গবেষণার শক্তিতেই টেকসই কৃষির ভবিষ্যৎ গড়ে উঠতে পারে
কৃষিবিদ ড. মো. আল-মামুন
প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের কৃষি এখন গবেষণানির্ভর এক উৎপাদন ব্যবস্থায় রূপ নিয়েছে। এক সময়ের মৌলিক চাষাবাদ আজ হয়ে উঠেছে প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি অর্থনীতি। মাঠে কৃষকের ঘাম আর গবেষণাগারে বিজ্ঞানীর মেধা, এই দুইয়ের মেলবন্ধনে কৃষি আজ এক নতুন সম্ভাবনার নাম। কৃষি বিজ্ঞানীদের হাতেই জন্ম নিচ্ছে ফসলের নতুন জাত, আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি, গবাদিপশুর উন্নয়ন পদ্ধতি, দুধ ও মাংসের মানোন্নয়ন, মৎস্যজাত উন্নত প্রযুক্তি, এমনকি কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও তারা রেখেছেন যুগান্তকারী ভূমিকা। তাদের উদ্ভাবনেই পুনর্গঠিত হয়েছে কৃষকের অর্থনৈতিকভিত্তি, জেগে উঠেছে গ্রামীণ জীবিকা, আর দেশের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন হয়েছে এক বাস্তব সাফল্যে। কৃষি গবেষণা প্রমাণ করেছে- গবেষণার ফল শুধু কাগজে নয়, মানুষের জীবনে বাস্তব পরিবর্তন আনতে পারে। এখন প্রয়োজন এই বিচ্ছিন্ন সাফল্যগুলোকে সমন্বিত করে একটি সুসংগঠিত জাতীয় কাঠামোয় রূপ দেওয়া। একসময় কৃষক শুধু নিজের ও পরিবারের খোরাকের জন্য ফসল ফলাতেন। আজ সেই কৃষকই বাজারের চাহিদা ও লাভের হিসাব মাথায় রেখে উৎপাদন করেন। বাংলাদেশের কৃষি এখন শুধু জীবিকার উৎস নয়, জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি।
বর্তমানে দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান প্রায় ১১ শতাংশ, কিন্তু কর্মসংস্থানে এর অংশ ৪১ শতাংশেরও বেশি। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যমতে, কৃষির উন্নতির কারণেই গত এক দশকে দেশে অতি-দারিদ্র্যের হার ৪৯ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ১০.৫ শতাংশে।
স্বাধীনতার পর দেশে দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল মাত্র ১ কোটি টন; এখন তা প্রায় ৫ কোটি টন। অথচ এ সময় জনসংখ্যা বেড়েছে আড়াই গুণ, আবাদযোগ্য জমি কমেছে প্রায় এক-চতুর্থাংশ। উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ, এটাই কৃষি গবেষণার সাফল্যের বাস্তব প্রমাণ। এই বিপ্লবের নেপথ্যে রয়েছে জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেম (NARS)-এর ১৪টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পর্যন্ত ৯৭২টি উচ্চফলনশীল ও ঘাতসহনশীল ফসলের জাত এবং ১,৩৯২টি উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এসব প্রযুক্তি শুধু খাদ্য নিরাপত্তাই নয়, পুষ্টি, আয় ও কর্মসংস্থানেরও স্থায়ী সমাধান দিয়েছে।
বাংলাদেশ আজ বিশ্ব কৃষিতে এক অনন্য উদাহরণ। ধান উৎপাদনে তৃতীয়, মাছ ও চা উৎপাদনে চতুর্থ, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয় এবং পাট রপ্তানিতে প্রথম স্থানে রয়েছে দেশটি। এছাড়া আলু উৎপাদনে অষ্টম, আমে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনেও বাংলাদেশ শীর্ষস্থান দখল করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়ও বাংলাদেশ পথপ্রদর্শক। বন্যা, খরা ও লবণাক্ততা সহিষ্ণু ফসল উদ্ভাবনে বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা এখন বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এমনকি গম ও ভুট্টা উৎপাদনে বাংলাদেশের ফলন হার বিশ্বের গড় হারের চেয়ে বেশি। প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতেও এই সাফল্য অব্যাহত। ডিম, দুধ ও মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই সাফল্যের প্রতিটি অধ্যায়ের কেন্দ্রে রয়েছেন কৃষি গবেষণার নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানীরা- যারা নিঃস্বার্থভাবে মাঠে, ল্যাবে ও মানুষের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন।তবে এই আলোচিত্রের মাঝেই লুকিয়ে আছে এক গভীর ছায়া। জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমভুক্ত প্রতিষ্ঠানে পদোন্নতি, বেতন কাঠামো, জনবল সংকট ও প্রশাসনিক বৈষম্যের কারণে গবেষণার গতি দিন দিন মন্থর হয়ে পড়ছে।
অনেক তরুণ কৃষিবিদ এ পেশায় আগ্রহ হারাচ্ছেন; কর্মরত গবেষকদের অনেকেই বিকল্প চাকরির দিকে ঝুঁকছেন। অথচ কৃষি গবেষণার কাজ অফিসের দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়- এটি মাঠে, ল্যাবে, কৃষকের পাশে নিরবচ্ছিন্ন এক পরিশ্রমের নাম। এই বাস্তবতা বিবেচনায় কৃষি গবেষণাকে বিশেষায়িত সার্ভিস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং গবেষকদের জন্য বিশেষ ভাতা চালু করা সময়ের দাবি। দেশের বিচার বিভাগ বা প্রশাসনের মতোই কৃষি গবেষণাকে কৌশলনির্ভর ও মর্যাদাপূর্ণ সার্ভিস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা দরকার - যেখানে মেধা, শ্রম ও উদ্ভাবনই হবে মূল মাপকাঠি।
জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮-এর ৩.১.৩ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে ‘কৃষি গবেষণার চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে হবে।’ একইভাবে জাতীয় বেতন কমিশন ২০২৫-এর কর্মপরিধিতেও জনপ্রশাসনে মেধাবী কর্মকর্তা নিয়োগের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যদি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে একইভাবে মেধাবী জনবল আকৃষ্ট ও ধরে রাখা না যায়, তাহলে কৃষির ভবিষ্যৎ উন্নয়ন থমকে যাবে।
সুতরাং এখনই প্রয়োজন স্বতন্ত্র ক্যারিয়ার কাঠামো, পদোন্নতির স্বচ্ছ ব্যবস্থা, এবং গবেষকদের পেশাগত মর্যাদা নিশ্চিত করা। এটি শুধু বিজ্ঞানীদের দাবিই নয়, এটি বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার শর্ত। বাংলাদেশে গবেষণার গল্প তাই একদিকে উজ্জ্বল আলো, অন্যদিকে অনিবার্য ছায়া। আলো হলো আমাদের মেধা, উদ্ভাবনী শক্তি ও তরুণ প্রজন্মের সম্ভাবনা; ছায়া হলো দুর্বল সিস্টেম, স্বল্প অর্থায়ন ও নীতিগত সীমাবদ্ধতা। গবেষণাকে আমরা প্রায়ই ব্যয় হিসেবে দেখি, বিনিয়োগ হিসেবে নয়। অথচ উন্নত দেশগুলো গবেষণাকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ মনে করে। গবেষণার মানদ- যদি উদ্ভাবনের মাত্রা, সামাজিক প্রভাব ও ব্যবহারযোগ্যতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়, তাহলে গবেষকরা আরও অনুপ্রাণিত হবেন পরিবর্তন আনতে। গবেষণা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের হাতিয়ার। যে জাতি গবেষণাকে অগ্রাধিকার দেয়, তারাই ইতিহাস বদলায়।
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পেছনে ছিল কৃষি গবেষণার সাফল্য। লবণাক্ততা সহনশীল বা খরাপ্রতিরোধী ধানের জাত শুধু কৃষকের জীবনেই নয়, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎেও পরিবর্তন এনেছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখন প্রয়োজন কৃষিকে আরও উৎপাদনমুখী ও বাণিজ্যিকীকরণযোগ্য করে তোলা। এজন্য কৃষি গবেষণায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, বেসরকারি অংশীদারিত্ব, কৃষি ইপিজেড গঠন, এবং পূর্ণাঙ্গ যান্ত্রিকীকরণ অপরিহার্য। এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন হলে গবেষণার সুফল কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছাবে, কৃষক হবেন প্রযুক্তির সরাসরি উপকারভোগী। তাতেই গড়ে উঠবে এক বিজ্ঞাননির্ভর টেকসই কৃষি বাংলাদেশ, যেখানে গবেষণা, প্রযুক্তি ও অর্থনীতি একসূত্রে গাঁথা থাকবে।
বাংলাদেশের কৃষি আজ শুধু চাষাবাদের ক্ষেত্র নয়; এটি এক বিজ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির স্তম্ভ। কিন্তু যাদের মেধা ও শ্রমে এই সাফল্যের গল্প রচিত, সেই কৃষি বিজ্ঞানীরাই আজ প্রণোদনা ও স্বীকৃতির অপেক্ষায়। বাংলাদেশ আজ খাদ্যনিরাপত্তায় স্বনির্ভর, কৃষি উৎপাদনে দৃষ্টান্ত। এই সাফল্যের মূল কারিগর আমাদের গবেষকরা- যারা দিনরাত মাঠে ও ল্যাবে কাজ করে যাচ্ছেন, প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবে। তাদের প্রাপ্য মর্যাদা, সম্মান ও প্রণোদনা নিশ্চিত করা এখন সময়ের অপরিহার্য দাবি। কারণ, যাদের হাতে বাংলাদেশের কৃষি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তাদের হাতেই ভবিষ্যতের টেকসই কৃষি বাংলাদেশের ভিত্তি গড়ে উঠবে।
গবেষণায় বিনিয়োগকে ব্যয় নয়, ভবিষ্যতের পুঁজি হিসেবে দেখতে হবে। উন্নত দেশে গবেষক মানেই জাতির সম্পদ। আমাদের দেশে তারা অনেক সময় প্রাপ্য সম্মান, সুযোগ ও সামাজিক স্বীকৃতি পান না। ফলে অনেক মেধাবী তরুণ গবেষণার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন বা বিদেশে চলে যান। অথচ পর্যাপ্ত অবকাঠামো, অর্থায়ন ও মর্যাদা নিশ্চিত করা গেলে তারাই বাংলাদেশের কৃষিকে বৈশ্বিক মানচিত্রে আরও উজ্জ্বল করতে পারতেন। গবেষণা মূল্যায়নে সামাজিক প্রভাব ও বাস্তব প্রয়োগযোগ্যতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পাশাপাশি, গবেষকদের নীতি নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি- যাতে তারা শুধু ল্যাবেই নয়, রাষ্ট্রনীতিতেও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেন।
কৃষিবিদ ড. মো. আল-মামুন
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা
