মাটির টানে রক্তের সম্পর্ক হারায়
জোবায়েদা ইসলাম জয়া
প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এক চিলতে মাটি, একখণ্ড কাগজ আর একটা স্বাক্ষর। সেই কাগজের দাগেই আজ ভেঙে যাচ্ছে বছরের পর বছরের সম্পর্ক। যেই মাটিতে আমরা বড় হয়েছি, পা রেখেছি, হাঁটতে শিখেছি, খেলেছি, বাবার হাত ধরে হেঁটেছি, শৈশব উপভোগ করেছি- সেই মাটিই আজ যেন রক্তের চেয়েও ঘন, সম্পর্কের চেয়েও দামি। মাটির টানে মানুষ আজ মানুষকে হারায়, ভাই ভাইয়ের শত্রু হয়, প্রতিবেশী হয় প্রতিপক্ষ।
জমিজমা নিয়ে ঝগড়া এখন শুধু গ্রামবাংলার গল্প নয়, এটি নিত্যকার বাস্তবতা বলা যায়। প্রতিদিন কোনো না কোনো গ্রামে, কোনো না কোনো ঘরে, চলছে সীমা টানার এই ভয়ংকর খেলা। দেয়ালের ওপারে একসময় যেখানে সন্ধ্যা হলেই মাদুর পেতে গল্পের আসর বসত, হাসির শব্দে নির্জন রাত্রি কেটে যেত, এখন সেখানেই শোনা যায় কাঁদা-বালির ঝগড়া, থানা-পুলিশের ডাক, কিংবা আদালতের নোটিশ। একসময় গ্রামের বাড়িগুলোর মধ্যে ছিল না কোনো উঁচু দেয়াল। ছিল গাছের ছায়া, পানের বরজ, পুকুরের ঘাট ভাগাভাগি। এখন প্রতিটি দেয়াল কংক্রিটের, উঁচু, আর ঠান্ডা।
আগে গ্রামের মানুষ সদাসর্বদা একে অপরের পাশে থাকত। তা হোক বিয়ে, মৃত্যু, কিংবা আনন্দ-উৎসবে। এখন সেই মানুষদের সঙ্গেই দেখা হয়- কাগজে-কলমে, থানায় কিংবা আদালতের হাজিরায়। আজকের সমাজে ভাই ভাইয়ের শত্রু, প্রতিবেশী পরিণত হয় প্রতিদ্বন্দ্বীতে শুধুই কয়েক হাত মাটির জন্য। জমির মালিকানা যেন রক্তের সম্পর্কের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে। সামান্য তর্ক, কথা কাটাকাটি থেকে শুরু হয় তারপর রুপ নেয় বড়সড় দ্বন্দ্বে। প্রতিনিয়ত এই ঝগড়া, কলহ, বিবাদ বাড়ছেই।
এই বিবাদের জেরেই সম্পর্ক আর সম্পর্ক থাকছে না, পরিণত হচ্ছে বিষে। শুধু গ্রামেই নয়, শহরের মানুষ ও এর ব্যতিক্রম নয়। সবখানেই চলছে সম্পত্তি ভাগাভাগির মহোৎসব এবং এরই জের ধরে চলমান দ্বন্দ্ব। প্রতিবেশীর সম্পর্কেও ফাটল ধরছে। দূর শহরে যে-কোনো প্রয়োজনে প্রতিবেশীরাই যেখানে পাশে থাকত সেই সম্পর্কও আজ ভঙ্গুর। আগে সকালে দরজায় ডাক পড়ত ‘এক কাপ চিনি হবে আপা?’ আর এখন ডাক পড়ে পুলিশের সাইরেনে। ভাগাভাগির দেয়াল যত উঁচু হয়, তত নিচে নামে মানবতা। তত ঘটে সম্পর্কের অবনতি। সম্পর্কে অবনতির শেষ পরিণাম হয় দাঙ্গা, মারামারি, হানাহানি এবং পরিশেষে হত্যা।
এ সমস্যার মূল হচ্ছে- আমরা মানুষ মাত্রই লোভী। প্রায়শই আমরা লোভের বশবর্তী হয়ে সম্পর্কের মূল্য বুঝতে চাই না, সম্পর্কের চেয়ে সম্পত্তির দিকে বেশি আকৃষ্ট হয়ে যাই। ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয় বিবাদের।
