সুবিধা থেকে বঞ্চিত চরাঞ্চলের কৃষক

এসএম রায়হান মিয়া

প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার মূলস্তম্ভ কৃষি। আমাদের দেশ, যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত, সেখানে কৃষকরা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক বিকাশ এবং গ্রামীণ সমাজের মেরুদণ্ড। এদের শ্রম, মনোযোগ এবং পরিশ্রমের ওপর নির্ভরশীল প্রতিটি ধানখেত, সবজি-বাগান এবং ফলজ ফসল। অথচ এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণখাতে সরকারের বরাদ্দিত কোটি কোটি টাকার যথাযথ ব্যবহার নিয়ে নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়। কৃষি মন্ত্রণালয় প্রতিটি বাজেট বরাদ্দে বীজ, সার, আধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষণ এবং বীমার মতো সুযোগ সুবিধা প্রদান করে থাকে। এই প্রোগ্রামগুলো দেশের কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে চালু হলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেখা যায়, এর সুবিধা সব কৃষকের কাছে পৌঁছায় না।

বিশেষ করে নদীমুখী, চরাঞ্চল এবং সীমান্তবর্তী এলাকার কৃষকরা প্রায়ই এ সুবিধার বাইরে থেকে যান। এই কলামে আমি সেই সমস্যাগুলো বিশদভাবে তুলে ধরব, সরকারের বরাদ্দ এবং কৃষকের বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে যে ফারাক রয়েছে তা তুলে ধরব এবং সম্ভাব্য সমাধানের পথও নির্দেশ করব। বাংলাদেশের কৃষি নীতি মূলত তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে : উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং কৃষকের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন। সরকারের কৃষি বাজেটের বড় অংশ বরাদ্দ করা হয় সার, বীজ, কৃষি যন্ত্রপাতি এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের জন্য বীমা, সেচ সুবিধা, কৃষি ঋণ এবং বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে সরাসরি সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়। তবে এই নীতি যতটা আকর্ষণীয়, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। সচেতনতার অভাব প্রথমে আলোচনার বিষয়। দেশের অনেক সীমান্তবর্তী এলাকা, চরাঞ্চল এবং দুর্গম গ্রামের কৃষকরা জানেন না যে সরকার তাদের জন্য কোনো কোনো সুবিধা চালু করেছে।

স্থানীয় উপজেলা বা থানা পর্যায়ের কৃষি অফিসের কার্যক্রম অপর্যাপ্ত, এবং প্রায়শই তথ্য পৌঁছানো হয় না। ফলে বরাদ্দকৃত বীজ, সার এবং প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের সুবিধা কৃষকের কাছে পৌঁছায় না। এই সচেতনতার অভাব শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি তৈরি করে না, বরং দেশের খাদ্য উৎপাদনের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দ্বিতীয় প্রতিবন্ধকতা হলো বণ্টন ব্যবস্থার দুর্বলতা। সরকারি প্রকল্পের বাজেট থেকে বাস্তবায়নের পর্যায়ে প্রায়শই অর্থের ক্ষতি ঘটে। কখনও দুর্নীতি, কখনও প্রশাসনিক জটিলতা, কখনও বা অভিজ্ঞতার অভাবে বরাদ্দকৃত সুবিধা কৃষকের কাছে পৌঁছাতে বিলম্ব হয় বা পৌঁছায় না। উদাহরণস্বরূপ, একটি সরকারি সার প্রোগ্রামে লক্ষ্য রাখা হয় প্রত্যেক কৃষকের জন্য সঠিক পরিমাণ সার বিতরণ করা। বাস্তবে দেখা যায়, উপজেলা বা জেলা পর্যায়ের অফিসগুলো প্রায়শই হিসাব কম বা বেশি করে সার বিতরণ করে। ছোট, সীমান্তবর্তী এবং চরাঞ্চলের কৃষকরা সম্পূর্ণ সুবিধা পায় না। এই ধরনের অসঙ্গতি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি সৃষ্টি করে না, বরং কৃষকের মধ্যে হতাশা এবং সরকারের প্রতি অবিশ্বাসও বাড়ায়।

