আর কত প্রাণ গেলে আমরা সতর্ক হব

প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দেশের সব সংবাদপত্রে প্রায় প্রতিদিনই ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ও আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হচ্ছে, এটি যেন আমাদের এক অমোঘ নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বছর দেশের প্রায় ৬৩ জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। বছর দুয়েক আগেও ডেঙ্গু আক্রান্ত ও বিস্তার ছিল কেবল বর্ষাকালেই, কিন্তু আবহাওয়াজনিত কারণেই হোক বা অন্য কারণ, ডেঙ্গু এখন পত্রিকার শিরোনাম অনুযায়ী বারোমাসি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মশাবাহিত এই রোগ এখন কোভিডের থেকেও যেন বেশি আতঙ্কের বিষয়, কিন্তু সরকার বা সিটি কর্পোরেশনগুলো অনেকটাই নির্বিকার। এবার লক্ষণীয় দিকটি হলো, রাজধানীর বাইরে দেশের অন্যত্র ডেঙ্গু বিস্তারের পরিমাণ অনেক বেশি। রাজধানীতে মশা নিধনে কিছুটা হলেও একটা ব্যবস্থা আছে; কিন্তু ঢাকার বাইরে তা-ও নেই। আর চিকিৎসা পরিকাঠামোর কথা নাই বা বললাম।

দেশে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে রাস্তাঘাট আবর্জনামুক্ত করা, ভাঙা সড়ক ও বসতবাড়ির আশপাশে পানি জমতে না দেওয়া, মশার বংশবৃদ্ধিরোধক কীটনাশক প্রয়োগ, নাগরিকদের সচেতন করার মতো প্রাথমিক কাজগুলো স্থানীয় সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্পোরেশনগুলো সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে সঠিকভাবে সম্পন্ন করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। উল্টো সরকার ও বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনের কর্তাব্যক্তিরা প্রায়শই বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে নাগরিকদের অসচেতনতাকেই দায়ী করে নিজেদের দায় সারেন। তাদের অনেকের ভাষ্য মতে, সরকার ও সিটি কর্পোরেশনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মানুষ নিজের বাড়ির ভেতরে গাছের টব ইত্যাদির জমা পানি পরিষ্কার করছে না। ফলে মশা সেখানে নির্দ্বিধায় বংশ বিস্তার করতে পারছে।

এই যে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, তা মোকাবিলায় সরকারের স্বাস্থ্য সেবা খাত আসলে কতটা প্রস্তুত? বিগত বছরের গাফিলতি ও ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও হাসপাতালগুলো আদৌ সতর্ক, সচেতন ও পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।

সারা দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়লেও দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের বেশির ভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নাকি ডেঙ্গু পরীক্ষার যথাযথ ব্যবস্থাই নেই। অবশ্য যুগ যুগ ধরে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতে অবকাঠামো ও প্রশিক্ষিত জনশক্তির মধ্যে ভারসাম্যহীনতা একটা বড় সমস্যা। নব্বই দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো স্বল্প শয্যা থেকে অবস্থানভেদে কোথাও কোথাও ১৫০ থেকে ২০০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত হয়েছে, যাকে আমরা উন্নতি হিসেবেই দেখেছি; কিন্তু অবকাঠামো হলেই তা যে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন নয়, তা আমরা অনুধাবন করতে পারছি বলে মনে হয় না। কেননা, দেখা গেছে, অবকাঠামো বাড়ানো হলেও জনশক্তি প্রায় জায়গাতেই আগের শয্যা অনুসারেই রয়ে গেছে। আমরা প্রায়শই দেখতে পাই, দক্ষ জনশক্তির অভাবে সরকারি বড় হাসপাতাল আর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে টেকনিশিয়ানের অভাবে বিভিন্ন মেশিন অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে, অ্যাম্বুলেন্স আছে; কিন্তু চালক নেই, কোথাও টেকনিশিয়ান আছে অথচ সংশ্লিষ্ট মেশিন নেই- এমন আরও নানা সমস্যা। রোগীরা সেসব যন্ত্রের সেবা নিতে না পেরে বেশি দামে বাইরে পরীক্ষা করাতে বাধ্য হচ্ছে।

