ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর

আসাদুল করিম

প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আমাদের চেতনায় ৭ নভেম্বর ভাস্বর। কারণ ৭ নভেম্বরের চেতনা আর আমাদের দেশজ ও আদর্শিক চেতনা অভিন্ন। এই চেতনার জন্ম একদিনে হয়নি। এ চেতনা কখনও দানা বেঁধেছে দেশকে কেন্দ্র করে। আমরা জানি, মানুষ মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কিন্তু তাই বলে মানুষ মাটিকে আঁকড়ে থাকে না- মাটিতে পা রেখে সে মাথা তুলে দাঁড়ায়- মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। সেই মানুষই আগুয়ান যার অভিযান আসমানে, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) বলে গেছেন, যে প্রাণীর মেরুদণ্ড মাটির যত কাছাকাছি, যত বেশি সমান্তরালে, তার বোধ-বুদ্ধিচেতনা তত বেশি নিম্নমানের। পক্ষান্তরে যে প্রাণী তার মেরুদণ্ডকে যত বেশি সোজা করতে ও যত বেশি খাড়া করতে পেরেছে তার চেতনা মেধা মগজ প্রজ্ঞা ওপ্রতিভা ততবেশি মহীয়ান ও গরীয়ান হয়েছে।

দেশজ চেতনা সুতরং মানুষের জন্য মাটির সমান্তরাল হওয়া কিংবা মাটিতে নুইয়ে পড়া নয়। পক্ষান্তরে আদর্শিক চেতনা অর্থও নয় মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া কিংবা উন্মার্গগামী হয়ে ইউটোপীয়ার আসমানে বিচরণ করা। ৭ নভেম্বরের চেতনা কিংবা আমাদের চেতনায় ৭ নভেম্বর বলতে আমি যা বুঝি, তা এর আগে জাতিসত্তার পরিচিত নামক এক প্রবন্ধে বিশদ আলোচনা করেছিলাম। তাতে যা বলেছিলাম, আজ সে কথাই বলতে চাই। যেমন- বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাত্র কিছুদিন পরের কথা। কলকাতার খ্যাতিমান লেখক অন্নদা শঙ্কর রায় বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং এখানকার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের আলোচনা সভা ও সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন। কলকাতায় ফিরে গিয়ে তিনি সেখানকার দেশ পত্রিকায় বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতার ওপরে একটি সুখপাঠ্য প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রবন্ধের একস্থানে অন্নদা শঙ্কর রায় যা বলেছিলেন তার মূল বক্তব্যটা ছিল এ রকম : পাকিস্তানিরা মনে করেছিল বাংলাদেশের লোকজন শুধুই বাঙালি সুতরাং তাদের যেভাবেই হোক মুসলমানিত্ব শেখাতে হবে। পাকিস্তানি বানাতে হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর আমরা, মানে ভারতীয়রা (এবং বাংলাদেশ যারা আমাদের অনুসারী ও অনুকারী মহল) মনে করতে শুধু করেছি যে, বাংলাদেশের জনগণ শুধু মুসলমান সুতরাং যে করেই হোক তাদের বাঙালি বানাতে হবে ।

