নারী নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা বাংলাদেশের সব দলের অদৃশ্য বৈষম্য
এসএম রায়হান মিয়া
প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশ একটি দেশ, যেখানে নারী নেতৃত্বের উত্থান ইতিহাসের পাতায় গৌরবের বিষয়। দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোচ্চ পদে নারী নেতৃত্বের উপস্থিতি বিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছে। একদিকে নারী প্রধানমন্ত্রী, অন্যদিকে বিরোধী দলেও নারী নেতৃত্ব- এ যেন এক যুগান্তকারী বাস্তবতা। কিন্তু এই উজ্জ্বল সাফল্যের ভেতরে লুকিয়ে আছে এক কঠিন সত্য- রাজনীতির গভীরে এখনও নারীর জন্য জায়গা সংকীর্ণ, বৈষম্য প্রবল, আর পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা অটুট। নারী নেত্রীরা জাতীয় নেতৃত্বের মুখ হলেও দলীয় কাঠামোর বাস্তবতায় তারা ব্যতিক্রম, নিয়ম নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারী নেত্রীর নেতৃত্ব এক প্রতীক, কিন্তু নারী রাজনীতিকের বাস্তব অবস্থান এখনও প্রান্তিক ও সংগ্রামী। রাজনীতির এই বৈষম্য কেবল এক দলের নয়, প্রায় সব দলের। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী কিংবা জাতীয় পার্টি- সব দলের সংগঠন কাঠামো ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। দলগুলোতে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত, এবং যেসব নারী নেতৃত্বে আছেন, তাদের অধিকাংশই প্রতীকী বা পারিবারিক সূত্রে উঠে আসা। এর ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর নেতৃত্বের বিকাশ প্রকৃত অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে পারেনি। এই বৈষম্যের শিকড় সমাজে যেমন গভীর, তেমনি দলীয় সংস্কৃতিতেও তা প্রোথিত। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মূল সমস্যা হলো- তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চর্চা করে না। দলীয় কমিটি থেকে শুরু করে মনোনয়ন প্রক্রিয়া পর্যন্ত সবকিছু নিয়ন্ত্রিত এবং আনুগত্যনির্ভর। এতে নারী রাজনীতিকরা অনেক সময় সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও পিছিয়ে পড়েন।
আওয়ামী লীগ বা বিএনপি- দুটো দলেই নারী নেতৃত্ব আছে, কিন্তু দলীয় গঠনে নারী নেত্রীদের সংখ্যা অল্প, এবং তৃণমূল পর্যায়ে তা প্রায় অদৃশ্য। সিদ্ধান্ত গ্রহণে, নীতি প্রণয়নে বা প্রার্থী মনোনয়নে নারীদের ভূমিকা সীমিত। নারীরা অনেক সময় সাংগঠনিক দায়িত্ব পান, কিন্তু সেই দায়িত্বের সঙ্গে প্রকৃত ক্ষমতা থাকে না। তারা কাজ করেন, প্রচারণা চালান, কিন্তু পুরুষ নেতারা সিদ্ধান্ত দেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অবস্থানকে বোঝার জন্য প্রথমে দেখতে হবে দলীয় বাস্তবতা। প্রতিটি বড় দলেই একটি ‘মহিলা শাখা’ আছে- যেমন মহিলা লীগ, জাতীয়তাবাদী মহিলা দল, মহিলা জামায়াত ইত্যাদি। কিন্তু এই সংগঠনগুলো মূল দলের প্রান্তিক অংশ হিসেবেই থেকে গেছে। তাদের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেই, বরং কেন্দ্রের নির্দেশনাতেই কাজ করতে হয়। মহিলা সংগঠনের নেতা হিসেবে অনেক সময় যারা দায়িত্বে থাকেন, তাদের কর্মকাণ্ড সীমিত থাকে সভা, সেমিনার বা প্রতীকী আন্দোলনে। বড় দলগুলোর পুরুষ নেতৃত্ব তাদের ব্যবহার করে ‘নারী উন্নয়নের মুখ’ হিসেবে, কিন্তু প্রকৃত সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের কোনো ভূমিকা থাকে না। ফলে নারী রাজনীতির বিকাশ মুখে মুখেই সীমিত থাকে। বাংলাদেশে রাজনীতি এখনও পরিবার ও বংশের রাজনীতি। অধিকাংশ নারী নেত্রীই রাজনৈতিক পরিবার থেকে আসেন বা স্বামী, ভাই, বাবা বা কোনো পুরুষ রাজনীতিকের ছায়ায় উঠে আসেন। এই ধারা শুধু ক্ষমতাসীন দলেই নয়, বিরোধী দল ও ধর্মভিত্তিক দলগুলোতেও প্রচলিত। এতে নারীর নিজের রাজনৈতিক পরিচয় গড়ে ওঠে