ঢাকা শহর এখন অপরাধের আঁতুড়ঘর
মো. নূর হামজা পিয়াস
প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা আজ কেবল রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কেন্দ্র নয়, এটি ক্রমেই পরিণত হচ্ছে অপরাধের অন্যতম ঘাঁটিতে। দেশের অন্য জেলাগুলোর তুলনায় এখানকার অপরাধের ঘনত্ব অনেক বেশি। দুই কোটিরও বেশি মানুষের এই অতি জনবহুল নগরে প্রতিদিন গড়ে শত শত ছোট-বড় অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। খুন, চুরি, ডাকাতি, প্রতারণা, মাদক ব্যবসা, মানবপাচার থেকে শুরু করে সাইবার অপরাধ পর্যন্ত সব কিছুই ঢাকার প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক ২০২৫ সালের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মহানগর পুলিশ এলাকায় মাসিক গড়ে প্রায় ২,৪০০টি অপরাধের মামলা রেকর্ড করা হচ্ছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৮ শতাংশ বেশি।
দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সত্ত্বেও অপরাধ কমার পরিবর্তে বেড়েছে। প্রত্যাশা ছিল আধুনিকায়ন মানুষের জীবনে নিরাপত্তা আনবে, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লেও এর অপব্যবহার অপরাধকে করেছে আরও চতুর ও ভয়ংকর। কিশোর গ্যাং কালচার, মাদক ব্যবসা, সাইবার প্রতারণা, ধর্ষণ ও খুনের মতো অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে উদ্বেগজনক হারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক বৈষম্য ও বেকারত্বের সঙ্গে প্রযুক্তির অপব্যবহার মিলে এক ভয়ংকর সংস্কৃতি তৈরি করেছে, যেখানে অর্থই হয়ে উঠছে অপরাধের প্রেরণা।
ঢাকা শহরের অপরাধ বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ হলো অনিয়ন্ত্রিত অভ্যন্তরীণ অভিবাসন। কর্মসংস্থান বা উন্নত জীবনের সন্ধানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ গ্রামে ছেড়ে ঢাকায় আসছে। এই নতুন অভিবাসীরা দ্রুত একটি সামাজিক বন্ধন বা সংহতি তৈরি করতে পারে না, ফলে তারা বিচ্ছিন্নতা এবং অনিশ্চয়তার শিকার হয়। সমাজবিজ্ঞানীরা এই অবস্থাকে ডিসঅর্গানাইজেশন থিওরির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন, যেখানে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়ে। বস্তি এবং নিম্ন আয়ের কলোনিগুলোতে এই সংহতির অভাবের সুযোগ নিয়ে অপরাধীরা সহজেই নতুন পদ্ধতি খুঁজে নেয়।
ঢাকা শহরে ধনী-গরিবের ফারাক স্পষ্ট। একদিকে বহুতল ভবন ও বিলাসবহুল জীবনযাপন, অন্যদিকে বস্তির দরিদ্র জীবনের কষ্ট এই বৈষম্য থেকেই জন্ম নিচ্ছে হতাশা ও ক্ষোভ। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, এই মানসিক চাপই মানুষকে অপরাধের পথে ঠেলে দেয়। ২০২৫ সালের অপরাধ বিশ্লেষণ রিপোর্ট অনুযায়ী, ঢাকার মোট অপরাধের প্রায় ৪২ শতাংশই অর্থনৈতিক হতাশা থেকে সৃষ্ট। চুরি, ছিনতাই ও প্রতারণার বেশিরভাগ ঘটনাই বেকার যুবকদের হাতেই ঘটছে। ঢাকার বস্তিসমূহ অতিরিক্ত দারিদ্র্য, মাদকের সহজলভ্যতা এবং শিক্ষার অভাবের কারণে অপরাধের আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে। এসব এলাকায় পুলিশের টহল কম থাকায় এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের যোগসাজশে মাদক ব্যবসা, জুয়া এবং চাঁদাবাজির মতো অপরাধ সক্রিয় থাকে। বস্তিতে বেড়ে ওঠা কিশোররা সহজেই কিশোর গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ে।
অপরাধ বৃদ্ধির অন্য বড় কারণ হলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সীমিত সক্ষমতা ও রাজনৈতিক প্রভাব। ঢাকায় প্রতিদিন যত অপরাধ ঘটে, তার মধ্যে মাত্র ৩৫ শতাংশ মামলায় কার্যকর তদন্ত হয়। অনেক সময় ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের প্রভাবে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। তদুপরি, পুলিশের সংখ্যা ও সরঞ্জামের ঘাটতি, ট্রাফিক ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা, এবং মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রিতা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
শহর পরিকল্পনা অনুসারে ঢাকার অবকাঠামো সর্বোচ্চ ৮০ লাখ মানুষের জন্য উপযোগী ছিল, অথচ এখন এখানে বাস করছে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। এই অতিরিক্ত জনসংখ্যা অপরাধীদের জন্য হয়ে উঠেছে সুযোগের ক্ষেত্র। জনসমাগম বেশি হওয়ায় নজরদারি কঠিন, আর অপরাধীরা ঠিক এই সুযোগটাই কাজে লাগায়। বাস, রিকশা, ফুটপাত, বাজার সব জায়গায় চুরি, পকেটমারি, ও প্রতারণা এখন নিয়মিত ঘটনা।
ঢাকা শহরের গণপরিবহন ব্যবস্থা কেবল যানজট সৃষ্টি করে না, এটি দৈনন্দিন অপরাধেরও একটি হটস্পট। বাস, ট্রেন এবং রিকশায় পকেটমারি, ছিনতাই এবং মহিলাদের প্রতি যৌন হয়রানি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বাসের মধ্যে অতিরিক্ত ভিড় অপরাধীদের জন্য সুযোগ তৈরি করে। তদুপরি, গণপরিবহনে নজরদারি ক্যামেরা বা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব থাকায় অপরাধীরা সহজেই পার পেয়ে যায়। বিশেষ করে সন্ধ্যার পরে, কিছু নির্দিষ্ট রুটে অস্ত্র প্রদর্শন ও ভয় দেখিয়ে ডাকাতিও ঘটে।
