গণপিটুনি বর্তমান প্রজন্মের একটি মারাত্মক ব্যাধি
হেনা শিকদার
প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
যখন একদল মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে সন্দেহ, গুজব বা নিছক আক্রোশের বশবর্তী হয়ে অন্য কোনো মানুষকে প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে হত্যা করে, তখন আমরা তাকে ‘গণপিটুনি’ বলি। কিন্তু এই শব্দটি কি যথেষ্ট? এটি নিছক একটি ঘটনা নয়; এটি আমাদের সমাজের গভীরে বাসা বাঁধা এক মারাত্মক ব্যাধিস্বরূপ। সাম্প্রতিক সময়ে এই ব্যাধির যে রূপ আমরা দেখছি, তা নির্দ্বিধায় ‘বর্তমান প্রজন্মের’ অন্যতম ভয়াবহ সামাজিক অবক্ষয় হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। এটি এমন এক উন্মাদনা, যা আমাদের সভ্যতা, বিবেক ও মানবিকতার ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করছে।
কেন এটি ‘বর্তমান প্রজন্মের’ ব্যাধি : গণপিটুনির ইতিহাস নতুন নয়, কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর এই ডিজিটাল যুগে এসে এটি এক নতুন ও ভয়ঙ্কর মাত্রা পেয়েছে। এর কারণগুলো বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় কেন এটি বর্তমান সময়কে এতো তীব্রভাবে সংজ্ঞায়িত করছে-
প্রযুক্তির অপব্যবহার ও গুজবের মহামারি : বর্তমান প্রজন্ম বাস করছে তথ্যের এক মহাসমুদ্রে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষত ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইউটিউব, এখানে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। এই প্ল্যাটফর্মগুলো যেমন তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করেছে, তেমনি গুজবের ভাইরালিটিতেও সাহায্য করেছে।
‘ছেলেধরা’ গুজব, ‘পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে’ বা ধর্মীয় অবমাননার মতো স্পর্শকাতর ও বানোয়াট তথ্যগুলো আগুনের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রজন্মের একটি বড় অংশ তথ্য যাচাই করার ন্যূনতম প্রয়োজন বোধ করে না।
তারা ‘শেয়ার’ বাটনকে তাদের ‘দায়িত্ব’ মনে করে। ফলে, কোনো নিরপরাধ মানুষ মুহূর্তের মধ্যে ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত হয়ে যায় এবং ক্ষিপ্ত জনতা ‘বিচার’ করতে ছুটে আসে। প্রযুক্তির এই ভয়াবহ অপব্যবহারই গণপিটুনির মূল অনুঘটক।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও আস্থার সংকট : এই ব্যাধির আরেকটি বড় কারণ হলো প্রাতিষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের গভীর অনাস্থা। যখন মানুষ দেখে অপরাধী আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাচ্ছে, বিচার পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে, কিংবা প্রভাবশালীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে, তখন তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা ও ক্ষোভ জমাট বাঁধে।
এই পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকে তারা এক ধরনের ‘তাৎক্ষণিক বিচার’ (Instant Justice) পেতে চায়। তারা মনে করে, আইন-আদালত যা পারবে না, জনতা তা করে দেখাবে। এই ‘হিরোইজম’ বা বীরত্ব প্রদর্শনের মানসিকতা আদতে আইনের শাসনের প্রতি চরম অবজ্ঞা। এই অনাস্থা বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে এতোটাই প্রকট যে, তারা পুলিশ বা প্রশাসনকে খবর দেওয়ার চেয়ে নিজেরা ‘শাস্তি’ দেওয়াকে বেশি কার্যকর মনে করে।
সংবেদনহীনতা ও দৃশ্যধারণের সংস্কৃতি : গণপিটুনির ঘটনাগুলোর ভিডিওচিত্র লক্ষ্য করলে একটি ভয়াবহ বিষয় স্পষ্ট হয়- আক্রমণকারীদের পাশাপাশি একদল দর্শক দাঁড়িয়ে থাকে, যারা এই বর্বরতা থামাতে এগিয়ে আসে না, বরং উল্টো তাদের মোবাইল ফোনে সেটি ধারণ করে। আর্তচিৎকার, বাঁচার আকুতি তাদের সংবেদনশীলতাকে নাড়া দেয় না।
এই দৃশ্যধারণের সংস্কৃতি (Culture of Spectacle) এক ধরনের বিকৃত বিনোদন। সামাজিক মাধ্যমে ‘লাইক’, ‘শেয়ার’ বা ‘ভাইরাল’ হওয়ার নেশা তাদের মানুষ থেকে দর্শক এবং দর্শক থেকে পরোক্ষ অংশগ্রহণকারীতে পরিণত করেছে। তাসলিমা বেগম রেণুর মতো একজন নিরীহ মা যখন তার সন্তানের ভর্তির খোঁজ নিতে গিয়ে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা হন এবং সেই দৃশ্য মানুষ ভিডিও করে, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে আমাদের নৈতিকতার পচন কত গভীরে পৌঁছেছে।
