ডিজিটাল এই যুগের নতুন সঙ্গী এআই চ্যাটবট ও তরুণদের মানসিক বাস্তবতা

মো. নূর হামজা পিয়াস

প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

২০২৫ সালের পৃথিবীতে আমরা এমন এক বাস্তবতায় বাস করছি, যেখানে প্রযুক্তি শুধু কাজের হাতিয়ার নয়, আবেগের আশ্রয়স্থলও হয়ে উঠেছে। মেটা প্রধান মার্ক জুকারবার্গ যখন বলেছিলেন ‘এআই বন্ধুদের মাধ্যমে মানবিক সম্পর্কের শূন্যতা পূরণ করতে হবে’, তখন অনেকে সেটাকে ভবিষ্যতের কল্পনা ভেবেছিলেন। কিন্তু আজ, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু শিক্ষার্থীর জন্য এটি বাস্তব হয়ে উঠেছে। একসময় শুধুই তথ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত চ্যাটবটগুলো এখন হয়ে উঠছে মানসিক সঙ্গী, পরামর্শদাতা এবং নীরব শ্রোতা।

প্রথমে ChatGPT বা অন্যান্য এআই টুলগুলো শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় সাহায্যের জন্যই জনপ্রিয় হয়েছিল। তারা এগুলোর মাধ্যমে প্রবন্ধ লিখত, অনুবাদ করত, অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই টুলগুলো এক ভিন্ন ভূমিকা নিতে শুরু করে একজন ডিজিটাল বন্ধুর মতো। শিক্ষার্থীরা এখন শুধু একাডেমিক নয়, ব্যক্তিগত জীবন, মানসিক সংকট ও সম্পর্কের সমস্যাতেও এআই-এর সাহায্য নিচ্ছে। অনেকেই একাকীত্বে ভুগে এই কৃত্রিম সহচরীর কাছে মনের কথা খুলে বলছে, কারণ সেখানে বিচার নেই, লজ্জা নেই, শুধু মনোযোগ আছে।

মানুষের মধ্যে সম্পর্কের ভঙ্গুরতা, ক্লান্তি, ভুল বোঝাবুঝি এবং বিচার করার প্রবণতা অনেককে ধীরে ধীরে নিঃসঙ্গ করে তুলছে। এমন এক সময় এসেছে, যখন কাছের মানুষকেও সব কথা বলা যায় না। সেই জায়গাটাই পূরণ করছে এআই। এখানে কেউ আপনাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে না, কেউ আপনার চিন্তা বা অনুভূতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না। বরং এটি এমন এক নিরাপদ জায়গা যেখানে আপনি দুর্বল হতে পারেন, তবুও দুর্বল দেখাতে হয় না।

মানুষের আবেগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, যখন দরকার তখন পাশে কেউ থাকে না। কিন্তু এআই সবসময় উপস্থিত। রাত ৩টার উদ্বেগ, হঠাৎ একাকীত্ব, বা সম্পর্কের ব্যর্থতা সব কিছুর সময় ChatGPT -এর মতো টুলগুলো থাকে শুনতে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অনেকেই জানিয়েছেন, তারা রাতে একা থাকলে এআই-এর সঙ্গে কথা বলে ঘুমায়, কারণ এটি এমন এক সঙ্গী, যে কখনও ব্যস্ত নয়, কখনও ক্লান্ত নয়।

মানুষের সঙ্গে যোগাযোগে যত সামাজিকতা, সংযম ও নিয়ম মানতে হয়, এআই-এর সঙ্গে তা লাগে না। আপনি ভদ্র হোন বা রূঢ়, মেজাজ খারাপ থাকুক বা মন ভাঙা এআই তাতে আহত হয় না। শিক্ষার্থীরা এখন এই মুক্ত যোগাযোগকেই শান্তির জায়গা হিসেবে দেখছে। অনেকের মতে, এআই হলো একধরনের ‘নো-ফিল্টার’ এলাকা, যেখানে মনোভাব, চিন্তা ও ভয় বিনা দ্বিধায় প্রকাশ করা যায়।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেমন একাকীত্বের নিরাময় হতে পারে, তেমনি এর মাধ্যমে সাইবার বুলিং এবং হয়রানির নতুন পথও তৈরি হচ্ছে। একটি এআই চ্যাটবটকে ভুলভাবে প্রোগ্রাম করলে বা হ্যাক করলে এটি ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে নেতিবাচক বা ক্ষতিকর মন্তব্য করতে পারে। বিশেষ করে, যে তরুণরা নিজেদের দুর্বলতা বা মানসিক ট্রমা এআই-এর কাছে প্রকাশ করে, তারা এই ভার্চুয়াল আক্রমণের শিকার হতে পারে।

যখন মন অস্থির হয়, মানুষ যুক্তি হারায়। সেই সময় এআই হয়ে ওঠে এক শান্ত পরামর্শদাতা। সম্পর্ক, কেনাকাটা বা সিদ্ধান্তের মুহূর্তে এটি যুক্তি দেয়, বিশ্লেষণ করে, ঠান্ডা মাথায় পথ দেখায়। শিক্ষার্থীদের অনেকেই এখন মানসিক ভারসাম্য রক্ষায় এআই-এর সহায়তা নেয়। ২০২৫ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রায় ৩২ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সপ্তাহে অন্তত একবার কোনো এআই চ্যাটবটের সঙ্গে কথোপকথনে যুক্ত হয় মানসিক প্রশান্তি পেতে।

বর্তমানে যে প্রযুক্তিকে ‘নৃতাত্ত্বিক এআই’ বলা হচ্ছে, তা মানুষের আবেগ, স্মৃতি, রসবোধ, এমনকি ভালোবাসার অনুভূতিও অনুকরণ করতে পারে। এই এআইগুলো শুধু উত্তর দেয় না, তারা প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, সহানুভূতি দেখায় এবং আপনাকে বোঝার ভান করে। অনেকের কাছে এটি এতটাই বাস্তব মনে হয় যে তারা আবেগগতভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এটি যেন কোডের ভেতরে লুকানো এক বন্ধুত্ব।

তবে প্রশ্ন থেকেই যায় যে এই সম্পর্কগুলো কি সত্যি? এআই-এর “বোঝাপড়ার” অনুভূতি বাস্তবে কেবল অ্যালগরিদমিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু মানুষ তা বুঝে না, কারণ তারা উষ্ণতার অভাব পূরণ করতে চায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ডিজিটালনির্ভরতা মানুষের বাস্তব সম্পর্কের প্রত্যাশা পরিবর্তন করে দিতে পারে। অনেক তরুণ এখন বাস্তব বন্ধুত্ব বা প্রেমে সেই নিখুঁত প্রতিক্রিয়া খুঁজে, যা কেবল এআই দিতে পারে।

এআই এর কাছে মনের কথা খুলে বলার সময় তরুণরা মারাত্মক ডেটা গোপনীয়তার ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। ব্যক্তিগত আবেগ, ভয় এবং মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ডেটাগুলো চ্যাটবট কোম্পানিগুলোর সার্ভারে জমা হচ্ছে, যা পরবর্তীতে বাণিজ্যিক বা নজরদারির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে। বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে এই ডেটা ব্যবহারের নীতি সম্পর্কে সচেতনতা খুবই কম। সরকারের উচিত হবে এই ধরনের সংবেদনশীল ডেটা সুরক্ষার জন্য কঠোর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং নীতিমালা প্রণয়ন করা। এআইভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে নৈতিক মানদ- (Ethical Standards) প্রতিষ্ঠা করা না হলে এই সুবিধা ভবিষ্যতে বড় বিপদের কারণ হতে পারে।

