর্থ দিয়ে রায়কে প্রভাবিত করা যায়। পশ্চিমা আইন ধনী ও গরিবের মধ্য বৈষম্য সৃষ্টি করে। ধনীরা গরিবের চেয়ে অধিক আইনি সুবিধা ভোগ করে। শরীয়া আইন ঐশ্বরিক বিধান এখানে ওকিলের কোনো ভূমিকা নেই। কারণ হলো- বিচারের রায় আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। কোন অপরাধের জন্য কি শাস্তি প্রয়োগ করতে হবে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। পশ্চিমা আইনে রাষ্ট্রপ্রধান ইচ্ছা করলে যে কোনো অপরাধীকে ক্ষমা করতে পারে। শরীয়া আইনে বাদী কোন অপরাধীকে ক্ষমা করে দিলে ও কাজী বা বিচারক তাকে দণ্ডিত করতে পারেন। পশ্চিমা আইন হল গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়ার মত। শরীয়া আইন না থাকার কারণে মানুষ আইনকে তুয়াক্কা করছে না, যখন তখন আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। নানা রখম দুর্নীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে নীরহ জনগণ। ঘুষ ব্যতিত অফিস আদালতে কোনো কাজ হচ্ছে না। শরীয়া আইনে না থাকার ফলে মানুষ ন্যায় বিচার হতে বঞ্চিত হচ্ছে। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, তুমরা যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর আইন মানবে না ততক্ষণ পর্যন্ত শান্তি পাবে না। চুরি-ডাকাতি, মারামারি-হানাহানি, খুন-ধর্ষণ লেগে থাকবে। যদি এ দেশে সুষ্ঠু সুন্দর ইসলামী শরীয়া আইন ও আইনের প্রয়োগ থাকত তাহলে চুরি-ডাকাতি, খুন-ধর্ষণ, রাহাজানি, দুর্নীতি ও টাকা পাচার বন্ধ হয়ে যেত।
কোরআনের আইন ও বিধিবিধান মানা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ। আর নবীর আদর্শ অনুসরন এবং ওনার দেখানো পথ অনুসরণ করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য সুন্নত। শরীয়াকে বলা হয় ইসলামি অনুশাসন। ইসলামি শরীয়া আইনের মূল কথা হলো আল্লার জমিনে আল্লার আইন চালু করা। তাই ইসলামি শরীয়াকে সবাইকে অবশ্যই পালন করতে হবে। এ সম্পর্কে আল্লাহপাক কোরআনে বলেন, আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য জীবন বিধান (শরীয়ত) ও সুস্পষ্ট জীবন যাপন প্রনালী (মানহাজ) নির্ধারন করে দিয়েছি (সূরা মায়েদা-৪৮)। স্থান-কাল, বর্ন-গৌত্র নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য এই জীবন বিধান (শরীয়ত) ও সুস্পষ্ট জীবন প্রনালী (মানহাজ) অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
আল্লাহতায়ালা বলেন, তিনি তোমাদের জন্য সেই কিতাব (শরীয়ত) দিয়েছেন যা দিয়েছি নূহুকে এবং একই (কিতাব) শরীয়ত আমি ইব্রাহিম, মুসা ও ঈসাকে দিয়েছিলাম, বলেছিলাম দ্বীন কায়েম করো, এ নিয়ে মতবিরোধ করোনা (সূরা-শুরা-১৩)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, আমি আমার রাসূলদের প্রেরণ করেছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সঙ্গে দিয়েছি কিতাব ও মিজান (ন্যায়দণ্ড)। যাতে মানুষ ইনসাফের সঙ্গে চলতে পারে। আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত বিধান দিয়ে রাষ্ট্র চালানো বা বিচার-ফয়সালা করা তাওহীদে রুবূবীয়্যাতের অন্তর্ভুক্ত। যে ব্যক্তি আল্লাহর আইন দিয়ে বিচার করে না; বরং অন্যের বিধান দ্বারা বিচার-ফায়সালা করতে চায়, তাদের ব্যাপারে কোরআনের আয়াতগুলো দু’ভাগে বিভক্ত। প্রথম প্রকারের আয়াতে তাদের ঈমানহীন (মুনাফিক) দ্বিতীয় প্রকারের আয়াতে কাফির, জালেম ও ফাসিক বলা হয়েছে। ইসলাম হচ্ছে- একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। এই বিধান ও দ্বীনকে ব্যক্তিগত জীবন, সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবনে পালন করতে হবে। একজন মুসলমান হিসেবে ইসলামী শরীয়ত তথা ইসলামি অনুশাসনকে মানতে হবে। শুধুমাত্র নামাজ, রোজা, হজ আদায় করলে পরিপূর্ণ মুমিন মুসলমান হওয়া যায় না। মানুষকে পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়ার জন্য ইসলামি দ্বীন ও জীবন বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে হবে। পৃথিবীতে ইসলামি শাসনব্যবস্থা হচ্ছে উত্তম শাসনব্যবস্থা। যা অন্য কোনো শাসনব্যবস্থা (গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র) মানুষকে মুক্তি ও শান্তি দিতে পারেনি। ইসলামি শরীয়া আইন জীবনের সখল ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করে।