সমষ্টিগত উন্মাদনা ও দায়িত্বের বিলুপ্তি : মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, ভিড়ের মধ্যে মানুষ তার ব্যক্তিগত পরিচয় ও স্বাভাবিক বিবেকবোধ হারিয়ে ফেলে (Deindividuation)। যখন ১০০ জন মানুষ একজনকে আঘাত করে, তখন কেউ এককভাবে হত্যার দায় অনুভব করে না; দায়টি ১০০ ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
বর্তমান প্রজন্মের অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা এবং দ্রুত আবেগী হয়ে পড়ার প্রবণতা এই সমষ্টিগত উন্মাদনাকে আরও সহজ করে তুলেছে। তারা যুক্তির চেয়ে আবেগ দ্বারা বেশি চালিত হয়। এই ভিড়ের কোনো মুখ নেই, কোনো বিবেক নেই; আছে শুধু ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি।
ভয়াবহ পরিণতি-
একটি অসুস্থ সমাজ : গণপিটুনির এই ব্যাধি শুধু কিছু মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে না, এটি পুরো সমাজকে পঙ্গু করে দিচ্ছে।
আইনের শাসনের পতন : প্রতিটি গণপিটুনির ঘটনা রাষ্ট্রকে, তার বিচার বিভাগকে এবং তার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। এটি সমাজকে একটি অকার্যকর ‘মগের মুল্লুক’-এ পরিণত করে।
ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা : যখন যে কেউ, যে কোনো সময়, যে কোনো গুজবের শিকার হয়ে মারা যেতে পারে, তখন সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। এটি একটি স্থায়ী সামাজিক ট্রমা তৈরি করে।
সভ্যতার সংকট : গণপিটুনি প্রমাণ করে, আমরা শিক্ষিত হলেও মানবিক হয়ে উঠতে পারিনি। এটি আমাদের আদিম ও বর্বর প্রবৃত্তির নগ্ন আস্ফালন।
উত্তরণের পথ কোথায় : এই মারাত্মক ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে হলে বহুমুখী ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য-
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি : গণপিটুনির প্রতিটি ঘটনায় জড়িতদের দ্রুততম সময়ে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যখন জনতা দেখবে যে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার পরিণাম ভয়াবহ, তখন তারা ভয় পাবে।
গুজব প্রতিরোধ সেল : সাইবার ক্রাইম ইউনিটকে আরও শক্তিশালী হতে হবে। যে কোনো গুজবের উৎস দ্রুত চিহ্নিত করে এবং তা ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে ২৪/৭ মনিটরিং প্রয়োজন।
ডিজিটাল লিটারেসি : স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে ‘ডিজিটাল লিটারেসি’ বা প্রযুক্তিগত সাক্ষরতা বাধ্যতামূলক করতে হবে। কিছু ‘শেয়ার’ করার আগে তা যাচাই করার শিক্ষা দিতে হবে।
প্রাতিষ্ঠানিক আস্থা ফেরানো : বিচার বিভাগ ও পুলিশের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। মানুষ যেন বিপদে পড়লে ৯৯৯-এ কল করতে ভরসা পায়, আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়।
মানবিক ও নৈতিক শিক্ষা : পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহিষ্ণুতা, সহানুভূতি এবং মানবিকতার শিক্ষা জোরদার করতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে, সন্দেহ যত গভীরই হোক, একজন মানুষের গায়ে হাত তোলার অধিকার অন্য কোনো মানুষের নেই।
গণপিটুনি কোনো বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়; এটি আমাদের সমষ্টিগত ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। এই ব্যাধি প্রমাণ করে যে, প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মানবিকতার অগ্রগতি ঘটেনি। যদি আমরা এখনই এই সামাজিক ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু না করি, তবে অচিরেই এটি আমাদের পুরো সমাজব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেবে। সময় এসেছে এই বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর; আইন নিজের হাতে নয়, আইনকে তার নিজের গতিতে চলতে দেওয়ার।
হেনা শিকদার
দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
