হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামের উৎসব

আরশী আক্তার সানী

প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলার গ্রাম মানেই ছিল উৎসবের মাটি। মাটির ঘ্রাণ, খড়ের গন্ধ, বাঁশের বাঁশি আর ঢোলের আওয়াজে ভরপুর সেই জীবনে উৎসব মানে ছিল মিলন, ভালোবাসা আর ঐতিহ্যের প্রতীক। চৈত্রসংক্রান্তির হালখাতা, পিঠা উৎসব, নবান্ন, বাউল মেলা, নববর্ষ কিংবা ঈদ-পূজার আনন্দ সব মিলেই ছিল গ্রামের মানুষের প্রাণের ছোঁয়া। প্রতিটি উৎসবের সঙ্গে যুক্ত ছিল পারস্পরিক সম্পর্ক, হাসি, পরিশ্রম, গান, নাচ, আর একাত্মতার অনুভূতি। কিন্তু আজ যখন আমরা গ্রামের পথে হাঁটি, তখন দেখি সেই উৎসবের রঙ যেন ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে সময়, বদলে যাচ্ছে মানুষ, আর হারিয়ে যাচ্ছে সেই প্রাণোচ্ছল গ্রামীণ ঐতিহ্য।

একসময় গ্রামের উৎসব মানে ছিল পুরো সমাজের অংশগ্রহণ। খেতের ধান ঘরে তোলার পর সন্ধ্যায় হতো পালাগান, জারি-সারি, কিংবা নাটকের আয়োজন। উৎসব শুধু আনন্দ নয়, ছিল পারস্পরিক সহযোগিতার প্রতীক। কৃষকরা একে অন্যের কাজে সাহায্য করত, মেয়েরা একসঙ্গে বসে পিঠা বানাত, ছেলেরা মাঠ সাজাত, আর বয়স্করা বসত গাছতলায় গল্পে। উৎসব ছিল একদিনের নয় শুরু হতো প্রস্তুতির দিন থেকে, চলত সপ্তাহজুড়ে। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি, শহরমুখী জীবনযাপন আর সামাজিক পরিবর্তনের ফলে গ্রামের মানুষও হয়ে পড়ছে একরকম যান্ত্রিক। যান্ত্রিক জীবনে এখন আর উৎসবের সেই আন্তরিক প্রস্তুতি নেই। অনেক জায়গায় উৎসবের আয়োজন থাকে ঠিকই, কিন্তু তা যেন শুধু আনুষ্ঠানিক। আগে যে উৎসবের মূল ছিল আনন্দ আর মিলন, এখন সেখানে জায়গা নিয়েছে শব্দবাজি, ডিজে গান, আর ছবি তোলার ব্যস্ততা।

আগে পিঠা উৎসব মানে ছিল মায়ের হাতে বানানো নানা রকম পিঠা পাটিসাপটা, দুধপুলি, ভাপা পিঠা, চিতই, চন্দ্রপুলি— সব ঘরে ঘরে গরম ভাপে ভেসে বেড়াত সুগন্ধ। এখন সেই পিঠা উৎসবেও এসে গেছে শহরের ছোঁয়া প্লাস্টিকের টেবিলে বসানো ফাস্টফুড, সাজানো সেলফি কর্নার, আর লাউডস্পিকারে চলা গান। ঐতিহ্যের জায়গা দখল করছে কৃত্রিমতা। গ্রামের বয়স্ক মানুষদের চোখে এই পরিবর্তন স্পষ্ট কষ্টের। তারা বলেন, ‘আগে উৎসব মানে ছিল মন থেকে আনন্দ পাওয়া, এখন উৎসব মানে দেখানো।’ তারা হয়তো আর আগের মতো অংশ নিতে পারেন না, কারণ এখন উৎসবের আঙিনা যেন হয়ে গেছে তরুণদের ‘ফ্যাশন জোন’। ঐতিহ্যের যে সরলতা ছিল, তা হারিয়ে যাচ্ছে এক ধরনের আধুনিকতার ভেতরে।

এর পেছনে শুধু প্রযুক্তি নয়, বড় ভূমিকা রেখেছে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। আমরা এখন ব্যস্ত নিজের জীবন নিয়ে সময় নেই সমাজ বা প্রতিবেশীর সঙ্গে সময় কাটানোর। আগে উৎসব ছিল একে অন্যের পাশে থাকার উপলক্ষ, এখন সবাই নিজের দুনিয়ায় বন্দি। যেদিন ঈদ বা পূজায় সবাই মাঠে মিলিত হতো, সেদিন এখন অনেকেই মোবাইলে ভিডিও দেখে সময় কাটায়। তবুও আশার আলো পুরোপুরি নিভে যায়নি। এখনও কিছু মানুষ, বিশেষ করে গ্রামের শিক্ষক, সাংস্কৃতিক সংগঠন বা কিছু তরুণ দল চেষ্টা করছে ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে। কেউ আয়োজন করছেন পিঠা উৎসব, কেউ গ্রামের মাঠে ফুটবল বা লাঠিখেলা প্রতিযোগিতা করছে, কেউ আবার শিশুদের শেখাচ্ছে পুরোনো লোকসংগীত। তাদের এই চেষ্টাই গ্রামের আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখছে।