আরব দেশের আইনের কথাই ধরুন, আরবদেশের আইন হচ্ছে কোরআনের আইন। ওখানে ধনী-গরিব সবার জন্য আইন সমান। সেজন্য আইনের প্রতি তারা খুবই শ্রদ্ধাশীল। আরবরা অন্যায়ভাবে মানুষ খুন করে না, কারণ শরীয়া আইনে খুনের বদলে খুন করা হয়। ওরা চুরি করে না, হাত কাঁটার শাস্তির ভয়ে। অথচ আমাদের দেশে চুরি-ডাকাতি, দুর্নীতি-চাঁদাবাজি- দখলবাজি, খুন-ধর্ষণ নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। টাকা থাকলে আইনকে ঘাইন বানানোর বহু নজির এদেশে রয়েছে। আপনার জায়গা অন্যজন ভোগ দখল করে খাচ্ছে। আপনি কোর্টে মামলা করে ২০ বছরে ও নিজ দখলে আনতে পারছেন না। বরং এতে লাভবান হচ্ছে পুলিশ, ওকিল, মুনসি, পেশকার। মামলার রায় পেতে আপনার পকেটের ১২টা বেজে যাচ্ছে। ততদিন আপনার হায়াতের বাজেট শেষ হয়ে যাচ্ছে। কোনো কারণে আপনার একজন প্রতিবেশীকে অজ্ঞাত কোনো লোক হত্যা করে পেলল। আপনার পকেটে টাকা না থাকলে আপনি মামলা ও চালাতে পারবেন না। আর রায় পেতে সময় লাগবে কয়েক যুগ। ততোদিনে আপনার ভিটা মাটি বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
এটাই হল আমাদের দেশের বর্তমান আইন। এই আইনগুলো ভারত, ব্রিটেন, আমেরিকা থেকে নকল করা। অথচ এদেশে ইসলামি শরীয়া আইন ও অনুশাসন চালু থাকলে সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা হত। সাধারণ মানুষ ন্যায় বিচারের আশায় থানা-পুলিশ ও কোর্ট-কাচারিতে ঘুরে ঘুরে পেরেশানি হতে হত না।
আল কোরআনের আইন ও কোরআনের বিধিবিধান মানা প্রত্যকে মুসলমানের জন্য ফরয। মুসলমান হিসেবে কোরআন সুন্নার বাইরে কোনো আইন মানা বাধ্যতামূলক নয়। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, তিনিই প্রেরণ করেছেন আপন রাসূলকে হেদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে যেন এ দ্বীনকে অপরাপর দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করেন। (সূরা তাওবাহ-১৩.)। আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রত্যেকটি আদেশ পালনে নিহিত আছে মানবকল্যাণ ও শান্তি। পক্ষান্তরে, আল্লাহ ও রাসূল (সা.)-এর প্রত্যেকটি নিষিদ্ধ ও বর্জনীয় কাজের মধ্য নিহিত রয়েছে উভয় জগতে অশান্তি। যা বাস্তবে বর্তমানে দৃশ্যমান ও বিরাজমান। আপনি ঈমান গ্রহণের সময় আল্লাহর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন আমি আসমানি কিতাবকে পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করব এবং সে অনুযায়ী জীবনযাপন করব। আল্লাহকে দেওয়া অঙ্গীকার আপনি ভুলে গেলেন। এদেশ থেকে কোনোদিন খুনখারাবি বন্ধ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত কোরআনের আইন ও ইসলামি অনুশাসন চালু করা হবে না। ইসলামই একমাত্র ধর্ম যে ধর্ম সকল মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে পেরেছে।
পৃথিবীতে অন্যকোনো ধর্ম এতগুলো ন্যায় নীতি আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। আজকে ইসলামি শাসন ও শরীয়াহ আইন না থাকার কারণে দেশের মানুষ ন্যায় বিচার পাচ্ছে না। মানুষ খুন করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতি, লোটপাট, চুরি-ডাকাতি, খুন-ধর্ষণ বন্ধ হচ্ছে না। অথচ ইহুদি-খ্রিস্টান ও তাদের দালালরা এই শরীয়া আইননকে জংলী, বর্বর আইন বলে মিডিয়ায় প্রচার করতেছে। যেটা একজন কাফের মুশরেক বললে শুভা পায়। কিন্তু যখন একজন মুসলমান তাদের সঙ্গে তালমিলিয়ে উগ্র বর্বর আখ্যা দেয়, তখন শুভা পায় না। ইসলাম শুধু পালন করার বিষয় নয়, শুধুমাত্র নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত আদায় করলে ঈমানদার হওয়া যায় না। নিজেকে একজন পরিপূর্ণ মুসলমান হিসেবে দাবি করতে হলে আল্লাহর দেওয়া বিধিবিধান ও রাসূলের সুন্নাতকে মানতে হবে।
আমরা নিজেকে বড় মুসলমান দাবি করি অথচ কোরআনের আইন ও রাসূলের সুন্নাতকে প্রতিষ্ঠা করার কথা বললে মানতে চায় না। আমাদের নবী পাক (সা.) ও সাহাবায় কেরামরা সুন্নত ও পালন করেছেন আবার ইসলামি হুকুমত তথা ইসলামি শাসন ও আল্লাহর শরীয়া আইন প্রতিষ্ঠার করার জন্য একদেশ থেকে অন্য দেশে সফর করেছেন এবং সেখানে ইসলাম প্রচার ও আল্লাহর শাসন কায়েম করেছেন। যেখানে আল্লার আইন ও নবীর সুন্নত থাকবে না সেখানে বেধাতি কাজকর্ম ও নানা রকম অপসংস্কৃতি চালু হবে।
মুহাম্মদ জামাল উদ্দিন
প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