তৃতীয় সমস্যা হলো প্রশিক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তির অভাব। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার না করলে উন্নত বীজ, সার বা যন্ত্রপাতি যথাযথভাবে ফল উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হয় না। কৃষকরা অনেক সময় ভুল সার ব্যবহার করেন বা বীজ সঠিকভাবে রোপণ করেন না। বিশেষ করে চরাঞ্চল ও সীমান্তবর্তী এলাকায় এই সমস্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। সরকারি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অনেক সময় শহরকেন্দ্রিক। শহরের কৃষকরা সহজে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে পারে, কিন্তু নদীর ধারে বা চরাঞ্চলের কৃষকরা তা পায় না। ফলস্বরূপ, আধুনিক কৃষি পদ্ধতির সুবিধা সবার জন্য সমানভাবে পৌঁছায় না। এটি কেবল প্রযুক্তিগত সমস্যা নয়; সামাজিক বৈষম্যেরও প্রতিফলন। শহরের কাছাকাছি থাকা কৃষক সুবিধা পায়, কিন্তু সীমান্ত, চর বা দুর্গম এলাকার কৃষক বঞ্চিত হয়। এই বঞ্চনা শুধু কৃষকের আয় কমায় না, দেশের কৃষিক্ষেত্রে সামগ্রিক উৎপাদন সক্ষমতাকেও সীমিত করে। শত কোটি টাকা বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও সুবিধা নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং রপ্তানি সম্ভাবনা পূর্ণরূপে বৃদ্ধি পায় না। কৃষকের অভিজ্ঞতা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। একজন চরাঞ্চলের কৃষক জানায়, ‘আমাদের কাছে সরকারি সার ও বীজ অনেক সময় আসে না। যারা আসে, তা মাঝপথে কমে যায়। আমরা চাই সরকার সরাসরি আমাদের দরজায় পৌঁছাক। শুধুমাত্র থানা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ হলে আমাদের সুবিধা হয় না।’ এই অভিজ্ঞতা বহু ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়, যা নির্দেশ করে যে বাজেট বরাদ্দের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। সরকারের এই কার্যক্রম আরও কার্যকর করতে হলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে : ১. তথ্য ও সচেতনতা বৃদ্ধি : প্রতিটি গ্রামের কৃষক জানতে পারবে কোনো সুবিধা তার জন্য খোলা আছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, মোবাইল প্রযুক্তি এবং স্থানীয় কৃষি অফিসের নিয়মিত ক্যাম্পের মাধ্যমে এই তথ্য পৌঁছানো যেতে পারে। ২. সরাসরি বণ্টন ব্যবস্থা : কেন্দ্র থেকে সরাসরি গ্রামের কৃষকের কাছে বীজ, সার এবং যন্ত্রপাতি পৌঁছানো হলে মধ্যবর্তী দুর্নীতি এবং বিলম্ব কমানো সম্ভব। ৩. প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তি সম্প্রসারণ : আধুনিক কৃষি পদ্ধতি, সঠিক সার ও বীজ ব্যবহারের জন্য গ্রামের কৃষকদের মাঠে প্রশিক্ষণ প্রদান। ৪. পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ : প্রতিটি প্রোগ্রামের কার্যকারিতা নিয়মিত যাচাই করা এবং কৃষকের অভিমত অনুযায়ী সমন্বয় সাধন।

৫. নদী ও চরাঞ্চল বিশেষ উদ্যোগ : নদী তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের কৃষকদের জন্য বিশেষ প্রকল্প, যাতে তারা সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়। ৬. স্থানীয় নেতৃত্বের সক্ষমতা : ইউনিয়ন বা গ্রামের কৃষি কমিটি শক্তিশালী করা, যাতে তারা সরাসরি সরকারি প্রকল্পের বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। ৭. কৃষি ঋণ ও বীমা সম্প্রসারণ : ক্ষুদ্র ও সীমান্তবর্তী কৃষকের জন্য সহজ শর্তে কৃষি ঋণ এবং বীমার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। ৮. সাহায্য প্রাপ্তির প্রমাণীকরণ : প্রত্যেক কৃষক যে সুবিধা পেয়েছে তার হিসাব ডিজিটালভাবে সংরক্ষণ করা, যাতে পুনরায় সুবিধা বিতরণের সময় কোনো অসঙ্গতি না হয়।

