গুদামজাত আলুতে ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত

ওসমান গনি, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সাম্প্রতিক সময়ে আলুর বাম্পার ফলন দেশের কৃষি অর্থনীতিতে এক নতুন সংকটের জন্ম দিয়েছে। একদিকে যখন মাঠভর্তি সোনালি ফসল দেখে কৃষকের মুখে হাসি ফোটার কথা, অন্যদিকে তখন ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার হতাশায় আলু চাষি ও ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। এ যেন এক নির্মম পরিহাস, অতি উৎপাদনের ফলশ্রুতিতে কৃষকের জীবনে নেমে এসেছে বিপুল লোকসান ও ঋণের বোঝা। বিশেষ করে যারা লাভের আশায় বিপুল পরিমাণ আলু হিমাগারে (কোল্ড স্টোরেজ) সংরক্ষণ করেছিলেন, তাদের অবস্থা আজ সবচেয়ে সংগীন। উৎপাদন খরচ, হিমাগার ভাড়া এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ যোগ করে যে দাম দাঁড়ায়, তার অর্ধেকেরও কম দামে আলু বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের।

আলু চাষের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, এই বিপর্যয়ের মূলে রয়েছে চাহিদার তুলনায় অত্যধিক উৎপাদন, অপর্যাপ্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনার অভাব। গত বছর আলুর চড়া দামের কারণে এ বছর কৃষক ও ব্যবসায়ীরা বিপুল উৎসাহে বেশি জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। সার, বীজ ও শ্রমিকের বাড়তি দামের কারণে উৎপাদন খরচও এবার ছিল বিগত বছরগুলোর তুলনায় বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচই দাঁড়িয়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। কিন্তু যখন আলু বাজারে আসে, তখন অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে পাইকারি দাম নেমে আসে মাত্র ৮ থেকে ১২ টাকায়। এই অবিশ্বাস্য দরপতন কৃষি অর্থনীতির ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে। লোকসানের এই বহুমাত্রিক চিত্রের প্রধান শিকার হচ্ছেন সেই সব ব্যবসায়ী ও কৃষক, যারা লাভের আশায় বা ভবিষ্যৎ মূল্যবৃদ্ধির প্রত্যাশায় হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করেছিলেন। তেমনি একজন আলু ব্যবসায়ী কুমিল্লার চান্দিনার ছয়ঘড়িয়া গ্রামের জাকির হোসেন জানান, আমি গত দুই সিজনে অনেক কষ্টে আলু সংরক্ষণ করে বিরাট অংকের টাকা লোকসান হয়েছে। যার কারণে এখন আলু সংরক্ষণের প্রতি আমার তেমন কোনো আগ্রহ নেই। একই উপজেলার মেহার গ্রামের আরও একজন আলু ব্যবসায়ী ন্যাপ নেতা মো: মনিরুল ইসলাম মানিক জানান, আমি গত সিজনে অনেক আলু কলস্টোরেজে সংরক্ষণ করেছিলাম কিছু ব্যবসার আশায়; কিন্তু বর্তমানে আলুর দামের যে অবস্থা দেখলাম, প্রতি কেজি আলু আমি যে ধরে ক্রয় করেছি তার চেয়ে ১০ টাকা ১৩ টাকা কেজিতে লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। এখানে আমার অনেক টাকা লোকসান হয়ে গেছে। তাই আলু ব্যবসার প্রতি আমার আর তেমন কোনো আগ্রহ নেই। যদি আলু ব্যবসায়ীরা এভাবে আলু লোকসান গুনতে থাকে একসময় আলু চাষিরা আলু চাষ করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। যার প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে। কোল্ড স্টোরেজে প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণের খরচ ক্ষেত্রবিশেষে ২৬ টাকা পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। অথচ হিমাগার থেকে সেই আলু তাদের বিক্রি করতে হচ্ছে ১২ থেকে ১৩ টাকা দরে। প্রতি কেজিতে ১৩ থেকে ১৪ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ী ও চাষিদের। এই বিপুল লোকসানের হিসাব যখন কষতে বসেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা, তখন ঋণের বোঝার নিচে চাপা পড়ে তাদের ভবিষ্যৎ। অনেক হিমাগার মালিক জানাচ্ছেন, দাম না পাওয়ায় কৃষক ও ব্যবসায়ীরা মজুতকৃত আলু বের করতেও চাইছেন না, ফলে তাদেরও ব্যবসায়িক স্থবিরতা নেমে এসেছে। এই অচলাবস্থা শুধু কৃষক বা ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, এটি সমগ্র কৃষি অর্থনীতিতে এক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যার জের টানতে হবে আগামীতেও। মুন্সীগঞ্জ বা রংপুরের মতো আলু উৎপাদনকারী প্রধান জেলাগুলোতে এই লোকসানের পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে, হিমাগারে জায়গা না পেয়ে বিপুল পরিমাণ আলু দেশীয় বা সনাতন পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করতে গিয়েও চাষিরা পড়েছেন চরম বিপাকে। পর্যাপ্ত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের অভাবে সেসব আলুতে দ্রুত পচন ধরেছে। এক-চতুর্থাংশেরও বেশি আলু নষ্ট হয়ে যাওয়ার খবর আসছে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। পচে যাওয়া আলু বাধ্য হয়ে গরুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা একদিকে যেমন খাদ্য ও সম্পদের অপচয়, অন্যদিকে পরিবেশ ও গবাদিপশুর স্বাস্থ্যের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। গরুকে কাঁচা আলু খাওয়ালে পেটফাঁপা ও বিষক্রিয়ার মতো সমস্যা হতে পারে বলে পশুসম্পদ কর্মকর্তারা সতর্ক করছেন। এই করুণ দৃশ্য স্পষ্টতই অব্যবস্থাপনার এক বিশাল ক্যানভাস তুলে ধরে। যখন দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হয়, তখন আলুর মতো একটি প্রধান ফসলের এই ধরনের অপচয় মেনে নেওয়া যায় না।

