চাকরির স্বপ্নে শিক্ষিত বেকারদের মানসিক যন্ত্রণা
তহমিনা ইয়াসমিন
প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রাত গভীর হয়ে গেছে। শহরের আলো নিভে আসছে, মানুষ ঘুমাচ্ছে। কিন্তু রাকিবের ঘরে বাতি এখনও জ্বলছে। তার সামনে বিসিএসের বই, হাতে কলম, আর চোখে ক্লান্তি ও হতাশার ছাপ। একসময় যে ছেলেটি ক্লাসের প্রথম সারিতে বসত, পরিবার ও বন্ধুরা তার গর্ব করত, আজ সে বসে আছে নিজেকে প্রশ্ন করতে করতে- ‘আমি এত পড়াশোনা করেছি, এত ভালো ফল করেছি, অথচ কেন কোনো সুযোগ পাচ্ছি না’
মা পাশের ঘরে নামাজ পড়ছেন, বাবা নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। রাকিবের এই নীরব হতাশা শুধু তার নয়; এটি দেশের লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণের মনের ভেতরের যন্ত্রণা, স্বপ্নের চাপ এবং আশা-নিরাশার প্রতিফলন। প্রতিটি পরিবারে, প্রতিটি শহর ও গ্রামে এমন রূপকল্প চোখে পড়ে- যেখানে উচ্চশিক্ষা অর্জন করা যুবকরা জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময় কাটাচ্ছেন অজানার ভয়ে, অসহায়তার মাঝে।
৩০-৪০ বছর আগেও, উচ্চশিক্ষা অর্জন করলে চাকরির বাজারে তুলনায় ভালো অবস্থান মিলত। কিন্তু আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, যারা গ্র্যাজুয়েট বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট, তারা দীর্ঘ সময় চাকরি না পেয়ে, বা উপযুক্ত চাকরি না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের স্বপ্ন, প্রচেষ্টা এবং ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষা যেন ধ্বংসের কিনারায় দাঁড়িয়ে। এই পরিস্থিতি তাদের মধ্যে মানসিক চাপ, হতাশা, উদ্বেগ এবং একাকীত্ব তৈরি করছে। ‘শিক্ষিত বেকার’ হয়ে ওঠা এখন শুধু ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটি একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের প্রতীক।
বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারত্ব আজ এক ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে প্রায় ১০-১২ লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বের হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ কোনো কাজের সুযোগ পাচ্ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৪ সালের তথ্যমতে, দেশে মোট বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ ২৪ হাজার, যার মধ্যে প্রায় ৯ লাখ উচ্চশিক্ষিত। শিক্ষিত বেকারের এই সংখ্যা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষয় নয়, এটি মানসিক ও সামাজিক ক্ষয়েরও সূচনা।
গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ১৩.৫ শতাংশ, যা দেশের অন্যান্য শিক্ষাগত স্তরের তুলনায় অনেক বেশি। প্রতি বছর নতুন করে লাখ লাখ তরুণ চাকরির বাজারে প্রবেশ করে, কিন্তু তাদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। শুধুমাত্র সরকারি খাতে নয়, বেসরকারি খাতেও পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান নেই। তথ্য অনুযায়ী, শিল্প খাত ও সেবা খাতে ২০১৯-২০২৩ সালের মধ্যে গড়ে মাত্র ৫-৬ লাখ নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা শিক্ষিত তরুণদের চাহিদার তুলনায় খুবই কম।
সরকারি চাকরিতে প্রবেশ প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছে ভয়াবহ মাত্রায়। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ৪৫তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রায় ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী অংশ নিয়েছিল, কিন্তু প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হলো মাত্র ১২ হাজার ৭৮৯ জন।
অর্থাৎ প্রতি ৩০ জনে মাত্র একজনের ভাগ্যে সুযোগ আসে। কেউ কয়েক বছর ধরে পরীক্ষা প্রস্তুতি নিচ্ছে, কেউ আবার বারবার ব্যর্থ হয়ে আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছে। এই প্রতিযোগিতা শুধু অর্থনৈতিক চাপই তৈরি করছে না, তরুণদের হৃদয় ও মনকে কষ্ট দিচ্ছে, স্বপ্নের পথে ভয় ও অনিশ্চয়তার ছায়া ফেলছে।