না; বরং তার পরিচয় হয়ে ওঠে কারও স্ত্রী, কন্যা বা বোন হিসেবে। নারীর এই ‘প্রতীকী পরিচয়’ রাজনীতিতে সমান সুযোগের ধারণাকে নষ্ট করে দেয়। নিষিদ্ধ দল, আওয়ামী লীগে নারী নেতৃত্বও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শক্তিশালী হলেও সংগঠন কাঠামোয় তা দুর্বল। দলীয় সভা, কাউন্সিল বা কমিটি গঠনে নারী প্রতিনিধিত্ব খুবই সীমিত ছিল। তৃণমূল পর্যায়ে নারী সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক বিরল। নারী রাজনীতিকদের ভূমিকা অনেক সময় মাঠপর্যায়ের সামাজিক কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধ থাকতোনা তেমন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের টেবিলে তারা অনুপস্থিত। এই বাস্তবতা প্রমাণ করে যে, শীর্ষে নারী থাকা মানেই পুরো দল নারীবান্ধব নয়। বিএনপিতেও একই চিত্র। দলের নেতৃত্বে একজন নারী আছেন, কিন্তু দলীয় কাঠামো পুরুষতান্ত্রিক। জেলা, উপজেলা, ওয়ার্ড পর্যায়ে নারী নেত্রীদের সংখ্যা হাতে গোনা। নারী রাজনীতিকরা প্রায়ই বলেন- দল তাদের মূল্যায়ন করে না, মনোনয়নের ক্ষেত্রে সুযোগ দেয় না, কিংবা তাদের কাজকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ভূমিকা হয় কেবল মিছিল-মিটিংয়ে উপস্থিত থাকা বা দলের মুখ হিসেবে কাজ করা। প্রকৃত সংগঠন পরিচালনা বা কৌশলগত পরিকল্পনায় তাদের স্থান নেই। জামায়াতে ইসলামী বা ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ক্ষেত্রে নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ আরও সীমিত। জামায়াত ইসলামী নারীদের নিয়ে ‘মহিলা জামায়াত’ নামের আলাদা শাখা রাখলেও, সেটি মূল দলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। তাদের সভা বা কর্মসূচি ধর্মীয় কাঠামোর ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকে। এসব দলে নারীর রাজনীতি করার পরিবেশ এখনও সমাজের কঠোর রক্ষণশীলতার কারণে অস্বস্তিকর। অনেক সময় ধর্মীয় ব্যাখ্যার আড়ালে নারীর রাজনৈতিক ভূমিকা সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়। এতে নারী রাজনীতিকরা কেবল সামাজিক বা দাতব্য কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন, ক্ষমতার রাজনীতিতে নয়।
জাতীয় পার্টি বা ছোট দলগুলোতেও একই চিত্র। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারী নেত্রীদের ভূমিকা পারিবারিক উত্তরাধিকার বা প্রতীকী অবস্থানে সীমিত থাকে। রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে পুরুষদেরই আধিপত্য। নারীর নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা নেই, প্রশিক্ষণ বা সংগঠিত হওয়ার সুযোগও নেই। বাংলাদেশে সংসদে নারীদের উপস্থিতি একটি ইতিবাচক দিক বটে, কিন্তু সংরক্ষিত আসনব্যবস্থা এই সাফল্যকে সীমিত করেছে। সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে সংসদে অনেক নারী প্রবেশ করেন, কিন্তু তাদের অধিকাংশই দলের মনোনয়নে আসেন- জনগণের ভোটে নয়। ফলে তাদের ওপর দলের নিয়ন্ত্রণ থাকে, তারা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অবস্থান নিতে পারেন না। সংরক্ষিত আসনের এই কাঠামো নারীর নেতৃত্ব বিকাশের পরিবর্তে পুরুষ নেতৃত্বের প্রভাবকে আরও শক্তিশালী করে। রাজনৈতিক বৈষম্যের আরেকটি দিক হলো- নারী রাজনীতিকদের সামাজিক চিত্রায়ণ। তাদের কাজের পরিবর্তে প্রায়ই তাদের পোশাক, চলাফেরা বা ব্যক্তিগত জীবনকে কেন্দ্র করে আলোচনা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারী নেত্রীদের নিয়ে ট্রল, কটূক্তি, অবমাননাকর মন্তব্য নিয়মিত ঘটে। পুরুষ রাজনীতিকরা একই কাজ করলে প্রশংসা পান, কিন্তু নারী রাজনীতিকরা সমালোচিত হন। এটি একধরনের সাংস্কৃতিক সহিংসতা, যা নারীর রাজনীতিতে আগ্রহ কমিয়ে দেয়। তাছাড়া রাজনীতিতে নারীরা