সম্পর্কের ভাঙন : ভালোবাসা নাকি সহনশীলতার অভাব
আরিফুল ইসলাম রাফি
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সময় বদলেছে, সঙ্গে জীবনও। কিন্তু ‘ভালোবাসা’ শব্দটির মোহ এখনও ততটাই গভীর, যতটা ছিল প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। তবুও, আজকের দিনে ভালোবাসা যেন আর স্থায়ী হয় না। একসময় সম্পর্ক মানে ছিল জীবনের দীর্ঘ পথচলা, সুখ-দুঃখের মিশেল। এখন সম্পর্ক যেন ছোট মেয়াদের চুক্তির মতো, চোখের ভাষা বদলালেই, স্বর একটু কেঁপে উঠলেই, মন খারাপের কারণটা না বুঝেই সম্পর্কের ইতি টেনে দিই আমরা। প্রশ্নটা তাই এখন তীব্র হয়ে ওঠে, ভালোবাসা কি সত্যিই হারিয়ে যাচ্ছে, নাকি আমরা সহনশীলতা নামের গুণটা ভুলে গেছি? আজকের ভালোবাসা যেন ইনস্ট্যান্ট কফির মতো, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়, আবার তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে যায়। এক ক্লিকে পরিচয়, কয়েকদিনের কথোপকথনে ঘনিষ্ঠতা, তারপর একটুখানি ভুল বোঝাবুঝিতে বিচ্ছেদ। সম্পর্কের সূচনা যতটা সহজ হয়ে গেছে, তার স্থায়িত্ব ততটাই অনিশ্চিত। সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের সংযোগের পরিসর বাড়িয়েছে বটে, কিন্তু সেই সংযোগের গভীরতা কমিয়েছে অনেকখানি। মানুষ এখন ছবি দেখে ভালোবাসে, স্টোরি দেখে সিদ্ধান্ত নেয়, ইমোজির ভাষায় অনুভূতি প্রকাশ করে। কিন্তু মনের ভাষা, চোখের ভাষা; সেগুলো যেন ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে।
ভালোবাসা এখন অনেকটাই ‘প্রেজেন্টেশন’। আমরা ভালোবাসার ছবি তুলি, ভালোবাসার পোস্ট দিই, কিন্তু ভালোবাসার পরিশ্রমটা করি না। অথচ সম্পর্কের সৌন্দর্য প্রকাশে নয়, পরিশ্রমে। কারণ ভালোবাসা কোনো ঘটনা নয়, একটি প্রক্রিয়া। প্রতিদিনের যত্ন, মনোযোগ আর মমতায় সেটি বেড়ে ওঠে। কিন্তু আমরা যেন এখন ভালোবাসার দ্রুত ফল চাই, যেমনভাবে চাই দ্রুত সাফল্য, দ্রুত প্রশংসা, দ্রুত সুখ। কেবল সম্পর্ক নয়, সহনশীলতা হারানোর এই প্রবণতা সমাজের প্রতিটি স্তরেই ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনীতি থেকে পারিবারিক আলাপ পর্যন্ত, সবাই এখন একটু বেশি উত্তেজিত, একটু বেশি অধৈর্য। মতভেদ হলেই আমরা পাল্টা তর্কে নামি, ব্যাখ্যা নয় বিচার চাই। সম্পর্কেও তাই দেখা যায়; ভুল হলে ক্ষমা নয়, প্রতিশোধ; ত্রুটি হলে বোঝা নয়, দূরত্ব।
সহনশীলতা মানে দুর্বলতা নয়, বরং সেটাই সম্পর্কের শক্তি। একে অন্যের অপূর্ণতাকে মেনে নেওয়ার নামই ভালোবাসা।
কিন্তু আজ আমরা পরিপূর্ণ মানুষ খুঁজি, পরিপূর্ণ সম্পর্ক চাই, পরিপূর্ণ আচরণ আশা করি। বাস্তবে এমন কেউ নেই, এমন কোনো সম্পর্কও নেই। ফলে অতি প্রত্যাশা থেকে জন্ম নেয় হতাশা, আর হতাশা থেকেই ভাঙন। সম্পর্ক টিকে থাকার মূল উপাদান হলো যোগাযোগ; শুধু কথা বলা নয়, একে অন্যকে শোনা। কিন্তু আজকাল আমরা শুনি না, শুধু উত্তর দিই। সম্পর্ক তখন কথোপকথনের জায়গা থেকে সরে গিয়ে হয়ে যায় বিতর্কের মঞ্চ। ‘তুমি বুঝলে না’ এই অভিযোগ থেকে শুরু হয়ে শেষ হয় ‘তুমি থাকো তোমার মতো’ বাক্যে। অনেকেই বলেন, ‘আমি এখন নিজের শান্তি চাই, তাই একা থাকাটা ভালো।’ ব্যক্তিস্বাধীনতা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু স্বাধীনতা মানে সম্পর্কহীনতা নয়। বরং সম্পর্কের ভেতরেও স্বাধীন থাকা যায়, যদি বোঝাপড়া থাকে, পারস্পরিক সম্মান থাকে।