যে তরুণ বা তরুণী বহু বছর পড়াশোনা করেছে, ভালো ফলাফল অর্জন করেছে, অথচ চাকরি পায় না, সে নিজেকে ব্যর্থ মনে করতে শুরু করে। পরিবার ও সমাজের প্রত্যাশা, বন্ধুদের অগ্রগতি, নিজের স্বপ্নের বাস্তবায়নের ব্যর্থতা সব মিলিয়ে তরুণদের মধ্যে হতাশা, উদ্বেগ এবং একাকীত্ব তৈরি হচ্ছে। ধীরে ধীরে তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে, জীবনকে তারা অর্থহীন ও ফাঁকা মনে করছে। অনেকে দিন কাটাচ্ছে ঘরে বসে, কেউ ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে, আবার কেউ একরকম উদাসীনতায় ভুগছে।
শিক্ষিত বেকারত্বের মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। এখনও শিক্ষা অনেকটাই বইভিত্তিক, বাস্তব জীবনের প্রয়োজনীয় দক্ষতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যা শেখানো হয়, চাকরির বাজারে তার চাহিদা সীমিত। উদাহরণস্বরূপ, হিসাব, অর্থনীতি বা মানববিজ্ঞান পড়া শিক্ষার্থীদের অনেকেই চাকরির বাজারে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত দক্ষতা না থাকায় সুযোগ হারাচ্ছেন।
অন্যদিকে, শিল্প, কারখানা, প্রযুক্তি ও বেসরকারি খাতে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। সরকারি খাতেও নিয়োগ প্রক্রিয়া ধীর ও অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। ফলে শিক্ষিত তরুণরা ক্রমেই হতাশা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে।
সমস্যার আরও গভীর দিক হলো, অনেকে কর্মসংস্থান বা উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ চিন্তায় রাখে না। তারা শুধু চাকরির অপেক্ষায় থাকে।
অথচ, যদি তরুণরা কারিগরি দক্ষতা, নিজস্ব উদ্যোগ ও উদ্যোক্তা মনোভাব অর্জন করতে শিখত, তাহলে হয়তো বেকারত্বের সমস্যা অনেকটা কমে যেত। প্রতি বছর প্রায় ২২-২৩ লাখ নতুন তরুণ চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে, কিন্তু কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে গড়ে মাত্র ১৫ লাখের মতো। ফলে ৭-৮ লাখ তরুণ যোগ্য হলেও কর্মহীন থাকছে, আর মনের গভীরে হতাশা জমা হচ্ছে।
এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক ও কর্মমুখী করতে হবে। শুধু তত্ত্ব নয়, বাস্তব দক্ষতা অর্জনের সুযোগ দিতে হবে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রসারিত করতে হবে, যাতে তরুণরা নিজেরাই কাজ সৃষ্টি করতে পারে। সরকার ও বেসরকারি খাতে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে, উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ ঋণ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ও চাকরি কেন্দ্রগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য ও ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং সেবা চালু করতে হবে। পরিবার ও সমাজকেও সচেতন হতে হবে- চাকরি না পাওয়া মানে ব্যর্থতা নয়। সময় ও সুযোগ পেলে প্রতিটি তরুণই সমাজে অবদান রাখতে পারে।
শিক্ষিত বেকারত্ব আজ শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি একটি জাতীয় সংকট। দেশের তরুণরা জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাদের হতাশা মানে দেশের অগ্রগতি থেমে যাওয়ার আশঙ্কা। তাই এখনই প্রয়োজন সচেতনতা, পরিকল্পনা ও বাস্তব পদক্ষেপ। শিক্ষা তখনই অর্থবহ হবে, যখন তা জীবনের সার্থকতায়, আত্মবিশ্বাসে ও কর্মের মাধ্যমে প্রকাশ পাবে।
আমাদের তরুণরা কোনো বোঝা নয়; তারা দেশের আশা, স্বপ্ন ও সম্ভাবনার প্রতীক। যদি তারা হতাশ না হয়, সঠিক সুযোগ পায়, তাহলে আগামী বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ হবে উজ্জ্বল, শক্তিশালী ও সম্ভাবনাময়।
তহমিনা ইয়াসমিন
নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