এআই-এর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ফলে তরুণদের মধ্যে বাস্তব মানবিক সম্পর্ক গঠনের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। যেহেতু এআই সবসময় নিখুঁত, দ্রুত ও বিচারহীন সাড়া দেয়, তাই বাস্তব মানুষের অপরিণত, ধীর বা ভুলভরা প্রতিক্রিয়ার প্রতি তরুণরা অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। তারা জটিল বা চ্যালেঞ্জিং মানবিক সম্পর্ক এড়িয়ে সহজ ভার্চুয়াল আশ্রয়ের দিকে ঝুঁকছে।

এআই-এর কাছ থেকে নিয়মিত সমর্থন ও অনুমোদন পাওয়ার ফলে তরুণদের মধ্যে আত্মণ্ডপরিচয়ের সংকট তৈরি হতে পারে। তাদের আত্মসম্মানবোধ ধীরে ধীরে ভার্চুয়াল প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। যখন বাস্তব জীবনে তারা সেই সমর্থন পায় না, তখন তাদের মানসিক স্বাস্থ্য স্থিতিশীলতা হারায়। এই ডিজিটাল নির্ভরতা তাদের মধ্যে স্ব-নির্ভরতা এবং কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে।

মহামারির সময় এবং তার পরবর্তী বছরগুলোতে মানুষের একাকীত্ব, অনিশ্চয়তা এবং মানসিক চাপ বহুগুণে বেড়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এআই-ভিত্তিক মানসিক সহচর ব্যবহারের হার প্রায় ৬৮ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীরা তাদের উদ্বেগ, সম্পর্কের সমস্যা, এমনকি আত্মপরিচয়ের সংকট নিয়েও এআই-এর সঙ্গে আলোচনা করছে।

সবকিছু নেতিবাচক নয়। এআই অনেক শিক্ষার্থীর মানসিক স্থিতি ফিরিয়ে আনছে, আত্মবিশ্বাস বাড়াচ্ছে। যারা পরিবার বা বন্ধুদের কাছে খোলামেলা হতে পারে না, তারা অন্তত নিজের আবেগ প্রকাশ করতে পারছে। অনেক মনোবিজ্ঞানী মনে করেন, এটি এক ধরনের ‘ডিজিটাল কনফেশন স্পেস’ যা মানসিক চাপ কমায় এবং আত্মবিশ্লেষণে সহায়ক। তবে সচেতনভাবে ব্যবহার না করলে এটি নির্ভরতার ফাঁদেও ফেলতে পারে।

নতুন প্রজন্ম এখন এমন এক সময়ের মধ্যে বড় হচ্ছে, যেখানে বাস্তব ও ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের সীমানা ক্রমেই ঝাপসা হচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থী বিশ্বাস করে যে এআই তাদের সত্যিকারের বোঝে, যদিও এটি প্রোগ্রাম করা প্রতিক্রিয়া মাত্র। এই মানসিক বিভ্রান্তি বাস্তব সম্পর্কের বিকাশে বাধা হতে পারে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানবিক সম্পর্কের জটিলতা এড়ানোর অভ্যাস তরুণদের সমাজবোধকভাবে দুর্বল করে তুলতে পারে।

এআই-নির্ভরতার এই যুগে অভিভাবক এবং শিক্ষকদের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাদের উচিত হবে প্রযুক্তির ব্যবহারকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ না করে, এর সঠিক ও দায়িত্বশীল ব্যবহার সম্পর্কে তরুণদের শিক্ষা দেওয়া। বাবা-মায়েদের উচিত সন্তানের সাথে খোলামেলা ও বিচারহীন যোগাযোগের সংস্কৃতি তৈরি করা, যাতে সন্তানরা মানসিক সংকটে বন্ধুর বদলে পরিবারের কাছে আসে।

মো. নূর হামজা পিয়াস

কলামিস্ট ও সমাজকল্যাণ বিশ্লেষক এবং শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