হারিয়ে যাচ্ছে শহরের মানবতা

আরিফুল ইসলাম রাফি

প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ভোরে শহর জেগে ওঠে ইঞ্জিনের গর্জনে, গাড়ির হর্নে, মানুষ ছুটে যায় অফিসে, বাজারে, স্কুলে। সবাই ব্যস্ত, তাড়াহুড়ো করে চলেছে কোনো লক্ষ্যহীন যাত্রায়। একসময় এই শহরগুলো ছিল মানুষের মিলনের জায়গা পাড়ার আড্ডা, বাড়ির সামনে গাছতলায় গল্প, একে অপরের খোঁজ নেওয়া, এক কাপ চা ভাগাভাগি করা ছিল প্রতিদিনের রুটিন। কিন্তু এখন শহর যেন ইস্পাতের এক অরণ্য; দালান বেড়েছে, মানুষ ছোট হয়েছে। এ শহরে আজ আলো আছে, শব্দ আছে; কিন্তু মানবতার উষ্ণতা ক্রমেই নিভে যাচ্ছে।

শহর একসময় ছিল মানুষের তৈরি সমাজ, এখন তা হয়ে গেছে মানুষের তৈরি মেশিন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রযুক্তির বিকাশ, আর প্রতিযোগিতার চাপে শহরগুলো পরিণত হয়েছে ‘বেঁচে থাকার বাজারে’। মানুষ এখন আর মানুষ নয়, বরং একেকটি উৎপাদনশীল ইউনিট যার মূল্য তার পেশা, পদ বা আয় দিয়ে মাপা হয়।

সামাজিক সম্পর্কগুলোও এখন লেনদেননির্ভর। পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে, কেউ জানে না; কেউ অসুস্থ হলে খবর জানার সময়ও নেই। শহরের মানুষ ক্রমেই একা হয়ে পড়ছে জনসমুদ্রের মাঝেও। এই নিঃসঙ্গতার মধ্যে মানবিক সম্পর্কগুলো হারিয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে।

শহুরে জীবনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে মূল্যবোধের জায়গায়। আজ কে কত উপার্জন করে, কোন এলাকায় থাকে, কোন গাড়িতে চলে এসবই তার সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণের মানদ-। মানুষের চরিত্র, সততা, বা সহমর্মিতা এগুলো আর তেমন মূল্য রাখে না। এই অর্থকেন্দ্রিক সমাজে মানবতা জায়গা হারাচ্ছে। ফুটপাতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে মানুষ আগে ফোনে ছবি তোলে, সাহায্য পরে করে। দুর্ঘটনায় রক্তাক্ত মানুষকে হাসপাতালে নেওয়ার চেয়ে ভিডিও করা সহজ মনে হয় অনেকের কাছে। এ যেন এক ভয়াবহ সামাজিক অসাড়তা যেখানে দয়া আর সহানুভূতি ‘অপ্রয়োজনীয় দক্ষতা’ হয়ে গেছে।

ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক এই ভার্চুয়াল দুনিয়া মানুষকে দিয়েছে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের সুযোগ; কিন্তু কেড়ে নিয়েছে বাস্তব সংযোগের অনুভব। শহরের তরুণরা এখন শত শত অনলাইন বন্ধুর মালিক; কিন্তু একাকিত্বে পাশে বসার মতো মানুষ নেই। ‘অনলাইন সহানুভূতি’র যুগে সবাই অন্যের দুঃখে মন্তব্য দেয়; কিন্তু নিজের পাড়ার কষ্টের খবর রাখে না। প্রযুক্তি আমাদের সংযুক্ত করেছে স্ক্রিনের মাধ্যমে, বিচ্ছিন্ন করেছে হৃদয়ের ভাষা থেকে।

বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশের শহরগুলো দ্রুত বেড়ে উঠছে গ্রাম থেকে প্রতিদিন মানুষ আসছে জীবিকার খোঁজে। এই নগরায়নের প্রভাবে সৃষ্টি হচ্ছে জনবসতির অতিরিক্ত চাপ, বস্তিবাসীর দুরবস্থা, ট্রাফিক জট, দূষণ, অপরাধ ও মানসিক ক্লান্তি। কিন্তু শহরের নীতি-নির্ধারকরা ‘উন্নয়ন’ বলতে বুঝছেন সড়ক, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল; আর ভুলে যাচ্ছেন মানুষের মানসিক ও নৈতিক উন্নয়ন।

যে শহরে শিশুরা পার্কে খেলতে পারে না, বৃদ্ধরা কথা বলার মানুষ খুঁজে পায় না, যে শহরে কুকুর বা ভিক্ষুকের উপস্থিতি ‘দৃশ্য দূষণ’ মনে হয়; সে শহরে মানবতার অস্তিত্ব টিকবে কীভাবে?

