জুলাই বিপ্লব এবং কিছু কথা

এএম হেলাল

প্রকাশ : ২৩ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রতিটি বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থান এসেছে মানুষের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও সমতার চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা থেকে। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৪ সালের জুলাই মাসটি এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এ মাসেই বাংলাদেশের মানুষ দ্বিতীয়বারের মতো তাদের অধিকার, মর্যাদা এবং স্বাধীনভাবে বাঁচার স্বপ্ন পুনরুদ্ধারে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। দীর্ঘ ১৫ বছরের দমননীতি, গুম, খুন, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে এই আন্দোলনে দেশের আপামর জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাথমিক আন্দোলন থেকে শুরু হয়ে জুলাই মাসে তা রূপ নেয় ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে এক সর্বজনীন গণঅভ্যুত্থানে। শেষপর্যন্ত পতন ঘটে ফ্যাসিস্ট সরকারের, আর সেই ইতিহাসে রক্তের অক্ষরে লেখা হয় হাজারো শহিদের আত্মত্যাগ। বহু মানুষ তাদের হাত-পা, দৃষ্টি কিংবা জীবনযাপনের সক্ষমতা হারিয়ে আজও বয়ে বেড়াচ্ছে সেই বিপ্লবের ক্ষতচিহ্ন।

জুলাই বিপ্লবের কোনো একক নায়ক বা মাস্টারমাইন্ড ছিল না- এটি ছিল জনগণের সার্বজনীন আন্দোলন। সাধারণ মানুষ এই বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিল। এমন এক বাংলাদেশের প্রত্যাশা করেছিল, যেখানে রাষ্ট্র নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করবে, জনগণের সেবা করবে এবং তাদের কাছে জবাবদিহি থাকবে।

মানুষ চেয়েছিল পুরোনো, দুর্নীতিগ্রস্ত ও দমনমূলক রাজনীতির পরিবর্তে এক নতুন ব্যবস্থা যেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে জনগণের সরকার, থাকবে না রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, প্রশাসনে থাকবে স্বচ্ছতা, সততা ও জবাবদিহিতা। তারা আশা করেছিল এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থার, যেখানে ঘুষ, দুর্নীতি, হত্যা, গুম-খুনের মতো অপসংস্কৃতি চিরতরে বিলুপ্ত হবে, আর রাষ্ট্র একবিংশ শতাব্দীর চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এগিয়ে যাবে।

এই নতুন ব্যবস্থায় প্রতিফলিত হবে তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা, উদ্ভাবন ও নেতৃত্বের শক্তি। অস্থির বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করবে দক্ষিণ এশিয়ায় এক উদীয়মান শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। উন্নত পররাষ্ট্রনীতি, ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক গতিশীলতার মাধ্যমে দেশ এগিয়ে যাবে টেকসই উন্নয়নের পথে। তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সুষম ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের মাধ্যমে গড়ে উঠবে একটি মানবিক, সাম্যভিত্তিক ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ- যে বাংলাদেশ হবে সত্যিকার অর্থে ‘নতুন বাংলাদেশ’। জুলাই বিপ্লবের এক বছর পরে এসে মনে হচ্ছে ব্যর্থ হচ্ছে বিপ্লব। বিপ্লবের স্পিরিট একটুও নেই। পুরানো সবকিছু চলমান রয়েছে নতুন রূপে। শুধুমাত্র হাত এবং ব্যক্তি বদল হয়েছে। বিপ্লব পরবর্তী সরকার কাঙ্ক্ষিত কাজ করতে পারেনি। রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্টেক হোল্ডাররা বিপ্লবের স্পিরিট ধারণ করেনি। তারা পুরাতনকেই আঁকড়ে ধরে আছে। তাহলে কি এ বিপ্লব ব্যর্থ হয়ে গেল? ব্যর্থ হতে চলেছে। চলুন এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি। জুলাই বিপ্লব ব্যর্থ বা ব্যর্থ হতে চলেছে তা জানার আগে বিপ্লব কেন ব্যর্থ হয় এ নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক।

প্রথমত, প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তরের অভাব বিপ্লব ব্যর্থতার অন্যতম মূল কারণ। রাজনৈতিক দার্শনিক হান্না আরেন্ট (Hannah Arendt) বলেছেন- ‘সবচেয়ে উগ্র বিপ্লবীও বিপ্লবের পরের দিনই রক্ষণশীল হয়ে ওঠে।’ অর্থাৎ, বিপ্লবের পর যদি পুরনো প্রশাসনিক ও ক্ষমতার কাঠামো অপরিবর্তিত থাকে, তবে নতুন শাসকরাই ধীরে ধীরে পুরনো দমননীতির অংশে পরিণত হয়।