বেশ কিছুদিন আগে, নীলফামারীতে দুই ভাইয়ের মধ্যে জমি নিয়ে বাকবিতন্ডায় দুইজনেরও মৃত্যু ঘটেছে বলে খবর পাওয়া যায়। আবার, ঝিনাইদহের ব্যান্ডেখালি গ্রামে ভাইবোনদের মধ্যে জমি-বিতর্কে একজন ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন বলে জানা যায়। শুধু ভাই-ভাই নয়, এখন পাশের জমি, পাশের বাড়ি, পাশের মানুষই শত্রু হয়ে উঠছে। অন্যান্য প্রতিকূলতা যেমন আইনগত জটিলতা, নিরাপত্তাহীনতা, বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘতা, সব মিলিয়ে বিষয়টা শুধু ‘একটা বিরোধ’ নয়, সামাজিক ক্ষত যা অনেক পরিবারকে ছিঁড়ে দিচ্ছে। চাঁদপুরের খেরুদিয়া গ্রামে জমির সীমানা নিয়ে তর্কের জেরে প্রতিবেশী ভাইয়ে ভাইয়ে কয়েক দফায় মারামারি এবং এক পর্যায় নাতির হাতে দাদাকে বাঁশ দিয়ে আঘাত করে আহত করার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। কক্সবাজারের উখিয়ায় কঠোর সংঘর্ষে দুই প্রতিবেশী গ্রুপ জমি-বিতর্ক নিয়ে একে অপরকে ধারালো লোহার অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে, ফলে স্থানীয় ইমামসহ তিনজন নিহত হয়। এরকম হাজারো ঘটনা প্রতিদিনই বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে চলেছে। আমরা তা দর্শকের আসনে বসে দেখছি; কিন্তু সমাধান খুঁজে পাচ্ছি না, কিংবা করতে চাচ্ছি না।
শুধু এরূপ ঘটনাই নয়, বাবার লাশ সামনে রেখে ছেলে মেয়েকে সম্পত্তি ভাগাভাগি করতে দেখা যায়। বেশ কিছুদিন আগে সম্পত্তির বণ্টনের সূত্র ধরে কবরে লাশের পরিবর্তে সম্পত্তির ওয়ারিশকে শুয়ে থাকতে দেখা যায়, তার দাবি ছিল সম্পত্তির মীমাংসা হওয়ার পর লাশ দাফন হবে। আমরা কত নিচে নেমে গিয়েছি যে, রক্ত-মাংসের মানুষের চেয়ে আমাদের কাছে এখন এক টুকরো মাটির মূল্য বেশি। আমরা ভুলে যাই, মাটি আমাদের আশ্রয়, অস্ত্র নয়। ভুলে যাই, দলিলের দাগ মুছে যায়; কিন্তু ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগে না। আমরা এমন এক জাতি, যারা স্বাধীনতার জন্য লড়েছি মাটির টানে, আর আজ সেই মাটির টানেই ভাইয়ের গলায় নির্দ্বিধায় ছুরি চালিয়ে দিচ্ছি।
আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হচ্ছে- আমরা মাটি ভালোবাসি, মানুষ নয়। জমি আঁকড়ে রাখি, তবে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করি না। আদালতে মামলার জট, রেকর্ড অফিসের ঘুষ, দালালের হাতের খেলা; সব মিলিয়ে জমি নিয়ে বিরোধ এক ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধি হয়ে উঠেছে। জমির কাগজ হাতে নিয়ে মানুষ ঘুমাতে পারে না, মামলার তারিখ গুনতে গুনতে বার্ধক্য আসে, আর ঘরের হাসি উধাও হয়ে যায়। তবুও মানুষ এই ভয়ংকর নেশায় জর্জরিত যা ব্যক্তি, পরিবার তথা সমাজে বিশৃঙ্খলার বীজ বপন করছে।
