নিরপেক্ষতার সংকট ও ক্ষমতার মনোবিজ্ঞান

মো. শামীম মিয়া

প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের রাজনীতির মঞ্চে হঠাৎ যেন এক অদৃশ্য ঝড় বইছে। জুলাই জাতীয় সনদে ঐকমত্য, ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত জাতীয় নির্বাচন এবং তার আগেই উপদেষ্টামণ্ডলীকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া বিতর্ক- সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে। রাজনীতি, প্রশাসন, গণমাধ্যম, এমনকি নাগরিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এখন এই প্রশ্ন- অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা আসলে কারা? তারা কতটা নিরপেক্ষ? এবং তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা দেশের আসন্ন গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য কতটা হুমকিস্বরূপ? প্রশ্নগুলোর উত্তর যতটা অস্পষ্ট, তার চেয়েও বেশি গভীর এদের অন্তর্নিহিত অর্থ। কারণ, যখন ক্ষমতার ভারসাম্য অস্থির থাকে, তখন প্রতিটি পদ, প্রতিটি ব্যক্তি হয়ে ওঠে একটি রাজনৈতিক সংকেত- একটি দিকনির্দেশনা, যার ব্যাখ্যা নির্ভর করে কে সেটা দেখছে এবং কোনো অবস্থান থেকে দেখছে।

এই বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছিল একেবারে নীরবে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বলেন, জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পর থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা একধরনের প্রশাসনিক ও নীতিনির্ধারণী প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন। কারও সঙ্গে কারও রাজনৈতিক অতীত, কারও সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগাযোগ বা নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু অনানুষ্ঠানিক যোগসূত্র- সব মিলিয়ে এক অস্বস্তিকর সন্দেহ তৈরি হয়। যদিও সরকারিভাবে কোনো নাম প্রকাশ হয়নি, কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো খোলামেলাভাবে ইঙ্গিত দিতে শুরু করে, এমনকি কেউ কেউ সরাসরি হুমকি দেন- ‘নাম চাইলে আমরা প্রকাশ করব।’ এই অবস্থায় জনগণের চোখে সরকার ও প্রশাসনের নিরপেক্ষতা এক অনিশ্চয়তার ঘেরে পড়ে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে উপদেষ্টা পদ কখনই নিছক প্রশাসনিক দায়িত্ব ছিল না। ১৯৯০-এর পর থেকে যতবারই অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক ধাঁচের সরকার গঠিত হয়েছে, উপদেষ্টারা সবসময়ই থেকে গেছেন ক্ষমতার অক্ষের কেন্দ্রে। তারা যেমন নীতি নির্ধারণ করেন, তেমনি নির্বাচন প্রক্রিয়া, প্রশাসনিক নিয়োগ, এবং কখনও কখনও বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনাতেও অংশ নেন। ফলে এই পদে থাকা ব্যক্তিরা শুধু প্রশাসনিক নয়- নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ থাকার দায়িত্ব বহন করেন। কিন্তু ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, এ নিরপেক্ষতা সহজে রক্ষা করা যায় না। কারণ, ক্ষমতার নিকটে গেলে নিরপেক্ষতাও রাজনীতির এক প্রকার মুদ্রা হয়ে ওঠে- যা প্রয়োজনে কেউ ভাঙায়, কেউ লুকিয়ে রাখে, আবার কেউ তা দিয়ে প্রভাবের দাম মেটায়।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি একযোগে যেভাবে উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে, তা কোনো সাধারণ রাজনৈতিক কৌশল নয়। এই তিনটি দলই শুরুতে অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বাগত জানিয়েছিল। তারা দাবি করেছিল, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি নিরপেক্ষ প্রশাসন দেশের রাজনীতিতে আস্থা ফিরিয়ে আনবে। কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই তারা বলছে, সরকারের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক পক্ষপাত কাজ করছে। কেউ বলছে- উপদেষ্টারা রাষ্ট্র সংস্কারের অজুহাতে নির্বাচন বিলম্বিত করতে চান; কেউ বলছে- তারা নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ রাখছেন; আবার কেউ বলছে- নির্বাচন বানচালের জন্য প্রশাসনের অংশ বিশেষকে নিজেদের প্রভাববলয়ে এনেছেন। ফলে প্রশ্ন উঠছে- এই অভিযোগগুলো কি শুধুই রাজনীতির নাট্যরূপ, নাকি সত্যিই এর ভেতরে লুকিয়ে আছে ক্ষমতার পুনর্বিন্যাসের গোপন পরিকল্পনা?