দ্বিতীয়ত, নেতৃত্ব ও জনগণের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বিপ্লবের প্রাণশক্তিকে দুর্বল করে দেয়। সমাজ মনোবিজ্ঞানী ফ্রান্ত্জ ফ্যানন (Franty Fanon) এবং শিক্ষাচিন্তাবিদ পাওলো ফ্রেইরে (Paulo Freire) উল্লেখ করেছেন যে, বিপ্লব ব্যর্থ হয় যখন নেতৃত্ব সাধারণ মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দূরে সরে যায় এবং নতুন ক্ষমতাবান শ্রেণি পুরনো শোষণের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।

তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর অটুটতা বিপ্লবের ফল সীমিত করে। কার্ল মার্ক্স (Karl Marx) লিখে ছিলেন- ‘মানুষ নিজের ইতিহাস তৈরি করে, কিন্তু নিজের ইচ্ছামতো নয়।’ অর্থাৎ, সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি যদি অপরিবর্তিত থাকে, তবে রাজনৈতিক পরিবর্তন কেবল উপরের স্তরে প্রভাব ফেলে, নিচের জনগণের জীবনে নয়।

চতুর্থত, আদর্শিক বিভাজন ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রায়ই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে ঐক্যের ভাঙন ঘটায়। ক্ষমতার ভাগাভাগি, ব্যক্তিস্বার্থ ও মতবিরোধ আন্দোলনের মূল উদ্দেশকে ক্ষীণ করে দেয়। ফলে যে ঐক্য একসময় পরিবর্তনের চালিকাশক্তি ছিল, সেটিই পরে দুর্বলতার কারণ হয়। উপরোক্ত বিষয়গুলো সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে কেন বিপ্লব ব্যর্থ হয় এ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বিষয়গুলোকে যদি আপনি বাংলাদেশের বিপ্লব পরবর্তী সময়ের সঙ্গে মূল্যায়ন করেন তাহলে দেখবেন অধিকাংশগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। এবার চলুন সমসাময়িক পেক্ষাপটে আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করি কেনো বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব অভ্যুত্থান ব্যর্থ হতে চলেছে বা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন, দুর্বলতা ও উপদেষ্টা পরিষদের বিতর্ক ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর আগস্ট মাসে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন বিশ্ববরেণ্য নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনূস, যিনি জাতির কাছে দীর্ঘদিন ধরে স্বচ্ছতা, মানবিকতা ও সামাজিক উদ্যোক্তা চেতনার প্রতীক ছিলেন। দল-মত নির্বিশেষে দেশের সর্বস্তরের জনগণ তার নেতৃত্বে রাজনৈতিক পরিবর্তন ও প্রশাসনিক সংস্কারের এক নতুন যুগের প্রত্যাশায় বিভোর হয়ে ওঠে। মানুষ বিশ্বাস করেছিল- ড. ইউনূসের হাত ধরেই শুরু হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুণগত পরিবর্তন এবং জন্ম নেবে ‘নতুন বাংলাদেশ’। ড. ইউনূস সেই প্রত্যাশার প্রেক্ষিতে একদল উপদেষ্টা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন। উপদেষ্টা পরিষদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাব ছিল স্পষ্ট; অনেক সদস্যই দলীয় সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন, যার ফলে জুলাই বিপ্লবের মূল স্পিরিট ও আদর্শ ব্যাহত হয়েছে। তাছাড়া অনেকেই একসময় এনজিও, উন্নয়ন সংস্থা বা একাডেমিক খাতে সক্রিয় ছিলেন। বর্তমানে এই উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সংখ্যা ৩৬ জন। তবে উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে শুরু থেকেই নানারকম বিতর্ক ও গুঞ্জন ছিল। অভিযোগ রয়েছে, ইউনূস অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত পছন্দের মানুষদের নিয়োগ দিয়েছেন, যার ফলে প্রশাসন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় অভিজ্ঞতার ঘাটতি থেকে গেছে। অনেক উপদেষ্টা এনজিও সংশ্লিষ্ট, আবার অনেকেই রাষ্ট্রীয় প্রশাসন বা রাজনৈতিক বাস্তবতায় অভিজ্ঞ নন।

এএম হেলাল

রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রফেশনাল