অন্নদা শঙ্কর রায় তাঁর ওইপ্রবন্ধে জোর দিয়ে বলেছিলেন, পাকিস্তানিরা যেমন জোর করে মুসলমানিত্ব শেখাতে গিয়ে ভুল করেছিল, তেমনি বাংলাদেশের মানুষকে জোর করে বাঙালি বানাতে যারা কোমর বেঁধেছেন তারাও ভুল করছেন ।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার গোড়াতেই অন্নদা শঙ্কর রায়ের তীক্ষè পর্যবেক্ষণে যে ভুলটি ধরা পড়েছিল আজ এতদিন এতকাল পরেও আমরা সে ভুলটা ধরতে পারছি না- ভুল করেই যেন সেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করে চলেছি। আমাদের একদল এখনও মনে করেন বাংলাদেশের মানুষ শুধুই বাঙালি, সুতরাং যে করেই হোক তাদের মুসলমান বানাতে হবে। নইলে এদেশে মুসলমানিত্ব বা ইসলাম থাকবে না। আরেকদল মনে করছেন, বাংলাদেশের মানুষ স্রেফ মুসলমান, সুতরাং যে কোনো মূল্যে তাদের বাঙালি বানাতে হবে, নইলে বাঙালি হিসেবে আমাদের জাতিসত্তা বিলুপ্ত হবে। এই দ্বিবিধ মানসিকতা হতেই আমরা দেখতে পাচ্ছি এদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গন ও প্রাঙ্গণে দু’টি ভিন্নমুখী ধারা, দু’টি পৃথক ধারার মনুষ্য সৃষ্ট আলোড়ন। এই আলোড়ন যে কোনো আন্দোলন নয়, তা আলোড়ন সৃষ্টিকারীরা যেমন, তেমনি বাইরের অনেকেও বুঝতে পারছেন না। সেই সঙ্গে আরও একটি ব্যাপার তারা বুঝতে পারেন না কিংবা ইচ্ছা করেই বুঝতে চান না যে, যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে এই আলোড়ন বা আন্দোলন তাদের সত্তার গভীরে দেশজ চেতনা যেমন জীবন্ত, তেমনি আদর্শিক চেতনাও চির জাগরূক। একটা থেকে আরেকটা বিচ্ছিন্ন করে দেখার উপায় নেই।

দেশজ চেতনা ও আদর্শিক চেতনা : দেশজ চেতনা তথা দেশগত, ভাষাগত, কৃষ্টিগত পরিচয়বোধ এবং আদর্শিক চেতনা তথা ধর্মগত, দর্শনগত ও ঐতিহ্যগত স্বাতন্ত্রিক উপলব্ধি কি একই সঙ্গে কোনো মানুষের মধ্যে এবং ব্যাপকার্থে কোনো জাতির মধ্যে দানা বাঁধতে পারে? পণ্ডিত হ্যান্স কোহেন তাঁর জাতি ও জাতীয়তাবোধ সংক্রান্ত একাধিক গবেষণা পুস্তকে নানা প্রমাণ উদাহরণ উল্লেখ করে বলেছেন, পারে। শুধু তাই নয়, তাঁর অভিমত আধুনিক যুগের জাতীয়তাবাদ মূলত এই ধরনের আপাতবিরোধী অথচ পরস্পর অচ্ছেদ্য চেতনারই বহিঃপ্রকাশ। তবে এই বিষয়ে পণ্ডিতদের গবেষণার দ্বারস্থ না হয়েও এদেশেরই দুএকটা জানা অজানা ঘটনা তুলে ধরলে ব্যাপারটা আরো বেশি পরিষ্কার হবে বলে মনে করি।

প্রথম ঘটনাটা সবার জানা। মরহুম আবুল মনসুর আহমদ গেছেন স্যার পিসি রায়ের সঙ্গে দেখা করতে। কথা উঠল শেরে বাংলা ফজলুল হককে নিয়ে। কথায় কথায় আবুল মনসুর আহমদ শেরে বাংলার ভূমিকার কিছু কিছু অসঙ্গতির কথা তুলে ধরলেন। বলতে চাইলেন, শেরে বাংলাকে কখনো দেখা যায় কট্টর মুসলমান হিসেবে আবার কখনো দেখা যায় কট্টর বাঙালি হিসেবে।

পিসি রায় তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আবুল মনসুর তোমার মূল্যায়ন সঠিক নয় । ফজলুল হক পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত বাঙালি; আবার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত মুসলমান। বাংলার জাতিসত্তার এমন প্রতীক আর কোথাও খুঁজে পাবে না । তাঁকে তোমরা ভুল বুঝো না। তাঁকে খাটো করে দেখার চেষ্টা করো না। ঘটনাটা মরহুম আবুল মনসুর আহমদ একাধিক প্রবন্ধে, পুস্তকে বিশদভাবে বর্ণনা করে গেছেন। আমি এখানে তাঁর মুখে যেভাবে শুনেছিলাম, সেভাবেই তুলে ধরলাম।