আমাদের সমাজে উৎসব শুধু বিনোদনের বিষয় নয়, এটি আমাদের ইতিহাসের ধারক। এই উৎসবগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাঙালির সহাবস্থান, সহমর্মিতা আর সাংস্কৃতিক পরিচয়। গ্রামীণ উৎসবের মাধ্যমে শিশুরা শিখত ঐক্য, বয়স্করা পেত সম্মান, নারীরা পেত প্রকাশের সুযোগ। এখন যখন এই উৎসবগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, তখন আসলে সমাজও হারাচ্ছে তার মানবিকতা। অর্থনৈতিক পরিবর্তনও এই হারিয়ে যাওয়ার পেছনে একটি কারণ। আগে গ্রামের অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর; উৎসব মানে ছিল ফলনের আনন্দ ভাগাভাগি করা। এখন অনেক গ্রামেই কৃষিকাজ কমেছে, অনেকে কাজের খোঁজে শহরে চলে গেছে। ফলে একসময় যে উৎসব সবাই মিলে করত, এখন তা হয়ে গেছে ছোট পরিসরে, কিংবা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। আরেকটি বিষয় হলো মিডিয়ার প্রভাব। শহুরে উৎসবের ঝলক টেলিভিশন বা সামাজিক মাধ্যমে দেখে গ্রামের মানুষও সেই ধাঁচে উৎসব করতে চায়। ফলে নিজস্ব ঐতিহ্যের জায়গায় চলে আসে নকল আধুনিকতা। স্থানীয় বাদ্যযন্ত্রের জায়গা নেয় ডিজে, আর গরু-মোষের হাটের মেলায় বাজে বিদেশি গান। ফলে উৎসবের আত্মা হারিয়ে গিয়ে শুধু অবয়বটাই থেকে যায়।

তবে সব দোষ প্রযুক্তির নয়। আমরা যদি চাই, তাহলে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে ঐতিহ্যকে নতুনভাবে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। যেমন গ্রামের উৎসবগুলোকে ভিডিও করে সংরক্ষণ করা, স্থানীয় হস্তশিল্প বা পিঠার রেসিপি অনলাইনে প্রচার করা, বা বাউল-জারি-সারি সংগীতকে তরুণ প্রজন্মের কাছে নতুনভাবে তুলে ধরা। গ্রামের উৎসব কেবল বিনোদনের জায়গা নয়; এটি আমাদের ইতিহাসের প্রতিধ্বনি, আমাদের শিকড়ের প্রতীক। একসময় গ্রামের মানুষ উৎসবের মাধ্যমে শিখত একতা, সহমর্মিতা, আর পরিশ্রমের আনন্দ। এখন যদি আমরা এই উৎসব হারিয়ে ফেলি, তাহলে হারাবো আমাদের সমাজের মানবিক দিকটি।

সময়ের সঙ্গে চলা দরকার, কিন্তু তার মানে ঐতিহ্যকে ভুলে যাওয়া নয়। আধুনিকতার আলোয় দাঁড়িয়ে আমরা যদি একটু ফিরে তাকাই, তাহলে বুঝব গ্রামীণ উৎসবগুলোই আসলে আমাদের সংস্কৃতির হৃদস্পন্দন। এই উৎসবগুলোকে নতুনভাবে সাজানো, স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণ করা এবং তরুণদের সম্পৃক্ত করা এখন সময়ের দাবি। হয়তো আমরা আর আগের মতো গ্রামীণ চৈত্রসংক্রান্তি বা নবান্ন দেখতে পাব না, কিন্তু যদি আমরা সচেতন হই, তাহলে উৎসবের আত্মা আবার ফিরে আসতে পারে নতুন রূপে। কারণ ঐতিহ্য কখনও মরে না, মানুষ যদি তাকে মনে রাখে। বাংলার গ্রামের উৎসব তাই এখন শুধুই অতীতের গল্প নয়; এটি আমাদের ভবিষ্যতের পরিচয়ের লড়াইও বটে। আমরা যদি সেই ঐতিহ্যকে ভুলে যাই, তাহলে একদিন হয়তো ‘গ্রাম’ শব্দটাই থাকবে, কিন্তু থাকবে না গ্রামের মন, গ্রামের প্রাণ, গ্রামের উৎসব।

আরশী আক্তার সানী

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