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, নির্বাচনের আগে এ ধরনের বিতর্কের জন্ম একধরনের কৌশলও হতে পারে। নির্বাচনের প্রাক্কালে যেকোনো সরকারকেই বিরোধী দলগুলো সন্দেহের চোখে দেখে, কারণ এটাই রাজনৈতিক চর্চার অংশ। কিন্তু এবার পার্থক্য হলো- সরকারের ভেতর থেকেই বিতর্কের জন্ম হয়েছে। উপদেষ্টারা সরাসরি কোনো দলভুক্ত না হলেও, তাদের মধ্যে কয়েকজনের অতীত পরিচয়, ব্যবসায়িক পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা সামাজিক সংযোগ রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট বলে গণ্য হচ্ছে। ফলে জনগণের মনে প্রশ্ন- যদি উপদেষ্টারা নিজেরাই বিতর্কিত হন, তবে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত কাকে বিশ্বাস করা যায়? রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এ প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেন- রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা মূলত ব্যক্তির নিরপেক্ষতার ওপর নির্ভর করে না, বরং কাঠামোর নিরপেক্ষতার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামো এমন যে, উপদেষ্টারা নিজেরাই প্রশাসনের নিয়ন্ত্রক এবং একসঙ্গে নীতি নির্ধারক। ফলে তারা কাঠামোর অংশও, নিয়ামকও। এই দ্বৈত অবস্থান থেকেই সমস্যা শুরু হয়। কোনো একটি পদক্ষেপ যদি জনগণ বা রাজনৈতিক দল বিশেষের স্বার্থে মনে হয়, তবে তার দায় গোটা সরকারের ওপর বর্তায়। ফলে এক বা দুইজন উপদেষ্টার বিতর্কই সরকারকে সম্পূর্ণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে পারে।

বিতর্কের কেন্দ্রে এসেছে আরও কিছু অভিযোগ। যেমন- প্রশাসনে ডিসি ও এসপি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়োগে রাজনৈতিক কোটা কার্যকর হচ্ছে, নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য কিছু দল প্রশাসনের তালিকা তৈরি করছে, এমনকি উপদেষ্টাদের মাধ্যমে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচার হচ্ছে। এসব অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়নি, কিন্তু গণবিশ্বাসের ক্ষতি এরইমধ্যে হয়েছে। প্রধান দলের কেউ বলছে, সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতিতে নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখছে না; কোনো দল বলছে, কিছু উপদেষ্টা গোপনে নির্বাচনের সময় বাড়াতে চাইছেন; অন্য দল বলছে, প্রশাসনের ভাগ-বাঁটোয়ারা হচ্ছে রাজনৈতিক দলের স্বার্থে। অন্যদিকে সরকার বা প্রধান উপদেষ্টা এসব বিষয়ে নীরব। এই নীরবতাই এখন হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বড় বিতর্ক।

রাজনীতিতে নীরবতা কখনও কখনও অভিযোগের চেয়েও শক্তিশালী সংকেত দেয়। ইতিহাস বলছে, ক্ষমতাসীন যেকোনো প্রশাসন যখন অভিযোগের মুখে নীরব থাকে, তখন জনগণ ধরে নেয়- অভিযোগে অন্তত কিছু সত্য আছে। উপদেষ্টাদের ক্ষেত্রে সেই সন্দেহ আরও তীব্র, কারণ তারা সরাসরি নির্বাচিত নয়, বরং নিযুক্ত। ফলে জনগণের কাছে তাদের জবাবদিহিতা প্রশাসনিক নয়, নৈতিক। আর সেই নৈতিক বিশ্বাসটাই এখন টলে গেছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘উপদেষ্টাদের মধ্যে কয়েকজনের কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। তাদের অবিলম্বে সরানো না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।’ এই মন্তব্যের ভেতরেই লুকিয়ে আছে রাজনৈতিক বাস্তবতার কঠিন সত্য- সরকারের নিরপেক্ষতা যতটা প্রশাসনিক নয়, তার চেয়ে বেশি প্রতীকী এবং সেই প্রতীকী আস্থা ভেঙে গেলে নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা আর থাকে না। অন্যদিকে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, ‘বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির অভিযোগগুলো পুরোপুরি অমূলক নয়, কিছু ক্ষেত্রে পাল্টা কৌশল হিসেবেও বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে।’ অর্থাৎ, রাজনীতিতে কখনও কখনও অভিযোগই হয়ে ওঠে প্রতিরক্ষার অস্ত্র। যে যত বেশি অভিযোগ তুলবে, সে তত বেশি নিজেকে নিরপেক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারবে। কিন্তু এর ফলে জনগণ বিভ্রান্ত হয় এবং আস্থা হারায় গণতন্ত্রের ওপর। বর্তমান পরিস্থিতি এমন যে, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অবস্থান রক্ষায় একে অন্যকে সন্দেহ করছে এবং সেই সন্দেহের বলি হচ্ছে রাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতা। একদিকে সরকার বলছে, নির্বাচন নির্ধারিত সময়েই হবে; অন্যদিকে বিরোধীরা বলছে, নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্ন সমাধান না হলে নির্বাচন হবে না। এই দুই মেরুর টানাপোড়েনে দাঁড়িয়ে আছে উপদেষ্টারা- যারা নীতিগতভাবে নিরপেক্ষ, কিন্তু বাস্তবে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কেন্দ্রবিন্দু। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিতর্কের লাভ কার? কেউ কেউ বলছেন, এটা সরকারের জন্য ক্ষতিকর, কারণ নিরপেক্ষতার ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। আবার কেউ বলছেন, এটা সরকারেরই কৌশল- বিতর্ক সৃষ্টি করে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে বিভাজন বাড়ানো। কারণ, যখন বিরোধীরা একে অন্যকে সন্দেহ করতে শুরু করে, তখন সরকারের জন্য নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। কিন্তু এই রাজনীতি টেকসই নয়। ইতিহাসে দেখা গেছে, অবিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে কোনো রাজনৈতিক স্থিতি দীর্ঘদিন টেকে না।

মো. শামীম মিয়া

শিক্ষার্থী, ফুলছড়ি সরকারি কলেজ ও কলামিস্ট, আমদিরপাড়া, জুমারবাড়ী, সাঘাটা, গাইবান্ধা