আলুর এই চরম মূল্যপতনের জন্য কিছু কাঠামোগত দুর্বলতাও দায়ী। দেশের মোট আলু উৎপাদনের তুলনায় হিমাগারে সংরক্ষণের সক্ষমতা অনেক কম। প্রতি বছরই উৎপাদিত আলুর একটি বড় অংশ সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় না। ফলে, মৌসুমের শুরুতে বাজারে অতিরিক্ত সরবরাহ তৈরি হয় এবং দাম পড়ে যায়। এছাড়া, হিমাগার ভাড়ার সরকারি নির্দেশনা থাকলেও অনেক সময় তা মানা হয় না, ফলে কৃষকের খরচ আরও বেড়ে যায়।

অন্যদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ বা টিসিবির মাধ্যমে আলু ক্রয়ের উদ্যোগ নেওয়া হলেও, তা অপ্রতুল এবং কার্যকর বাস্তবায়নের অভাবে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, সরকার হিমাগার গেটে আলুর দাম ২২ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও বাস্তবে সেই দামে বিক্রি হচ্ছে না। সরকারি ক্রয় ও সংরক্ষণের পরিমাণও প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। আলু রপ্তানিতে প্রণোদনা দেওয়ার কথা উঠলেও আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি প্রক্রিয়া এখনো সহজলভ্য হয়নি। জটিল আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, আন্তর্জাতিক ক্রেতা খুঁজে না পাওয়া এবং মান নিয়ন্ত্রণের সমস্যা এক্ষেত্রে বড় বাধা। অথচ, উদ্বৃত্ত আলু বিদেশে রপ্তানি করা গেলে অভ্যন্তরীণ বাজারে দামের স্থিতিশীলতা ফিরে আসত।