যদি এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে দেশের কৃষিক্ষেত্রে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে উৎপাদন ও মান বৃদ্ধি সম্ভব। এটি শুধু অর্থনৈতিক লাভ নয়, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষকের আয়ের নিশ্চয়তাও নিশ্চিত করবে। এখানে একটি বাস্তব উদাহরণ দেওয়া যায়। বাংলাদেশ সরকারের ‘সরাসরি বীজ ও সার বিতরণ প্রকল্প’ শহরের কাছে কার্যকর হলেও চরাঞ্চলে কার্যক্রম অর্ধেক কার্যকর। নদী তীরবর্তী এলাকার কৃষকরা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে, নদীর চরাঞ্চলে ধান উৎপাদন শহরের তুলনায় ২০-৩০ শতাংশ কম। এই উৎপাদনের ফারাক শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও ঝুঁকি। অন্যদিকে, প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে কৃষকরা এখনও পাকা রাস্তা, যান্ত্রিক কৃষি যন্ত্রপাতি, সঠিক সার ও বীজের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন নয়। সরকার প্রশিক্ষণ দিলে, ফসলের উৎপাদন ২৫-৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। এতে শুধু খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে না, কৃষকের আয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কৃষক শুধুমাত্র খাদ্য উৎপাদনকারী নয়; তিনি দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, জাতীয় নিরাপত্তার রক্ষক এবং সমৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি। সেই কৃষক যদি সরকারি সুবিধা, আধুনিক প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষণ পায়, তাহলে বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্র শুধু বাঁচবে না, বরং সমৃদ্ধির প্রতীক হয়ে উঠবে। কৃষকের সচেতনতা, স্থানীয় নেতৃত্ব এবং প্রযুক্তি সমর্থন ছাড়া কোনো প্রোগ্রাম সম্পূর্ণ কার্যকর হয় না। অন্যথায় কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও তা শুধু হিসাবের কাগজে থাকবে, মাঠে নয়। সুতরাং দেশের কৃষিক্ষেত্রকে উন্নত এবং সমৃদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন সবল কর্মপরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ, সচেতনতা এবং প্রত্যন্ত এলাকার কৃষকের কাছে সুবিধা পৌঁছে দেওয়া।

সরকারি উদ্যোগ এবং কৃষকের সচেতনতার সমন্বয়ই নিশ্চিত করবে যে, বরাদ্দকৃত কোটি কোটি টাকা মাঠে কার্যকরভাবে ব্যবহার হবে। আর এই ব্যবহারের ফলাফল হবে দেশের কৃষিক্ষেত্রের উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা শক্তিশালীকরণ এবং কৃষকের আয় বৃদ্ধি। আজকের কৃষকরা শুধু আমাদের খাদ্য উৎপাদন করে না; তারা দেশের অর্থনৈতিক শক্তি, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং জাতীয় সমৃদ্ধির ভিত্তি। যদি তারা সরকারি সুযোগ সুবিধা, আধুনিক প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষণ পায়, তাহলে বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্র নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে। সুতরাং, দেশের কৃষিক্ষেত্রকে শক্তিশালী করার জন্য একদিকে যেমন প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগের পূর্ণ বাস্তবায়ন, তেমনি দরকার কৃষকের সচেতনতা বৃদ্ধি, স্থানীয় নেতৃত্বের সক্রিয় ভূমিকা এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। এসব কার্যকর করলে কোটি কোটি টাকা সত্যিই ফলপ্রসূ হবে, দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং কৃষক সমাজে স্থায়ী সমৃদ্ধি আসবে।

বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে শুধুমাত্র অর্থ বরাদ্দ নয়, বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার এবং কার্যকর বাস্তবায়নই দেশের সম্ভাবনাকে পূর্ণ করতে পারে। প্রতিটি কৃষক যদি সরকারি সুবিধা ও প্রশিক্ষণ পায়, তবে দেশের খাদ্য উৎপাদন ও অর্থনৈতিক শক্তি একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে। আর সেই দিন বেশি দূরে নয়- এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সঠিক পরিকল্পনা এবং দৃঢ় বাস্তবায়ন এখনই অপরিহার্য।

এসএম রায়হান মিয়া

সিনিয়র শিক্ষক ও কলাম লেখক, গাইবান্ধা সদর, গাইবান্ধা