মানুষের জীবন তার কর্মফলেরই ধারাবাহিকতা
প্রকাশ : ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ফুল বপন করো, যেন চারিদিকে বাগান ফুটিয়া উঠে; কাঁটা বপন করিলে শুধু তোমারই পায়ে বিঁধিবে। এই পদ্য-পঙ্ক্তির অন্তর্নিহিত অর্থ সহজ; কিন্তু তাহার তাৎপর্য বিস্তৃত। এই সরল অথচ গভীর বাণীটি যেন মানবসমাজের অন্তঃস্থলে বিদ্যমান দর্শনকে প্রস্ফুটিত করে। আফগান ভূসন্তান, সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত সুফি-কবি আবদুর রহমান, যিনি রহমান বাবা নামে সুপরিচিত, তিনি ইহার রচয়িতা। বস্তুত, মানুষের জীবন তাহার কর্মফলের অনিবার্য ধারাবাহিকতা। আমরা যাহা রোপণ করি, তাহাই একদিন আমাদের জীবনভূমিতে অঙ্কুরিত হয়। করুণা, মমতা, সহমর্মিতা ও প্রেমের বীজ যদি অন্তরে ছড়াই, তাহা ফুলে-ফলে সমাজকে সুগন্ধিময় করে; কিন্তু যদি বিদ্বেষ, হিংসা, অবজ্ঞা ও প্রতিহিংসার বীজ রোপণ করি, তাহার দংশন আমাদেরই দেহে ফিরে আসে। রহমান বাবার এই মর্মবাণী একেবারেই আত্মঘাতী প্রক্রিয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে-অন্যের প্রতি অন্যায় আসলে নিজের অস্তিত্বের প্রতিই এক অমানবিকতা।
প্রশ্ন হইল, আমরা এই শিক্ষা কতটুকু আত্মস্থ করিয়াছি? আজকের পৃথিবীতে ঘৃণা, বিদ্বেষ, সংকীর্ণতা ও রাজনৈতিক হিংসার বিষবাষ্প প্রতিদিনই ছড়াইতেছে। মানুষের অন্তরের বাগানে ফুলের চাষ যতটা হইবার কথা, তাহার পরিবর্তে কাঁটার গাছই বরং অধিক অঙ্কুরিত হইতেছে। ফলে সমাজের পথরেখা ক্রমেই রুক্ষ ও অনাবাদি হইয়া পড়িতেছে। এমন বাস্তবতায় রহমান বাবার কবিতা শুধু একটি ধর্মীয় সুফি-বাণী নহে, বরং আধুনিক সমাজচিন্তার জন্য এক দীপ্ত শাশ্বত শাসনবাক্য। রহমান বাবার কাব্যে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হইয়াছে সুফিবাদের সারমর্মণ্ডমানুষকে ভালোবাসিলে তাহা হইলেই আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ সম্ভব; কিন্তু তাহার এই বাণী কেবল ধর্মীয় পরিসরে সীমাবদ্ধ নহে। ইহা মানবতাবাদের এক সর্বজনীন দলিল। তিনি মানবদেহকে এক সমগ্র শরীরের প্রতীক ধরিয়া বলিয়াছেন-অপরকে আঘাত করা মানে নিজের দেহকেই ক্ষতবিক্ষত করা। আধুনিক দর্শনের ভাষায় ইহা হইল সহাবস্থানের নৈতিকতা। মানুষ একে অপরের সহিত অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত; সুতরাং অপরকে যন্ত্রণা দান মানেই নিজেকেই কলুষিত করা। এই বাণীর সহিত আর একটি গভীর দার্শনিক উপলব্ধি যুক্ত হইয়াছে। রহমান বাবা বলিয়াছেন, ‘তুমি যতই অপরকে অবজ্ঞা করো না কেন, তোমার দেহও একদিন ধূলিতে মিশিয়া যাইবে।’
ইহা মানবজীবনের ক্ষণস্থায়িত্বের নির্মম সত্য। ক্ষমতা, অহংকার, বিদ্বেষ, দম্ভণ্ডসকলই ধূলিকণায় পরিণত হইয়া যায়। মৃত্যুর অন্তরালেই সকল অহংকারের অবসান। সুতরাং সৃষ্টির সেরা জীব হইয়া একে অন্যের প্রতি কেনই-বা ঘৃণা লালন করিব? কেনই-বা অন্যকে হেয় করিব? মৃত্যুর মুখে দাঁড়াইয়া সকলেই সমান- এই সত্য অনুধাবন করিলে সমাজে অনেক অশান্তির অবসান ঘটিতে পারিত। লালন যেমন বলিয়াছেন, সময় গেলে সাধন মেলে না। তেমনি রহমান বাবা বলিয়াছেন, ‘দিনের আলোর মধ্যে পথ সোজা করো, কারণ রাতের অন্ধকার কখন আসিয়া পড়ে, বলা যায় না।’ এই বাণী শুধু মৃত্যুর প্রতীক নহে, জীবনেরও অনিশ্চয়তার প্রতীক। আলোকময় সময়ে, যখন আমরা সুযোগপ্রাপ্ত, তখনই আমাদের কর্তব্য হইল আত্মশুদ্ধির পথ অবলম্বন করা। কেননা, অন্ধকার আসিলে আর সুযোগ থাকিবে না। সময় চলিয়া গেলে আর সাধন মিলিবে না।
প্রকৃত অর্থে, আমরা সকলেই এক বিশাল কাফেলার যাত্রী। জীবন হইল একটি ক্ষণস্থায়ী যাত্রা; ধূলিকণায় মিলাইয়া যাওয়াই আমাদের অনিবার্য নিয়তি। এই যাত্রাপথে আমরা যদি বিষ ছড়াই, সেই বিষেই আমাদের শ্বাসরোধ হইবে। তাই অহংকারের উল্লম্ফন, বিদ্বেষের উন্মত্ততা বা প্রতিহিংসার অগ্নিকুণ্ড আসলে আত্মবিনাশ ব্যতীত আর কিছু নহে। নিজ নিজ কর্ম অনুযায়ী ফল আমাদেরই ভোগ করিতে হইবে। অতএব, আমাদের বুদ্ধিমান হইতে হইবে, আত্মবিনাশী পথ হইতে সরিয়া আসিতে হইবে।