প্রায়ই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। সভা, মিছিল, নির্বাচনি প্রচারণায় তারা হয়রানি বা হুমকির মুখে পড়েন। আর্থিকভাবে অনেক নারী স্বনির্ভর নন, ফলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। পুরুষ নেতাদের আর্থিক ও সামাজিক নেটওয়ার্ক যেখানে শক্তিশালী, সেখানে নারী নেত্রীদের নিজের জায়গা তৈরি করতে হয় কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বলছে- নারী নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় বাধা সাংগঠনিক সংস্কৃতি। দলগুলো এখনও ব্যক্তিনির্ভর, গণতন্ত্রচর্চা সীমিত, মতবিনিময় বা বিতর্কের জায়গা নেই। সিদ্ধান্ত আসে উপর থেকে, নিচে কেবল বাস্তবায়ন হয়। এই কেন্দ্রীভূত কাঠামোতে নারী নেতৃত্বের বিকাশ অসম্ভব। নারীরা যারা সক্রিয়, তারা প্রায়ই নির্ভরশীল হয়ে পড়েন কোনো পুরুষ নেতার ওপর- যিনি তাদের সুযোগ করে দেন বা প্রতিশ্রুতি দেন। ফলে নেতৃত্ব স্বাধীন নয়; বরং পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত। তবু আশার আলো নিভে যায়নি। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে নারী প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা ও পৌরসভায় অনেক নারী এখন জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন। তারা মাঠপর্যায়ে জনগণের সঙ্গে সরাসরি কাজ করছেন, উন্নয়ন কার্যক্রমে যুক্ত হচ্ছেন, নিজেদের অবস্থান তৈরি করছেন। এই অভিজ্ঞতাই ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতিতে নারীর নেতৃত্বের ভিত্তি হতে পারে। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধিকে স্থায়ী করতে হলে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন। দলগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে কমিটির অন্তত এক-তৃতীয়াংশ নারী সদস্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, সংরক্ষিত আসনের বাইরে নারীদের সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণে উৎসাহ দিতে হবে, এবং দলীয় রাজনীতিতে নারীদের প্রশিক্ষণ ও নেতৃত্ব উন্নয়ন কর্মসূচি চালু করতে হবে।
এছাড়া গণমাধ্যম ও সমাজকেও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। নারী রাজনীতিকদের ‘নারী’ নয়, ‘নেতা’ হিসেবে দেখা জরুরি। তাদের রাজনৈতিক ভাবনা, কাজ ও অবদানকে মূল্যায়ন করতে হবে। রাজনীতিতে নারীর অগ্রগতি সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত; এটি কেবল নারী ইস্যু নয়, গণতন্ত্রের ইস্যু। বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক সন্ধিক্ষণে। একদিকে নারী রাষ্ট্রনেতৃত্ব, অন্যদিকে দলীয় কাঠামোয় নারীর প্রান্তিক অবস্থান। এই দ্বৈত বাস্তবতা ভাঙতে হলে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন অপরিহার্য। নারীকে কেবল স্লোগান বা প্রতীকে সীমাবদ্ধ না রেখে তাদের জন্য সমান সুযোগ, মর্যাদা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। নারীর নেতৃত্ব কোনো দয়া নয়, এটি প্রাপ্যতা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীরা শুধু সহযাত্রী নন, তারা ভবিষ্যতের স্থপতি। তাই এখন সময় এসেছে রাজনীতির কাঠামো থেকে বৈষম্যের অদৃশ্য প্রাচীর ভাঙার। ক্ষমতার টেবিলে নারী ও পুরুষকে একসঙ্গে বসতে হবে- সমান মর্যাদায়, সমান অধিকার নিয়ে। যেদিন বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলে নারী নেত্রীরা সিদ্ধান্ত গ্রহণে, নীতি প্রণয়নে, নির্বাচনি নেতৃত্বে পুরুষের সমান ভূমিকা পাবেন, সেদিনই দেশের রাজনীতি হবে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও মানবিক। ততদিন পর্যন্ত নারী নেতৃত্বের সাফল্য কেবল ইতিহাসের পাতা নয়, বাস্তব পরিবর্তনের অপেক্ষায় এক অসম্পূর্ণ স্বপ্ন হয়ে থাকবে।
এসএম রায়হান মিয়া
সিনিয়র শিক্ষক ও কলাম লেখক, গাইবান্ধা সদর, গাইবান্ধা
