বাড়ছে নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড, মানবতা হারিয়ে যাচ্ছে অকাতরে

নাজিয়াত আক্তার

প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

৫ আগস্ট ২০২৪ বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিনটি এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। রাজনৈতিক পরিবর্তনের ঢেউয়ে দেশ এগিয়ে গেলেও, সমাজে যেন অন্ধকার নেমে এসেছে এক ভিন্ন রূপে। প্রতিদিন খবরের শিরোনামে দেখা যায় পৈশাচিক খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন আর অমানবিক সহিংসতার ঘটনা।

মনে হয়, মানবতার আলো নিভে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তারই এক তাজা উদাহরণ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ১৫তম ব্যাচের (২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ) শিক্ষার্থী জুবায়েদ হোসাইন রাজধানীর আরমানিটোলায় এক নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে (১৯ অক্টোবর ২০২৫ রোববার) ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। দুর্বৃত্তরা হত্যার পর লাশ ফেলে রেখেছে, অপরাধীদের শনাক্ত করতে পুলিশের ছিল নানা বিলম্ব। এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে গত কয়েক মাসের।

রাজনৈতিক পালাবদলের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি ঘটছে। অপরাধ দমন নয়, বরং অপরাধীরা এখন যেন আরও বেপরোয়া। একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে অকাতরে- কখনও সামান্য বিরোধে, কখনও নারী ও শিশুর উপর নৃশংস হামলায়, আবার কখনও রাজনৈতিক প্রতিশোধে। এই নির্মমতার আগুনে পুড়ছে সমাজের নৈতিক ভিত্তি।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবেদন বলছে, আগস্ট থেকে নভেম্বর ২০২৪-এর মধ্যে খুন ও সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। চাঁদাবাজির কারণে নিরীহ ব্যক্তিকে রাস্তায় প্রকাশ্যে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখা হচ্ছে, ধর্ষিতার শিকার হচ্ছে নারীরা বেপরোয়াভাবে যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে নতুন বাংলাদেশ গঠনে অংশগ্রহণ করা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া নারী শিক্ষার্থীরা। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা বিচারও পাচ্ছেন না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা কমে গেছে, অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেরি হচ্ছে, ফলে অপরাধীরা আরও উৎসাহ পাচ্ছে। যেন মানুষের প্রাণের কোনো মূল্যই আর নেই।

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো- এই পৈশাচিকতার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষও। কোনো অপরাধ ঘটলে বিচার না পেয়ে লোকজন নিজেরাই হাতে তুলে নিচ্ছে আইন। মব লিন্চিং, গণপিটুনি, সামাজিক বিদ্বেষ- সব মিলিয়ে সহিংসতার এক ভয়াবহ সংস্কৃতি জন্ম নিচ্ছে। সমাজে যে মানবিকতা, সহানুভূতি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ একসময় ছিল, তা যেন এখন বিলুপ্তপ্রায়।

অন্যদিকে, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। ধর্ষণ ও নির্যাতনের পর হত্যা এখন প্রায় নিয়মিত সংবাদ। এই নির্মমতার মধ্যে শুধু ভুক্তভোগীর জীবন নয়, ধ্বংস হচ্ছে একেকটি পরিবারের ভবিষ্যৎ। সমাজে নিরাপত্তাহীনতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মানুষ এখন ভয়ে নিজের সন্তানকে স্কুলে পাঠায়, কর্মস্থলে যায়, কিংবা রাতে বাইরে বের হতে ভয় পায়।

মানবতা হারিয়ে যাচ্ছে- এ কথাটি এখন শুধু সাহিত্যিক বাগধারা নয়, বরং বাস্তবতার প্রতিফলন। আমরা যেন ভুলে যাচ্ছি করুণা, ক্ষমা ও সহানুভূতির মূল্য। এই অন্ধকার থেকে বের হতে হলে রাষ্ট্রকে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে, অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে হবে দ্রুত ও নিরপেক্ষভাবে। পাশাপাশি, আমাদের সমাজকেও ফিরিয়ে আনতে হবে মানবিকতার পথে।

পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমকে একযোগে কাজ করতে হবে নৈতিকতা ও সহমর্মিতা গড়ে তুলতে। কারণ, যদি আমরা এখনই সচেতন না হই, তাহলে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ে উঠবে না স্বপ্নের আলোয়, বরং রক্ত ও শোকের ছায়ায়।

আজ সময় এসেছে প্রশ্ন করার আমরা কি সত্যিই স্বাধীন ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ছি, নাকি এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে মানুষের জীবন, মানবতা আর কোনো মূল্যই রাখে না? মানবিকতার আলো ফিরিয়ে আনাই এখন সবচেয়ে বড় সংগ্রাম।

নাজিয়াত আক্তার

সদস্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ফিচার কলাম অ্যান্ড কনটেন্ট রাইটার্স