আজকের প্রজন্মের অনেকেই ‘টক্সিক রিলেশনশিপ’ থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা বলেন, যেটি সত্যিই দরকারি। কিন্তু সব সম্পর্কই কি টক্সিক? নাকি আমরা নিজের অস্থিরতার দায়ও অন্যের ওপর চাপিয়ে দিই? একটু ধৈর্য, একটু সময়, একটু শ্রবণ- এই তিনটিই হয়তো অনেক সম্পর্ককে বাঁচাতে পারত, যদি আমরা চেষ্টা করতাম। আমরা ভুলে যাচ্ছি, ভালোবাসা শুধু সুখ নয়; ভালোবাসা মানে কঠিন সময়েও পাশে থাকা।
সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার মানে সব সময় মিষ্টি মুহূর্ত নয়, বরং তিক্ততার মধ্যেও বিশ্বাস না হারানো। আমাদের সমাজ এখন দ্রুত পাল্টাচ্ছে, সময়ের গতি বেড়েছে, কিন্তু হৃদয়ের ভাষা সেই আগের মতোই ধীর। তাড়াহুড়ো করে তাই এই ভাষা বোঝা যায় না, এটি বোঝার জন্য লাগে সময়, ধৈর্য আর নীরবতা।
চলচ্চিত্র, নাটক, সোশ্যাল মিডিয়া- সব জায়গায় এখন সম্পর্কের ভাঙন যেন এক ধরনের ‘ট্রেন্ড’। গানেও এখন ভালোবাসার চেয়ে বিচ্ছেদের সুরই বেশি। ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সম্পর্কের প্রতি একধরনের হালকা মনোভাব তৈরি হচ্ছে। সম্পর্ক ভাঙলে কষ্ট না পেয়ে অনেকে বলেন, ‘লাইফ ইজ গোয়িং অন।’ কিন্তু জীবনের অর্থ কি শুধুই এগিয়ে যাওয়া, না কি মাঝে মাঝে থেমে ভাবা, আমরা কোথায় ভুল করছি? সংস্কৃতির এই পরিবর্তন আমাদের অবচেতনে এমন এক বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে; ভাঙন স্বাভাবিক, স্থায়িত্ব ব্যতিক্রম। অথচ সম্পর্কের স্থায়িত্বই মানুষকে শেখায় সহানুভূতি, ধৈর্য, ক্ষমা আর মমতা। এ মূল্যবোধগুলো হারিয়ে গেলে শুধু ভালোবাসা নয়, মানবিকতাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য বড় কিছু নয়, দরকার ছোট ছোট অভ্যাস। কারও মন খারাপ থাকলে পাশে বসা, কারও রাগ বুঝে কিছুক্ষণ চুপ থাকা, ভুল হলেও দুঃখিত বলতে পারা। এই ছোট জিনিসগুলোই সম্পর্কের বড় ভিত্তি তৈরি করে। ভালোবাসা মানে নিজের অস্তিত্ব হারানো নয়; বরং দুজনের ভিন্ন সত্তাকে একসঙ্গে বাঁচিয়ে রাখা। সম্পর্কের ভেতর ‘আমি’ আর ‘তুমি’-র পার্থক্য টিকে থাকলেও ‘আমরা’-র জায়গা যেন হারিয়ে না যায়, এটাই মূল শিক্ষা।
ভালোবাসা আসলে কোনো প্রতিশ্রুতির চেয়ে বেশি এক ধরনের দায়িত্ববোধ। একে অন্যের অনুভূতির যত্ন নেওয়া, নিজের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করা এবং সবচেয়ে বড় কথা মানুষকে মানুষ হিসেবে গ্রহণ করা। ভালোবাসা কখনও হারায় না; হারায় আমাদের ধৈর্য। ভাঙন আসে, কারণ আমরা সম্পর্ককে ‘প্রজেক্ট’ ভাবি, ‘প্রসেস’ নয়। সম্পর্ক কোনো অর্জন নয়, এটি চর্চা; প্রতিদিনের, অবিরত। হয়তো সব সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়, কিন্তু চেষ্টা করা সম্ভব। একে অপরের ত্রুটি মেনে নেওয়ার মধ্যে যেমন আছে মানবতা, তেমনি আছে শান্তি। যদি আমরা একটু সহনশীল হতে শিখি, একটু ধৈর্য রাখি, হয়তো তখন ভালোবাসা এত দ্রুত শেষ হবে না। কারণ, সম্পর্ক ভাঙার শব্দ যতটা উচ্চস্বরে শোনা যায়, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা ততটাই নিঃশব্দ। অথচ এই নীরবতাতেই লুকিয়ে থাকে সত্যিকারের ভালোবাসার সুর, যেটি আজও পৃথিবীর সব সম্পর্কের সবচেয়ে সুন্দর সঙ্গীত।
আরিফুল ইসলাম রাফি
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
