সহিংসতার লাগাম টানুন

প্রকাশ : ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দেশজুড়ে ক্রমবর্ধমান হত্যাকাণ্ড, সহিংসতা, গুজব ও অপরাধের বিস্তার একদিকে উদ্বেগের, অন্যদিকে এক গভীর সামাজিক অবক্ষয়ের ইঙ্গিত বহন করছে। গত শুক্রবার প্রকাশিত অন্তত চারটি প্রতিবেদনেও সেই ভয়াবহতার মাত্রা উঠে এসেছে। হত্যা, ডাকাতি, সংঘর্ষ ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার এই ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়েছে এবং মানুষের জীবন আজ চরম ঝুঁকির মুখে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণে’ থাকার দাবি করার সুযোগ যেন দিন দিন কমে আসছে।

সাভার, খুলনা, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে পারিবারিক কলহ, জমি নিয়ে বিরোধ কিংবা আধিপত্য বিস্তারের মতো কারণেই কয়েক দিনের ব্যবধানে অন্তত ছয়জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এই হত্যাগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এগুলো সমাজে ক্রমবর্ধমান সহিংস প্রবণতারই বহিঃপ্রকাশ। সামান্য তর্কবিতর্ক কিংবা সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব এখন সহজেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিচ্ছে। এর পেছনে পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েন, আইনের শাসনে দুর্বলতা ও সামাজিক নৈতিকতার অবক্ষয় গভীরভাবে জড়িত।

খুলনায় পারিবারিক কলহের জেরে স্ত্রীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা কিংবা চারঘাটে জমি নিয়ে ভাতিজাদের হাতে চাচা খুন সমাজের ভেতরে জমে থাকা অসহিষ্ণুতা ও সম্পর্কের চরম অবনতির ভয়াবহ উদাহরণ। বিশেষত, সিরাজগঞ্জে নাতির হাতে দাদি খুন হওয়ার ঘটনাটি কেবল অপরাধ নয়, এটি নৈতিকতার চরম স্খলন ও মানসিক অসুস্থতার ইঙ্গিতবাহী। সমাজে বিদ্যমান সহনশীলতার অভাব এবং দ্রুত বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি এই সহিংসতাকে যেন আরও উসকে দিচ্ছে। অন্যদিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে নির্দিষ্ট কিছু অপরাধের বিরুদ্ধে নিয়মিত পুলিশি অভিযানও যথেষ্ট ফলপ্রসূ হচ্ছে না। ঘনবসতিপূর্ণ এই এলাকায় মাদক ব্যবসা একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরাও সক্রিয়। শীর্ষ মাদক কারবারিরা বারবার গ্রেপ্তার হলেও জামিনে বেরিয়ে এসে ফের সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ডে জড়াচ্ছে। ককটেল বিস্ফোরণে তরুণ নিহত হওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে যে এই এলাকা এখন সাধারণ মানুষের জন্য মৃত্যুফাঁদ। পুলিশের নিয়মিত অভিযান সত্ত্বেও অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার এই প্রবণতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, এর দায় পুলিশকেই নিতে হবে। অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে জামিন বাতিল নিশ্চিত করা এ ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যক। এছাড়া রংপুরের তারাগঞ্জে হিমাগারে পরিকল্পিত ডাকাতি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও দুর্বল দিক উন্মোচন করে। ঘটনাটি গ্রামীণ অর্থনীতিতেও নিরাপত্তাহীনতার বাড়বাড়ন্তের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বগুড়ায় গুজবকে কেন্দ্র করে সংঘটিত অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা আরো ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। এটি প্রমাণ করে সমাজে বিশ্বাস, সহনশীলতা ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কতটা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে।

এসব ধারাবাহিক ঘটনার সারমর্ম একটিই অপরাধ, সহিংসতা ও অনিশ্চয়তা এখন দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। পরিবার থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লা, শহর থেকে গ্রাম সবখানেই ক্রোধ ও প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি এখন প্রয়োজন সামাজিক পুনর্গঠন, পারিবারিক বন্ধন পুনরুদ্ধার ও মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষার প্রসার। নতুবা এই সহিংসতা আমাদের সমাজকে এক গভীর অন্ধকারে ঠেলে দেবে, যেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন হয়ে পড়বে।