গ্লোবাল সিনেমা রাজনৈতিক প্রতিরোধের নতুন ভাষা
হেনা শিকদার
প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সিনেমা হলের আলো নিভে যাওয়ার মুহূর্তটা কেবল বিনোদন বা দৈনন্দিন বাস্তবতা থেকে পলায়নের নয়। যখন রুপালি পর্দায় একটি গল্প ভেসে ওঠে, তখন তা হয়ে উঠতে পারে প্রতিবাদের আয়না, প্রতিরোধের ভাষা। একবিংশ শতাব্দীর এই জটিল ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে, যেখানে ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে নিরন্তর সংঘাত চলছে, সেখানে বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্র নির্মাতারা এক নতুন ধরনের লড়াই শুরু করেছেন। এটি সরাসরি স্লোগানের লড়াই নয়; এটি সূক্ষ্ম, শৈল্পিক এবং গভীরভাবে মানবিক এক প্রতিরোধের ভাষা, যা রাষ্ট্রযন্ত্রের সেন্সরশিপ ও প্রচারণাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দর্শকের মনে প্রশ্ন তৈরি করে।
একটা সময় ছিল, যখন রাজনৈতিক সিনেমা মানেই ছিল প্রত্যক্ষ বক্তব্য, মিছিলের স্লোগান অথবা বিপ্লবের সরাসরি আহ্বান। সের্গেই আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ বা গোদার্দের কাজগুলো ছিল তার উদাহরণ। কিন্তু সমসাময়িক গ্লোবাল সিনেমা সেই ধারা থেকে সরে এসে এক নতুন পথ তৈরি করেছে। আজকের স্বৈরাচারী বা নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থাগুলো অনেক বেশি চতুর; তারা সরাসরি সমালোচনাকে কঠোরভাবে দমন করে। তাই নির্মাতারাও বেছে নিয়েছেন রূপকের ভাষা।
এর সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ দক্ষিণ কোরিয়ার বং জুন-হো নির্মিত ‘প্যারাসাইট’। আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি ডার্ক কমেডি বা থ্রিলার। কিন্তু গভীরে গেলে এটি শ্রেণিবৈষম্যের এক ক্ষুরধার সমালোচনা। দুটি পরিবারের মাধ্যমে পরিচালক যেভাবে পুঁজিবাদের শোষণ এবং ধনী-দরিদ্রের অদৃশ্য দেয়ালকে তুলে ধরেছেন, তা যে কোনো রাজনৈতিক ভাষণের চেয়ে শক্তিশালী। সিনেমাটি কোনো সমাধান দেয় না, কিন্তু এটি সিস্টেমের ভেতরের পচনকে এমনভাবে উন্মোচিত করে যে দর্শক হিসেবে আমরা অস্বস্তিতে পড়তে বাধ্য হই। এটাই নতুন প্রতিরোধের ভাষা সিস্টেমকে সরাসরি আক্রমণ না করে, তার ভেতরের অন্তঃসারশূন্যতা দেখিয়ে দেওয়া। ‘The personal is political’ (ব্যক্তিগতই রাজনৈতিক)-এই মন্ত্রটি আজকের গ্লোবাল সিনেমার অন্যতম চালিকাশক্তি। যখন একটি রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বৃহৎ কোনো বয়ানের অংশ হতে বাধ্য করে, তখন একজন ব্যক্তির নিজস্ব সত্য, তার ছোট ছোট দুঃখ-কষ্টের গল্প বলাই হয়ে ওঠে এক একটি রাজনৈতিক কাজ।
ইরানের আসগর ফারহাদি বা জাফর পানাহির সিনেমাগুলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ফারহাদি তার ‘আ সেপারেশন’ বা ‘দ্য সেলসম্যান’-এ সাধারণ পারিবারিক সংঘাতের গল্প বলেন। কিন্তু সেই গল্পের প্রতিটি ভাঁজে লুকিয়ে থাকে ইরানের সামাজিক, ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলের অদৃশ্য চাপ। পানাহি, যিনি নিজ দেশেই চলচ্চিত্র নির্মাণে নিষিদ্ধ, তিনি কখনও ট্যাক্সির ভেতরে (ট্যাক্সি তেহরান), কখনও নিজের ঘরে বসেই (দিস ইজ নট আ ফিল্ম) সিনেমা বানান। তার এই নির্মাণ প্রক্রিয়াটিই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এক নীরব অথচ শক্তিশালী প্রতিরোধ। একইভাবে, মেক্সিকোর আলফনসো কুয়ারোনের ‘রোমা’ একটি পরিবারের গৃহপরিচালিকার সাদামাটা জীবনের গল্প বলে। কিন্তু এই ব্যক্তিগত গল্পের ক্যানভাসে তিনি মেক্সিকোর রাজনৈতিক অস্থিরতা, আদিবাসীদের বঞ্চনা এবং শ্রেণি-বিভাজনকে দক্ষতার সাথে বুনে দেন। স্বরহীনদের স্বর দেওয়াই যখন নির্মাতার লক্ষ্য হয়ে ওঠে, তখন সেই সিনেমাই হয়ে ওঠে প্রতিরোধের দলিল। রাজনৈতিক প্রতিরোধের এই নতুন ভাষা সবচেয়ে আকর্ষণীয়ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে হরর (ভৌতিক), সায়েন্স ফিকশন বা ডিস্টোপিয়ান জনরার সিনেমাগুলোতে। এই জনরাগুলো নির্মাতাদের একটি নিরাপদ আবরণ দেয়, যার আড়ালে থেকে তারা সমসাময়িক রাজনীতির তীক্ষè সমালোচনা করতে পারেন।