বাজারের মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকাও এখানে প্রশ্নবিদ্ধ। উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে কৃষক আলু বিক্রি করলেও, খুচরা বাজারে ভোক্তাকে এখনও অপেক্ষাকৃত বেশি দামেই আলু কিনতে হচ্ছে (সাধারণত ২০-২৫ টাকা প্রতি কেজি)। এর থেকে বোঝা যায়, বাজারে একটি বড় অংশের লাভ মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে চলে যাচ্ছে, যেখানে উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত। এই দীর্ঘ এবং অকার্যকর সাপ্লাই চেইনকে (সরবরাহ শৃঙ্খল) সরল ও নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। কৃষকের হাত থেকে শুরু করে ভোক্তার প্লেট পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে নজরদারি বাড়ানো এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এই বিশাল আর্থিক ক্ষতি ও হতাশা থেকে আলু চাষি ও ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। কালক্ষেপণের কোনো সুযোগ নেই, কারণ ফসলের জীবনকাল সীমিত এবং সময় যত গড়াবে, লোকসানের পাল্লা ততই ভারী হবে। প্রথমত, কৃষি বিপণন আইন অনুযায়ী কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকার নির্ধারিত মূল্যে বা উৎপাদন খরচের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একটি ন্যূনতম ক্রয়মূল্য নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। এই মূল্য যেন হিমাগার পর্যায়ে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হয়, তা নিশ্চিত করতে নিয়মিত বাজার তদারকি প্রয়োজন।

দ্বিতীয়ত, সরকারিভাবে পর্যাপ্ত আলু কিনে খাদ্য বা বীজ হিসেবে সংরক্ষণ করা যেতে পারে, যা বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সরকারকে টিসিবি বা অন্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে সরাসরি কৃষক বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ন্যায্য দামে বিপুল পরিমাণ আলু কিনে নিতে হবে। এই আলু পরবর্তীতে খোলা বাজারে বা ন্যায্যমূল্যের দোকানে বিক্রি করা যেতে পারে। এটি সরকারের খাদ্য মজুতকেও শক্তিশালী করবে।

তৃতীয়ত, আলু রপ্তানির প্রক্রিয়াকে আরও গতিশীল ও সহজ করতে হবে, যাতে অতিরিক্ত উৎপাদিত আলু সহজেই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশাধিকার পায়। নতুন বাজার খুঁজে বের করা, রপ্তানিতে আরও বেশি প্রণোদনা দেওয়া, মান নিয়ন্ত্রণের আন্তর্জাতিক মানদ- পূরণ এবং রপ্তানি সংক্রান্ত আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন করা সময়ের দাবি।

চতুর্থত, কোল্ড স্টোরেজগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং আধুনিক সংরক্ষণ পদ্ধতির ব্যবহার বাড়াতে হবে, যাতে প্রাকৃতিক উপায়ে সংরক্ষণকালে আলুর পচন রোধ করা যায়। বিশেষত, গ্রামাঞ্চলে স্বল্প খরচে আলু সংরক্ষণের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক প্রযুক্তি ও পরামর্শ প্রদান করতে হবে। কৃষকদেরও মানসম্পন্ন বীজ ও সারের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তাদের উৎপাদন খরচ কম হয়। পঞ্চমত, কৃষি ঋণের ক্ষেত্রে সুদ মওকুফ বা সহজ কিস্তির ব্যবস্থা করে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও ব্যবসায়ীদের আর্থিক চাপ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। আগামী মৌসুমে আলু চাষে উৎসাহিত করতে তাদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা যেতে পারে।

আলু বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। এই ফসল চাষের সঙ্গে লাখ লাখ কৃষক ও ব্যবসায়ীর জীবন-জীবিকা জড়িত। যদি প্রতি বছরই বাম্পার ফলন তাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়, তবে আগামীতে তারা আলু চাষে আগ্রহ হারাবেন। উৎপাদনের এই ধারায় ছেদ পড়লে বাজারে আলুর কৃত্রিম সংকট দেখা দিতে পারে, যা আবার ভোক্তাদের জন্য দুর্ভোগ বয়ে আনবে। তাই, আজকের এই লোকসান ও হতাশার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একটি সুদূরপ্রসারী, টেকসই এবং কৃষকবান্ধব নীতি প্রণয়ন ও তার দ্রুত বাস্তবায়ন অপরিহার্য। কৃষক বাঁচলে বাঁচবে দেশ, এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। সামগ্রিক কৃষি অর্থনীতিকে চাঙা করতে হলে আলুর বাজারে শৃঙ্খলা ফেরানো এখন সময়ের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দাবি।