পেটের দায় ও টিকে থাকার সংগ্রামই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে
মো. নূর হামজা পিয়াস
প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
যে কোনো সমাজের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সামাজিক বৈষম্য অপরাধে প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। একদিকে হোয়াইট-কলার অপরাধ নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলেও, অন্যদিকে ব্লু-কলার অপরাধ বা নিম্নবিত্ত শ্রেণির অপরাধগুলো প্রায় অদৃশ্য থেকে যায়। এই অপরাধগুলো সাধারণত চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি বা খুনের মতো সরাসরি সহিংস কর্মকাণ্ড। কিন্তু এগুলোর পেছনে লুকিয়ে থাকে গভীর সামাজিক বঞ্চনা, বেকারত্ব, দারিদ্র্য এবং সুযোগের অভাব। তাই এ ধরনের অপরাধ শুধু অপরাধ নয়, বরং সমাজের অসমতা ও অর্থনৈতিক হতাশার একটি প্রতিফলন। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক কাঠামো ব্লু-কলার অপরাধের জন্য একটি উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করেছে। দেশের প্রায় ৩৫ শতাংশ জনগণ এখনও দরিদ্রসীমার নিচে বাস করছে (বিআইডিএস, ২০২৫ অনুসারে)। দ্রুত নগরায়ন, অপ্রতুল কর্মসংস্থান ও আয়বৈষম্য এই অপরাধের মূলে রয়েছে। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে প্রতিদিন গড়ে ২০টিরও বেশি ছিনতাই বা ছোটখাটো চুরির ঘটনা পুলিশের নথিভুক্ত হয়। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি, কারণ অনেক ঘটনাই রিপোর্ট হয় না। ফলে শহুরে জীবনে নিরাপত্তাহীনতা এখন নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থানের অভাবে হাজার হাজার মানুষ কাজের সন্ধানে শহরে আসে। কিন্তু শহরের বস্তিও অনানুষ্ঠানিক আবাসন এলাকায় এসে তারা পায় না স্থায়ী কাজ, পায় না শিক্ষা বা স্বাস্থ্যসেবা। এমন পরিস্থিতিতে অনেকে অপরাধের পথ বেছে নেয় টিকে থাকার তাগিদে। সমাজবিজ্ঞানীরা এটিকে ‘বেঁচে থাকার অপরাধ’ বলে উল্লেখ করেন। আশুলিয়া, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর ও তেজগাঁওয়ের মতো এলাকাগুলোতে এই অপরাধের ঘনত্ব ক্রমেই বাড়ছে, যা ২০২৫ সালে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী গত পাঁচ বছরে ৪২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দক্ষিণ এশীয় অপরাধ বিদ্যায় ব্লু-কলার অপরাধকে প্রায়ই ‘প্রয়োজনীয় অপরাধ’ বলা হয়। কারণ এটি প্রায়ই দারিদ্র্য মানুষের জীবনের টিকে থাকার সংগ্রামের অংশ। কাজের অভাব, দাম বেড়ে যাওয়া খাদ্যপণ্য, বাসাভাড়া, চিকিৎসা খরচ সব মিলিয়ে নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন হয়ে উঠছে দুঃসহ। ২০২৫ সালের পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকায় গড় দৈনিক আয়ের মানুষদের মধ্যে ৪৭ শতাংশের আয় পরিবার চালানোর প্রয়োজনের চেয়ে কম। ফলে অনেকের কাছে অপরাধ হয়ে ওঠে এক ধরনের বাঁচার কৌশল। বাংলাদেশে ব্লু-কলার অপরাধের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সম্পত্তি-সম্পর্কিত অপরাধ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি মাসে গড়ে ৫৫০টিরও বেশি চুরি, ১৭০টি ছিনতাই ও৩৫টি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এর অধিকাংশই ঘটে নিম্নআয়ের এলাকার আশপাশে। চুরি বা ডাকাতি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, এটি সাধারণ মানুষের মানসিক নিরাপত্তাকে নষ্ট করে দেয়। এই অপরাধীরা সাধারণত সংগঠিত নয়, বরং তাৎক্ষণিক সুযোগ বা হতাশা থেকেই অপরাধে জড়ায়।
বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি ও ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ওপর নির্ভর করে। এই পুরনো আইন কাঠামো আধুনিক অপরাধ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রায় অক্ষম। তাছাড়া, সাদা-কলার অপরাধীরা অর্থ ও প্রভাবের জোরে প্রায়শই শাস্তি এড়িয়ে যায়, কিন্তু ব্লু-কলার অপরাধীরা দ্রুত ধরা পড়ে এবং কঠোর সাজা পায়। এই বৈষম্য আইনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে। বিচার বিলম্ব,সাক্ষীর অনুপস্থিতি ও দুর্নীতি এই ব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করে তুলছে। এই ধরনের অপরাধ সাধারণত পুরুষের দ্বারা সংঘটিত হলেও, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে নারীদের অপরাধে জড়ানোর প্রবণতাও বাড়ছে। দারিদ্র্য, স্বামীর নির্যাতন বা মাদকাসক্তি এবং সন্তানদেও লালন-পালনের চাপ অনেক নারীকে ছোটখাটো চুরি, মাদক বহন বা দালালির মতো অপরাধে বাধ্য করছে। মহিলা অপরাধীদের জন্য পৃথক পুনর্বাসন কর্মসূচি ও মনস্তাত্ত্বিক সহায়তার অভাব রয়েছে। ন্যায়বিচার সবার জন্য সমান হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে তা নয়। বাংলাদেশের লিগ্যাল এইড সার্ভিস ট্রাস্টের (২০২৫) তথ্যে দেখা গেছে, দরিদ্র আসামিদের মধ্যে মাত্র ১৭ শতাংশ কার্যকর আইনি সহায়তা পান। অর্থের অভাবে অনেকেই আদালতে যেতে পারেন না। এর ফলে তারা সহজেই দোষ স্বীকার করে শাস্তি মেনে নেন, যদিও তারা অনেক সময় নির্দোষ। এই অবস্থায় ন্যায়বিচার একটি প্রাপ্তিযোগ নয়, বরং একটি প্রিভিলেজে পরিণত হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে যখন সব সুযোগ-সুবিধা অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, তখন নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর ডিজিটাল জ্ঞান ও ডিভাইসের অভাব তাদের সুযোগ থেকে আরও বঞ্চিত করছে। শিক্ষা, চাকরি এবং সরকারি পরিষেবা থেকে তারা বিচ্ছিন্ন থাকায় হতাশায় অপরাধের দিকে ঝুঁকছে। বাংলাদেশে বর্তমানে তরুণ বেকারত্বের হার ২০.৪ শতাংশ (২০২৫ সালের শ্রম জরিপ অনুসারে)। এই তরুণরা, বিশেষ করে নিম্নশিক্ষিত বা অভিবাসন ব্যর্থ যুবকরা, সহজেই অপরাধ চক্রের হাতে পড়ে। ছোটখাটো ছিনতাই, মোটরসাইকেল চুরি, বা পকেটমারি তাদের কাছে আয়ের উপায় হয়ে ওঠে। আবার মাদক ব্যবসার মতো অপরাধমূলক কাজে অনেকেই যুক্ত হয় টাকার লোভে। এই প্রজন্মের সামাজিক অবক্ষয় শুধু অপরাধ নয়, ভবিষ্যতের জন্য এক গভীর বিপদ। ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে মানসিক চাপ, হতাশা এবং অসহায়তা অপরাধ প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। মানসিকস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রায় ৬৩ শতাংশ দারিদ্র্য নাগরিকই মানসিকভাবে অস্থিরতা ও রাগ দমন করতে পারেন না। এই অবদমন ও চাপ থেকেই জন্ম নেয় তাৎক্ষণিক সহিংসতা যেমন- ঝগড়া, মারধর বা ছিনতাই। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, ব্লু-কলার অপরাধীরা প্রায়শই সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন এবং আত্মসম্মান হারানো মানুষ। শহুরে অঞ্চলে অবৈধ ও অপরিকল্পিত বস্তি এবং নিম্নমানের আবাসন ব্যবস্থা ব্লু-কলার অপরাধের প্রধানকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এই ঘনবসতিপূর্ণ, স্বাস্থ্যহীন এলাকাগুলোতে সামাজিক নজরদারি দুর্বল থাকে এবং সহজেই অপরাধীরা আশ্রয় নেয় ও সংগঠিত হয়। আবাসন সংকট দারিদ্র্যকে আরও তীব্র করে তোলে এবং অপরাধ প্রবণতা বাড়ায়। বাংলাদেশ পুলিশ ব্লু-কলার অপরাধ দমনে প্রতিনিয়ত কাজ করছে, কিন্তু মানবসম্পদ সংকট, প্রযুক্তিগত ঘাটতি ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৫ সালে পুলিশের প্রতি ১ হাজার নাগরিকের চধমব ৩ ড়ভ ৪ অনুপাত মাত্র ১.৩ জন, যা জাতিসংঘের সুপারিশকৃত মানের অর্ধেক। অপরাধের পর দ্রুত তদন্ত না হওয়া এবংসাক্ষীর ভয় সব মিলিয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। বাংলাদেশে ব্লু-কলার অপরাধের বিস্তারে মাদকাসক্তি একটি প্রধান চালিকাশক্তি। বিশেষ করে ইয়াবা, গাঁজা বা ফেন্সিডিলের মতো সস্তা মাদকগুলো সেবনের অর্থ জোগাড় করতে নিম্নআয়ের মানুষজন ছিনতাই, চুরি বা ডাকাতির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। মাদকাসক্তি কেবল অপরাধ বাড়ায় না, এটি পরিবারের মধ্যে সহিংসতা ও বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে।
মো. নূর হামজা পিয়াস
কলামিস্ট ও সমাজকল্যাণ বিশ্লেষক এবং শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