অর্থাৎ অবকাঠামো বাড়ানো হলেও অনেক ক্ষেত্রেই জনশক্তি বা পরিকাঠামো বাড়ানো হয়নি। এতে আমরা দেখাতে পাচ্ছি, হাসপাতাল ভবন হয়েছে; কিন্তু আদতে সেখানে যথাযথ সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার এমনও দেখা যাচ্ছে, হয়তো কোনো হাসপাতালে অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন; কিন্তু ডিগ্রিধারী নার্স, সাপোর্ট ফোর্স বা আইসিইউ-সিসিইউ সাপোর্ট নেই। এভাবেই চলছে, আর আমরাও নির্বাক ও নির্লিপ্ত! ভুলে গেলে চলবে না, স্বাস্থ্য খাত এমন একটি খাত, যেখানে সামান্য ভুল অসামান্য ক্ষতি বয়ে আনতে পারে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়ানো, পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৌশলগত অগ্রাধিকার ঠিক করা, স্বাস্থ্যব্যবস্থায় দক্ষতা বাড়ানো, হাসপাতালে রোগী ব্যবস্থাপনায় সৃজনশীল উদ্যোগ, মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা চালু, মশার ওপর নিয়মিত নজরদারি, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গোটা সরকারব্যবস্থার সম্পৃক্ততা এবং জোরালো তদারকি ও নিয়মিত কাজের মূল্যায়ন করা গেলে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধ করা সম্ভব। ডেঙ্গুর উৎস পুরোপুরি নির্মূল করতে হবে। উপদেশমূলক বার্তায় জনগণ সচেতন না হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে যারা জনগণকে সচেতন করবেন, তারা নিজেরা কতটা সচেতন, সেটাই একটা প্রশ্ন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এ বছর বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ার সঙ্গেও ডেঙ্গু বিস্তারের যোগসূত্র থাকতে পারে। এর একটা কারণ সড়ক ও বাসাবাড়ির পাশে জমে থাকা জলাবদ্ধতা, আর এটাই এডিস মশা প্রজননের জন্য আদর্শ। তাই ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশাকে প্রতিরোধ করতে হলে সরকারি-বেসরকারি, সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে বিশেষ সচেতনতা গড়ে তোলাটাই এখন সময়ের দাবি। বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছর বিশ্বে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ডেঙ্গুতে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুই-ই কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটছে এর উল্টো চিত্র। বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ গত বছরের চেয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় তিন গুণ বেশি; মৃত্যুর সংখ্যাও অধিক। যদিও সংক্রমণের তুলনায় মৃত্যুহার গত বছরের চেয়ে কম হলেও তা এখন বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। আর দক্ষিণ এশিয়ায় এখনও ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যুহার বাংলাদেশে। যদিও ডেঙ্গু প্রতিরোধে কোনো ভ্যাকসিন নেই, কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তিরা যদি যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা নিতে পারে, তাহলে এই রোগে মৃত্যু কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

যেকোনো দুর্যোগ-পরবর্তী অভিজ্ঞতা মানুষকে অভিজ্ঞ করে, তা থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়, যাতে করে ভবিষ্যতে এমন যেকোনো দুর্যোগ সফলভাবে মোকাবিলা করা যায়। কিন্তু বিগত বছরগুলোর ডেঙ্গু সংকট মোকাবিলায় যে অভিজ্ঞতা আমাদের অর্জিত হয়েছিল, তা থেকে আমরা আদৌ কোনো শিক্ষা নিয়েছি কি না তা একটি বড় প্রশ্ন। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে ডেঙ্গু মোকাবিলার বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গুমুক্ত করার কাজ শুধু সিটি করপোরেশন ও সরকারের একার নয়, সাধারণ নাগরিককেও সচেতন হতে হবে। তবে তার জন্য আমাদের সবাইকেই দায়বদ্ধ হতে হবে, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার নীতি মেনে চলতে হবে, তাহলেই ডেঙ্গুর মতো জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি মোকাবিলা আমাদের জন্য সহজতর হবে।