ঢাকার গুলিস্তান, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, গাবতলী, মগবাজার, মিরপুর, মোহাম্মদপুর এসব এলাকা আজ অপরাধ প্রবণতার দিক থেকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত। পুলিশ সদর দপ্তরের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকার মোট অপরাধের প্রায় ৪৬ শতাংশই এই সাতটি অঞ্চলে সংঘটিত হয়। ঘনবসতি, ব্যবসা-কেন্দ্রিক পরিবেশ এবং অপ্রতুল পুলিশ টহল এই এলাকাগুলোকে অপরাধীদের জন্য ‘সহজ টার্গেট’ বানিয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকায় কিশোর অপরাধ ভয়াবহভাবে বেড়েছে। এক সময় স্কুল বা কলেজপড়ুয়া যারা খেলাধুলায় যুক্ত থাকত, তারাই আজ গ্যাং সংস্কৃতির অংশ হচ্ছে। ২০২৫ সালের পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে ঢাকায় সংঘটিত অপরাধের ১৭ শতাংশের সঙ্গে ১৫ থেকে ২২ বছর বয়সি কিশোর-যুবকরা জড়িত। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, পারিবারিক অবহেলা, নেশা, বেকারত্ব ও সামাজিক স্বীকৃতির অভাব কিশোরদের অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ঢাকার অপরাধের সঙ্গে মাদকের সম্পর্ক সরাসরি। ইয়াবা, আইস, গাঁজা ও বিদেশি মদ আজ সহজলভ্য। মাদক পাচারকারীরা এখন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুধু ঢাকাতেই প্রায় ৪৫ লাখ ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করা হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি। এই মাদক ব্যবসা থেকে উৎপন্ন টাকার একটি বড় অংশ অস্ত্র কেনায় ব্যবহার হয়, ফলে অপরাধচক্র আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
প্রযুক্তির প্রসারে যোগাযোগ যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি অপরাধীদের হাতেও বেড়েছে নতুন অস্ত্র। প্রতারণা, হ্যাকিং, অনলাইন জালিয়াতি, হানি ট্র্যাপ, মোবাইল ব্যাংকিং জালিয়াতি এখন প্রতিদিনের ঘটনা। সাইবার পুলিশ সেন্টারের তথ্যমতে, ২০২৫ সালে ঢাকায় প্রতি মাসে গড়ে ২,০০০-এর বেশি সাইবার অপরাধের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অনলাইন প্রতারণার শিকারদের মধ্যে ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীদের সংখ্যাই বেশি।
ঢাকায় পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা ও মানসিক চাপও অপরাধের অন্যতম উৎস। যৌথ পরিবার ভেঙে পড়েছে, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বেড়েছে। অনেক তরুণ-তরুণী মানসিক অবসাদে ভুগছে, যারা সহজেই অপরাধচক্রের হাতে পড়ে যায়। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, শহুরে জীবনযাত্রার চাপ, প্রতিযোগিতা, এবং পারিবারিক সহানুভূতির অভাব মানুষকে ধীরে ধীরে সহিংসতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে অপরাধ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং সমাজের প্রতিচ্ছবি। এমিল দুর্খেইমের মত অনুযায়ী, অপরাধ সমাজের অঙ্গ। ঢাকার মতো শহরে যেখানে সামাজিক বন্ধন দুর্বল, সেখানে অপরাধ বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। সমাজের কাঠামোগত বৈষম্য, সাংস্কৃতিক ভাঙন এবং নিয়ন্ত্রণের অভাব মানুষকে ‘অ্যানোমি’ অবস্থায় ঠেলে দেয়, যেখানে নৈতিকতার সীমা ভেঙে যায়। অপরাধ দমন কেবল পুলিশের দায়িত্ব নয়, বরং এটি নাগরিক অংশগ্রহণেরও বিষয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ঢাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশের প্রতি আস্থার ঘাটতি রয়েছে। অনেকেই মনে করেন অভিযোগ করলেও কোনো ফল হয় না। ২০২৫ সালের জরিপ অনুযায়ী, ঢাকাবাসীর ৬৪ শতাংশই মনে করেন যে পুলিশের কার্যক্রমে রাজনৈতিক প্রভাব আছে। তাই অপরাধ দমন করতে হলে পুলিশের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনাই প্রধান চ্যালেঞ্জ।
ঢাকার অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে অপরাধীদের দায়মুক্তি দেওয়া।
স্থানীয় পর্যায়ের কিছু রাজনৈতিক নেতা কিশোর গ্যাং বা মাদক ব্যবসায়ীদের ছত্রছায়া দিয়ে থাকেন। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধীদের ধরতে চাইলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই দায়মুক্তির সংস্কৃতি প্রমাণ করে যে, অপরাধ করলে শাস্তি নাও হতে পারে। যতক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত অপরাধীরা ভয় পাবে না এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হবে।
মো. নূর হামজা পিয়াস
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