শহরের বাসিন্দারা প্রতিদিন সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে। কাজ, ট্রাফিক, অর্থনৈতিক চাপ, প্রতিযোগিতা সব মিলিয়ে মানুষ ক্রমেই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। নিজের সাফল্যের দৌড়ে অন্যের কষ্ট দেখা যায় না। একজন প্রতিবেশী অসুস্থ হলে সেটা ‘অন্যের বিষয়’, একজন পথশিশু ক্ষুধার্ত থাকলে সেটা ‘রাষ্ট্রের বিষয়’। এই দায় এড়ানোর সংস্কৃতি আমাদের মনকে ধীরে ধীরে নিষ্প্রাণ করে ফেলছে।

যে সমাজে সহানুভূতি কমে, সেখানে মানসিক ভারসাম্যও নষ্ট হয়। শহরে একাকিত্ব, হতাশা, ও উদ্বেগজনিত মানসিক রোগ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। অনেকে আত্মহত্যা করছে, কেউ মাদক বা ভার্চুয়াল জগতে আশ্রয় নিচ্ছে। এর কারণ শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি মানবিক শূন্যতা।

মানুষ এখন কথা বলে না, শোনে না, অনুভব করে না। এ যেন ‘ইমোশনাল বার্নআউট, যেখানে আবেগ ক্লান্ত হয়ে পড়ে, ভালোবাসা ও সহানুভূতি অনুভবের ক্ষমতা হারায়। শহর বড় হচ্ছে, কিন্তু মানুষ ছোট হচ্ছে। রাস্তায় বিলবোর্ডে সামাজিক দায়বদ্ধতার স্লোগান লেখা থাকলেও বাস্তবে সেই দায়বোধ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মানুষ এখন কেবল ভোক্তা; বাজারে, সামাজিক সম্পর্কে, এমনকি মানবিক অনুভূতিতেও। এই অবস্থায় মানবতা টিকে থাকতে পারে না, কারণ মানবতা টিকে থাকে সম্পর্ক, সহমর্মিতা ও সময় দেওয়ার ওপর। যে সমাজে কেউ কারও জন্য সময় দিতে পারে না, সেখানে মানবতা বিলীন হয়ে যাওয়া অনিবার্য।

মানবিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য শহর পরিকল্পনা, শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কৃতিতে কিছু মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন। যেমন- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নাগরিক মূল্যবোধ, সহানুভূতি ও স্বেচ্ছাসেবার চর্চা বাড়াতে হবে। পাড়াভিত্তিক সামাজিক ক্লাব, সাংস্কৃতিক আয়োজন, পাঠচক্র এসব মানুষকে একত্র করবে। নগর পরিকল্পনায় পার্ক, কমিউনিটি সেন্টার, খেলার মাঠ, বৃদ্ধাশ্রম ও নিরাপদ পথচারী পরিবেশ থাকা জরুরি। শহরকে এমনভাবে গড়া দরকার, যেখানে মানুষ একে অপরের সঙ্গে মিশতে পারে, আলাপ করতে পারে। গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া মানবিক গল্প তুলে ধরুক; মানুষের সাহায্যের গল্প, দয়ার গল্প, একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর গল্প। কারণ ভালো উদাহরণ ছড়ালে মানবতাও ছড়ায়। অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের শেখানো সফলতা মানে শুধু অর্থ নয়, অন্যের পাশে দাঁড়ানোর সাহসও।

শহর যতই আধুনিক হোক, যদি সেখানে মানবতার বাতি নিভে যায়, তবে সেটি শুধু কংক্রিটের সমাহার। মানুষের গায়ে দামি পোশাক থাকতে পারে; কিন্তু মনে শূন্যতা থাকবে। আমরা হয়তো একদিন চাঁদে শহর গড়ব; কিন্তু যদি মানবতা না থাকে, তবে সেই শহরও মরুভূমি ছাড়া কিছু নয়।

আজকের প্রশ্ন তাই গভীর, আমরা কি সত্যিই উন্নত হচ্ছি, নাকি মানবতা হারিয়ে আরও দরিদ্র হয়ে পড়ছি? সময় এসেছে থামার, চারপাশে তাকানোর, আর একে অপরের দিকে হাত বাড়ানোর। কারণ শহর বাঁচবে তখনই, যখন তার বাসিন্দারা মানুষ হিসেবে বাঁচবে।

আরিফুল ইসলাম রাফি

শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়