দ্বিতীয় ঘটনাটা অনেকের অজানা। দৈনিক ইত্তেফাকের জেনারেল সেকশনে খোন্দকার আবদুর রব নামে এক ভদ্রলোকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন পরহেজগার মানুষ। জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি প্রায়ই অতীত দিনের স্মৃতিচারণ করতেন। কথা প্রসঙ্গে একবার কাগমারী কনফারেন্স নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ইয়া বড় এক নেতা (নামটা উহ্য থাক) ইত্তেফাক অফিসে এসে এডিটর সাহেবের (তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া) সঙ্গে বেশ রাগারাগি করলেন। এডিটর সাহেবও কম যান না। হাত গোটাগুটির অবস্থা। শেষ পর্যন্ত এডিটর সাহেব তাঁর ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। বললেন, কাগমারী কনফারেন্স নিয়ে রাজনৈতিক মঞ্চের মুসাফির কলামে যা লিখেছি, সেটাই এদেশের সাধারণ মানুষের মনের কথা। এদেশের মানুষকে আমি কিছুটা হলেও বুঝি। স্বাধীনতার পেছনে একটা দর্শন থাকে (রাজনৈতিক নেতাকে লক্ষ্য করে) চিরকাল তো মাঠি বাহি করে গেলে- এসব তুমি বুঝবে না। দেখ মিয়া, যাই করো একটা কথা মনে রেখ, এদেশের মানুষ ঈমান নিয়ে বাঁচতে চায় ও ঈমান নিয়ে মরতে চায়। এর বিরুদ্ধে যেও না। গেলে মারা পড়বে। শেরে বাংলার মত নেতাও এই ভুল করেছিলেন। পরে সে ভুল শুধরেও নিয়েছেন। সে কারণেই তিনি হক সাহেব হিসেবে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। তোমরাও ভুল শোধরাও । এমন কিছু করো না যাতে ঈমান নিয়ে টানাটানি পড়ে।...

পরেই ওই নেতা রব সাহেবের কাছে একান্তে জানতে চেয়েছিলেন, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া কি কারো কাছ থেকে কোনো ইনাম নিয়ে কাগমারী কনফারেন্স সম্পর্কে ওই লেখাগুলো লিখেছিলেন। রব সাহেব ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘দেখেন মিয়া, এডিটর সাহেবকে আমি আপনার চেয়ে অনেক বেশি চিনি। আপনি ইনাম খেয়ে বেড়ান বলে সবাইকে নিজের মত ইনামখোর ভাবেন, তাই না? ব্যাপারটা ইনামের নয়, ঈমানের। আমাদের এডিটর সাহেব বলেন, ‘পাকিস্তান যদি না থাকে তাহলেও এদেশের মানুষ ঈমান নিয়েই বেঁচে থাকবে। ইনামের লোভে এদেশের মানুষ কখনও ঈমান নষ্ট করবে না- সে ইনাম পিণ্ডির হোক বা দিল্লির হোক’।

তৃতীয় ঘটনা অনেকের অজানা নয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্যারিটির (ফিফটি-ফিফটি) বিরুদ্ধে তখন পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ ক্ষুব্ধ। প্যারিটিনীতি প্রবর্তন করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী পশ্চিম পাকিস্তানিদের একতরফা পূর্ব পাকিস্তানের শোষণের পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। এটাই তাদের ক্ষুব্ধতার কারণ। এই সময় জানা গেল মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ প্যারিটির বিরুদ্ধে। পশ্চিম পাকিস্তানি কিছু নেতা খুশি হয়ে

মওলানা সাহেবকে করাচি নিয়ে গেলেন। বক্তৃতা দিতে গিয়ে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ বললেন, হ্যাঁ আমি শহীদ সাহেবের প্যারিটি মানি না। কেন মানব? আমরা পূর্ব পাকিস্তানিরা মেজোরিটি । আমি চাই, মেজোরিটির হিস্যা-সংখ্যাগরিষ্ঠের হক- ন্যায্য পাওনা। সেখানে ফিফটি-ফিফটি কেন?