এ সমস্যার মূল সমাধান আছে কোথায় জানেন? নিজের বিবেকের কাছে। নিজের বিবেকবুদ্ধি জাগ্রত করার মাধ্যমে বেশিরভাগ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আইন, সালিশ ও প্রশাসন সবই সহায়ক; কিন্তু মূল কাজ মানুষকে শিক্ষা দেওয়া, মানবিক মূল্যবোধ পুনঃস্থাপন করা।
যতক্ষণ আমরা সম্পর্ককে মাটির চেয়ে বড় ভাবতে পারব না, ততক্ষণ রক্তপাত ও এই ঝগড়া-বিবাদ চলতেই থাকবে। তাছাড়া প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা। স্কুল, মাদ্রাসা, মন্দির ও কমিউনিটিতে শিক্ষা দিতে হবে যে- সম্পর্কের চেয়ে সম্পত্তি বড় নয়। প্রতিবেশী বা আত্মীয়ের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আচরণ করতে হবে, একে অপরের প্রতি ধৈর্য, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা প্রদর্শন করতে হবে। একে অপরের প্রতি সহিষ্ণু হতে হবে। ঝগড়া বা হিংস্র প্রবণতা দেখা দিলে দ্রুত সতর্কতা, সমঝোতা ও প্রশাসনের সাহায্য নিতে হবে। গ্রাম, ইউনিয়ন ও পৌর পর্যায়ে ‘সালিশ কমিটি’ বা সমঝোতা সভাকে নিয়মিত ও কার্যকর করতে হবে।
খতিয়ান, দলিল, সীমানা ও লিজ তথ্য অনলাইনে যাচাইযোগ্য করতে হবে। ভূমি অফিসে ঘুষ ও মধ্যস্থতাকারীর সুযোগ কমাতে হবে। এতে বিরোধ নিরসন দ্রুত হবে, মানুষকে আদালত বা হিংসার দিকে যেতে হবে না। জমি-বিতর্কে মামলা দীর্ঘস্থায়ী হলে মানুষ হতাশ হয়ে যায়। ফলে বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে, এতে ঝগড়া-হিংসা কমানো সম্ভব। পুলিশি নজরদারি ও আইনগত সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ক্ষিপ্রতার অভাব মানুষকে হিংস্র না করে।
ভাই-ভাই, আত্মীয় কিংবা প্রতিবেশী-বিরোধ এখন আর ব্যক্তিগত ঘটনা নয়, এটি একটি জাতীয় অসুখ। তাই গ্রামীণ সালিশে ন্যায়বিচার ফিরিয়ে আনা, ভূমি দপ্তরে ডিজিটাল রেকর্ড নিশ্চিত করা, এবং প্রতিটি ইউনিয়নে ‘মীমাংসা কমিটি’ কার্যকর করা এখন জরুরি।
এই রাষ্ট্র যদি মানুষের রক্ত বাঁচাতে চায়, তবে তাকে কাগজ নয়, মানুষকে আগে দেখতে হবে। কারণ জমি রাষ্ট্রের সম্পদ, কিন্তু মানুষ? মানুষ রাষ্ট্রের প্রাণ। শেষমেশ, আমরা সবাই একই মাটির মানুষ। অথচ সেই মাটিই আজ আমাদের বিভক্ত করছে। যে জমির জন্য ভাই ভাইকে কুপিয়ে মারছে, সেই জমির উপরই একদিন দু’জনের কবর হবে।
যে উঠোন নিয়ে প্রতিবেশীরা লড়ছে, সেখানে একদিন শিশুরা খেলার মাঠ হারাবে। তাই এখনই সময়- মাটির চেয়ে মানুষকে বড় করে ভাবা শেখার। না হলে পরের প্রজন্ম ইতিহাস পড়বে, আর বলবে- আমাদের পূর্বপুরুষরা মাটির জন্য মানুষ হারিয়েছিল।
জোবায়েদা ইসলাম জয়া
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