জর্ডান পিলের ‘গেট আউট’ কেবল একটি ভৌতিক সিনেমা নয়; এটি আধুনিক উদারনৈতিক সমাজে বর্ণবাদের যে ভয়াবহ ও অদৃশ্য রূপ বিদ্যমান, তার এক শৈল্পিক উন্মোচন। একইভাবে, স্পেনের ‘দ্য প্ল্যাটফর্ম’ বা মেক্সিকোর ‘নিউ অর্ডার’-এর মতো সিনেমাগুলো ডিস্টোপিয়ান আবহে বর্তমান পৃথিবীর সম্পদ বণ্টনের অসামঞ্জস্য এবং সামাজিক বিদ্রোহের অনিবার্যতাকে তুলে ধরে। দর্শক একটি থ্রিলার বা হরর সিনেমার উত্তেজনা নিয়ে দেখতে বসে, কিন্তু হল থেকে বের হয় সমসাময়িক সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে একরাশ প্রশ্ন নিয়ে। সেন্সরশিপের চোখ এড়িয়ে রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করার এর চেয়ে শৈল্পিক উপায় আর কী হতে পারে? তথ্যচিত্র বা ডকুমেন্টারি ফিল্মগুলো বরাবরই প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক গ্লোবাল সিনেমা এই ধারাকেও নতুন রূপ দিয়েছে। এখনকার তথ্যচিত্রগুলো কেবল ‘টকিং হেড’ বা সাক্ষাৎকারের ওপর নির্ভরশীল নয়; এগুলো অনেক বেশি সিনেমাটিক, ব্যক্তিগত এবং সাহসী। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত ‘ফর সামা’ এর এক জ্বলন্ত উদাহরণ। এই তথ্যচিত্রে নির্মাতা ওয়াদ আল-কাতিব তার ক্যামেরাটিকে ব্যবহার করেছেন যুদ্ধের ভয়াবহতাকে ধারণ করার জন্য নয়, বরং তার সন্তানের জন্য একটি স্মারকলিপি হিসেবে। এই ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণই সিনেমাটিকে অসামান্য রাজনৈতিক উচ্চতা দিয়েছে। ক্যামেরা এখানে কেবল পর্যবেক্ষক নয়, ক্যামেরা নিজেই প্রতিরোধের অংশ।
অন্যদিকে, ‘দ্য অ্যাক্ট অফ কিলিং’ (ইন্দোনেশিয়া) বা ‘কালেক্টিভ’ (রোমানিয়া)-এর মতো অনুসন্ধানী তথ্যচিত্রগুলো রাষ্ট্রীয় অপরাধ এবং দুর্নীতির এমন গভীর স্তরে প্রবেশ করে, যা মূলধারার গণমাধ্যম কল্পনাও করতে পারে না। তারা অপরাধীদের দিয়েই তাদের অপরাধের পুনর্নির্মাণ করায় কিংবা সিস্টেমের পচনকে ধাপে ধাপে উন্মোচন করে। এটিই সিনেমার শক্তি সত্যকে তার নগ্ন রূপে প্রকাশ করা। গ্লোবাল সিনেমার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সাফল্য হয়তো বিপ্লব ঘটানো নয়, বরং সহমর্মিতা (Empathy) তৈরি করা। যখন আমরা লেবাননের ‘ক্যাপারনাম’-এ এক বস্তিবাসী শিশুর সংগ্রাম দেখি, বা ফিলিস্তিনের ‘ওমর’-এ দখলদারিত্বের অধীনে ভালোবাসার সংকট দেখি, তখন আমরা সেই দূর দেশের মানুষগুলোর সঙ্গে একাত্ম বোধ করি।
এই একাত্মতা বা সহমর্মিতাই বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। স্বৈরাচারী শাসকরা সর্বদা ‘আমরা বনাম ওরা’ এই বিভাজন জিইয়ে রাখতে চায়। কিন্তু একটি ভালো সিনেমা সেই দেয়াল ভেঙে দেয়। এটি আমাদের শেখায় যে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে থাকা মানুষটির কষ্ট, আশা বা সংগ্রাম আমার থেকে আলাদা নয়। এই বৈশ্বিক সংহতি তৈরি করাই আজকের সিনেমার নতুন রাজনৈতিক দায়িত্ব। আজকের গ্লোবাল সিনেমা কেবল বিনোদনের চাকচিক্য নয়। এটি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক হাতিয়ার, যা স্লোগানের পরিবর্তে প্রতীক ব্যবহার করে, বিপ্লবের আহ্বানের পরিবর্তে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় এবং ঘৃণা ছড়ানোর পরিবর্তে সহমর্মিতা তৈরি করে। যখন চারপাশের কোলাহল এবং রাষ্ট্রীয় প্রচারণা সত্যকে আড়াল করে রাখে, তখন একটি চলচ্চিত্রই হয়ে উঠতে পারে সেই নীরব বিপ্লব, যা সরাসরি ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ না করেও তার ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়। এটাই রাজনৈতিক প্রতিরোধের নতুন, শৈল্পিক ও শক্তিশালী ভাষা।
হেনা শিকদার
দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