মরহুম মওলানার মুখে যেভাবে শুনেছিলাম আমি সেভাবেই এখানে বর্ণনা করলাম। প্রকাশ, সে-বারে মওলানা সাহেবকে নিজের পকেটের টাকা খরচ করেই ঢাকায় ফিরতে হয়েছিল। পাকিস্তানি নেতারা তাঁর সঙ্গে আর দেখা পর্যন্ত করেননি। এই প্রসঙ্গে ইতিহাসের বহু ঘটনাই অনেকের মনে পড়তে পারে। মনে পড়তে পারে পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও ভারতে থেকে যাওয়ার কথা- তার অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা। সেই সোহরাওয়ার্দীই আবার পাকিস্তানে এসে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, এদেশের গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনায় প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন, সে কথাও এই প্রসঙ্গে অনেকের মনে না পড়ে পারবে না। অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যাপারে মরহুম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সংগ্রামী ভূমিকার কথাও বাদ দেয়ার উপায় নেই।

জাতিসত্তার পরিচয় : এদেশের মানুষ মাত্রই একই সঙ্গে দেশজ চেতনার ধারক এবং আদর্শিক ভাবধারার বাহক। উপরে যেসব নেতার কথা উল্লেখ করলাম, তাঁরা প্রয়োজনে এভাবেই এদেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা, চিন্তা-চেতনার প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন। এ বিষয়ে জনসাধারণের যেমন কোনো ভুল হয়নি, তেমনি নেতৃবর্গ কেনো ভুল করেননি বরং ভুল করে গেছেন এবং করে চলেছেন মুষ্টিমেয় শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী বলে কথিত মহলের কিছুসংখ্যক লোক। কেউ জেনেশুনেই আবার কেউ বা না জেনেই- না বুঝেই। সেই একই ধারায় ইনামের লোভে আরও কেউ কেউ ঈমান নষ্ট করার- ঈমান নষ্ট করে দেওয়ার ফিকিরে যে নেই তাও বলা চলে না। এদের অনেকের কাছে ব্যাপারটা নিছক রাজনীতি। এরা ভুলে যান, রাজনীতি হচ্ছে একটা জাতির চালিকাচক্র-অগ্রগতির পদশক্তি। কিন্তু সে জাতির প্রাণসত্তা ও মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে তার ইতিহাস এবং ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।

জাতিসত্তার এই পরিচয় সম্পর্কেই একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও একশ্রেণির রাজনীতিক বারে বারেই ভুল করছেন এবং সেই ভুলটাই চাপিয়ে দিতে চাইছেন গোটা জাতির ঘাড়ে। সেই ভুলটা আর কিছুই নয়- কখনও তাঁরা কেউ এই জাতিটাকে শুধুই মুসলমান বানাতে চাইছেন। আবার কখনও বানাতে চাইছেন শুধু বাঙালি। এই ভুল শোধরাবার সময় এসেছে।

একই ধারায় আমাদের জাতিসত্তার পরিচয় সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রয়াসও কোনো কোনো মহলের তরফ থেকে লক্ষণীয়ভাবে প্রকট। যেমন অনেকে অনেক সময় হয় কোনো মতলবে, নয় স্রেফ কৌতূহল বশেই প্রশ্ন তোলেন, আমরা বাঙালি না মুসলমান?

সার্বভৌম সত্তাসহ অখণ্ড রাখতে চাই, তেমনি হাল আমলে নেশন স্টেটের সমস্ত বৈশিষ্ট্য নিয়েই প্রতিষ্ঠিত এই বাংলাদেশের সকল মানুষের সামগ্রিক জাতিসত্তাকে অবশ্যই একটি একক ও অবিভাজ্য পরিচয়ে চিহ্নিত ও পরিচিত করতে চাই। এখানে ভাষাগত, ধর্মগত ও সংস্কৃতিগত পরিচয়ের সকল বৈচিত্র্যের মধ্যেও দেশগত অভিন্ন পরিচয়ের ঐক্য সবার ওপরে মাথা উঁচু করে থাকবে। কোনো মতলববাজ মহলের খুচরা কোনো চালাকির অবকাশ এখানে হবে না- বরং জাতিসত্তার মূল স্রোতের ধারাপ্রবাহের খুচরা চালাকিজাত (উপরে বর্ণিত) সকল অবাস্তব প্রশ্ন ভেসে যাবে। এখানেই জাতিসত্তার পরিচিতি হিসেবে ‘বাংলাদেশি’ শব্দটা অনিবার্যভাবে এসে পড়ে। বাংলাদেশি জাতীয়তার গোড়ার কথা এটাই এবং এটাই বাংলাদেশের কালচারের মূল বুনিয়াদ।

উপসংহার : একই সঙ্গে বাবা-মায়ের সন্তান হয়েও কোনো ব্যক্তির নাম পরিচয় যেমন তার মা- বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নতার পরিচায়ক না হয়ে বরং অচ্ছেদ্য সম্পর্কের পরিচায়ক হয়; তেমনি আমাদের এই দেশগত পরিচয়টাও একই সঙ্গে আমাদের ভাষাগত, ধর্মগত, সংস্কৃতিগত সব পরিচয়েই অভিন্ন স্মারক হবে- হতে বাধ্য। আমাদের জাতিসত্তার এই দেশগত পরিচিতি-ন্যাশনাল আইডেন্টিটি যতদিন পর্যন্ত সঠিকভাবে মেনে নেওয়া না হবে, ততদিন পর্যন্ত ‘সাংস্কৃতিক আগ্রাসন’ বলতে একেক মহল এই দেশবাসীকে একেকভাবে বিভ্রান্ত করতে চাইবে। ইতিহাস সাক্ষী, সেই পাঠান আমলেই এদেশে একজন স্বাধীন সুলতান হাজী ইলিয়াস শাহ ‘বাঙালি’ এই উপাধি গ্রহণ করে ‘বাঙালি’ এই টার্মটিকে অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত করে গেছেন। এই ইতিহাস উল্টানোর অধিকার কারও নেই।

আসলে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ যে তার উত্তরাধিকার সূত্রেপ্রাপ্ত সীমানায় চিহ্নিত ও পরিচিত হয়ে রয়েছে- এটাই অনেকের মর্মপীড়ার কারণ। সে কারণে এই সীমানা চৌহদ্দি ঘেরা জাতিসত্তার অখণ্ড বাংলাদেশি পরিচয় ভুলবার বা ঘুচাবার প্রয়াস-প্রচেষ্টা ঘরে-বাইরে সমভাবে বিদ্যমান। ভারতীয় প্রচারণায় মুগ্ধ হয়ে সেদিন সিংহল তার দেশজ নাম পরিচয় বাদ দিয়ে ভারতীয় পৌরাণিক শ্রীলংকা নাম গ্রহণ করল এবং ইংরেজিকে সরকারি ভাষা থেকে খারিজ করে দিল সেদিনই তাদের তথাকথিত তামিল সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সেই যে পণ্ডিতেরা বলে গেছেন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ভৌগোলিক আগ্রাসনের পূর্বশর্ত, শ্রীলংকা তার সর্বাধুনিক প্রমাণ। ৭ নভেম্বরের চেতনা যতদিন এই জাতির মর্মমূলে জীবন্ত হয়ে থাকবে, ততদিন কেউ বাংলাদেশকে সিকিম বা শ্রীলংকা বানাতে পারবে না।

আসাদুল করিম

সহপ্রচার সম্পাদক, বিএনপি