জাতিসংঘ শান্তির দূত নাকি ক্ষমতার দাস

মো. রাহুল শেখ

প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা মানব ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসলীলার পর বিশ্ব যখন এক চরম অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়ে, তখন ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর এই সংস্থা আলোর দিশারী হিসেবে আবির্ভূত হয়। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা ছিল এক স্বপ্নময় উদ্যোগ, যা এক বিধ্বস্ত পৃথিবীতে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতার নতুন হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আশায়।

আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষা করা, মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার মতো মহান লক্ষ্যগুলো নিয়ে গঠিত এই সংঘ তৎকালীন বিশ্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর আশার সঞ্চার ঘটিয়েছিল। পুরো বিশ্ব তখন এই সংস্থার দিকে তাকিয়েছিল এক ন্যায্য ও সমতার পৃথিবী প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশায়। কিন্তু আজকের এই দিন পর্যন্ত সেই প্রত্যাশা কতটা পূরণ হয়েছে, তা এক কঠিন প্রশ্ন। আজকের বিশ্বে জাতিসংঘের কার্যক্রম কি সত্যিই বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামগ্রিক স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে, নাকি এটি কেবল ধনী ও শক্তিধর দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষার এক সুবিশাল হাতিয়ার মাত্র?

জাতিসংঘের কাঠামো বিশ্লেষণ করলেই এই বিতর্কটির বীজ খুঁজে পাওয়া যায়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ, অছি পরিষদ, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত এবং সচিবালয়সহ মোট ছয়টি প্রধান অঙ্গসংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত। এরমধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রবিন্দু হলো নিরাপত্তা পরিষদ। প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকেই এই পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদ লাভ করে বিশ্বের পাঁচ গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া এবং ফ্রান্স। এই পাঁচ স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে যে কোনো সিদ্ধান্তকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য ‘ভেটো’ প্রদানের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। এই ভেটো ব্যবস্থা শুধু যে তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে ব্যবহৃত হয় তা নয়, বরং তাদের মিত্র রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থকেও প্রাধান্য দিতে গিয়ে এর অপব্যবহার করা হয়। এর ফলস্বরূপ, অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত কণ্ঠস্বর অনেক সময়ই এই ক্ষমতার দাপটে নীরব হয়ে যায়, যা আন্তর্জাতিক সমতার নীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থি। এই স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড বিশ্বের ইতিহাসে বহুবার কালো অধ্যায়ের সাক্ষ্য বহন করেছে। সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণগুলোর একটি হলো ২০০৩ সালের ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে এবং নিরাপত্তা পরিষদের সুস্পষ্ট অনুমোদন ছাড়াই বিশ্বের মানচিত্রে অবস্থান করা স্বাধীন রাষ্ট্র ইরাকে অভিযান চালায়। নিরাপত্তা পরিষদের অন্যান্য সদস্য দেশ এই অভিযানের বিরোধিতা করলেও, ভেটো ব্যবস্থার ফাঁক গলে ধনী দেশগুলো তাদের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে, আফ্রিকার ক্ষুদ্র এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া রাষ্ট্রগুলোতে সামান্য অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হলেও জাতিসংঘের তাৎক্ষণিক কড়া পদক্ষেপ অনেক ক্ষেত্রে নিজস্ব স্বকীয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। এই বৈষম্যমূলক আচরণই প্রমাণ করে যে, জাতিসংঘের কাঠামো ও কার্যপদ্ধতি ঐতিহ্যগতভাবে ধনী রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থের অনুকূলে পরিচালিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে চলমান ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন যুদ্ধ জাতিসংঘের কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্কের আগুনে যেন ঘি ঢেলেছে। ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে ফিলিস্তিনের নিরীহ নারী, শিশু এবং বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধের যথাযথ নিয়মকে অমান্য করে নিজেদের স্বেচ্ছারিতার মাধ্যমে এই গণহত্যা জারি রাখা হয়েছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব যতবার উত্থাপন করা হয়েছে, ঠিক ততবারই ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো প্রদানের মাধ্যমে তা ভন্ডুল হয়েছে। এ ধরনের নজির দেখিয়ে ধনী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় আন্তর্জাতিক মঞ্চকে ব্যবহার করে অন্যান্য ক্ষুদ্র দেশগুলোকে শোষণ করে যাচ্ছে। একইভাবে, দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেও জাতিসংঘ শুধুমাত্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে, যা এর নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারার ব্যর্থতাকে স্পষ্ট করে তোলে।

মো. রাহুল শেখ

শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা