বাল্যবিয়ে রোধে কঠোর আইনি ও সামাজিক সংস্কার প্রয়োজন

মো. নূর হামজা পিয়াস

প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের প্রথা এখনও গভীরভাবে শিকড় গেড়ে আছে। আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হলেও গ্রামীণ অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরতলি পর্যন্ত এই প্রথা গোপনে বা প্রকাশ্যে চলছেই। সমাজে একে এখনও ‘সম্মানের বিয়ে’ বা ‘অভিভাবকীয় দায়িত্ব’ হিসেবে দেখা হয়, যা প্রকৃতপক্ষে মানবাধিকার লঙ্ঘনেরই নামান্তর। ২০২৫ সালের ইউনিসেফ রিপোর্টে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় ৪৮ শতাংশ নারী ১৮ বছরের আগেই বিয়ে করেছে। এই হার দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। এ বাস্তবতা আমাদের সমাজব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা ও নৈতিক মানদ-ের উপর প্রশ্ন তোলে।

বাংলাদেশে ২০১৭ সালের ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’ প্রণীত হলেও এর বাস্তব প্রয়োগ এখনও অপ্রতুল। আইনে ১৮ বছরের নিচে মেয়েদের বিয়ে নিষিদ্ধ করা হলেও অনেক সময় ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ ধারা ব্যবহার করে অভিভাবকরা মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দিয়ে ফেলছেন। প্রশাসনের নজরদারির অভাব, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের প্রভাব এবং সামাজিক চাপ এই আইনকে কার্যকর হতে দিচ্ছে না। ২০২৫ সালের স্থানীয় সরকারের তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০২৪ সালে প্রায় ১২,০০০ অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ে নিবন্ধিত হয়েছে, যা দেখায় আইন থাকলেও তা কার্যকর প্রয়োগে বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। বাল্যবিবাহের অন্যতম প্রধান কারণ দারিদ্র্য। দরিদ্র পরিবারগুলো মেয়ের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দ্রুত বিয়ের পথ বেছে নেয়। মেয়েকে ‘অর্থনৈতিক বোঝা’ হিসেবে দেখা এখনও অনেক অঞ্চলে প্রচলিত একটি ধারণা। ২০২৫ সালের দারিদ্র্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৮ শতাংশ পরিবার এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে এবং এদের ৬০ শতাংশই গ্রামীণ এলাকায়। এই প্রেক্ষাপটে মেয়েদেও শিক্ষা বন্ধ করে বিয়ে দেওয়া যেন এক সহজ সামাজিক সমাধান হয়ে দাঁড়িয়েছে যা পরবর্তীতে সমাজের ওপর দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক বোঝা হয়ে ফিরে আসে।

বাল্যবিবাহ শুধু একটি মেয়ের জীবন নয়, তার পুরো ভবিষ্যৎকে গ্রাস করে ফেলে। যারা অল্প বয়সে বিয়ে করে, তারা প্রায়ই মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করতে পারে না। শিক্ষা না থাকলে তারা কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়, যা দারিদ্র্যের আরেকটি চক্র তৈরি করে। ২০২৫ সালের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যে দেখা যায়, বাল্যবিবাহের কারণে মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েদের স্কুল ছাড়ার হার ৩৬ শতাংশে পৌঁছেছে।

অর্থাৎ, তিনজন কিশোরীর মধ্যে একজন স্কুল ছাড়ছে শুধুমাত্র বিয়ের জন্য। অল্প বয়সে গর্ভধারণের কারণে অনেক মেয়েকে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়তে হয়। জাতিসংঘের ২০২৫ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী প্রতি এক হাজার মেয়ে শিশুর মধ্যে ৮৫ জন মা হয়ে যায়। এই গর্ভধারণের কারণে মাতৃমৃত্যুর হারও বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। অল্পবয়সী মেয়েদের দেহ গর্ভধারণের জন্য প্রস্তুত না থাকায় জটিলতা তৈরি হয়, যা শুধু মা নয়, নবজাতকের জীবনকেও বিপন্ন করে তোলে। বাল্যবিবাহের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মেয়েরা যখন অল্প বয়সে বিয়ে করে, তখন তারা কর্মক্ষম শ্রমশক্তিতে যোগ দিতে পারে না। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি বাল্যবিবাহ ২০৩০ সালের মধ্যে বন্ধ করা যায়, তবে বাংলাদেশের জিডিপি প্রায় ১.৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। ২০২৫ সালের এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেয়েদের শিক্ষায় বিনিয়োগ করা প্রতিটি টাকার বিপরীতে ৮ গুণ অর্থনৈতিক লাভ পাওয়া যায়। ফলে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা শুধু সামাজিক নয়, অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতাও।

যখন মেয়েরা অল্প বয়সে সংসারে প্রবেশ করে, তখন তারা নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার হারিয়ে ফেলে। বাল্যবিবাহ নারীর আত্মবিশ্বাস, স্বাধীনতা এবং সামাজিক মর্যাদাকে ধ্বংস করে। সমাজে নারীদের ভূমিকা শুধুমাত্র গৃহস্থালী কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে নারী শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ ২০২৫ সালে ৩৪ শতাংশে নেমে এসেছে, যার অন্যতম কারণ এই বাল্যবিবাহের প্রভাব।

বাল্যবিবাহ নির্মূলের জন্য শুধু মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করলেই হবে না, ছেলেদের এবং পুরুষদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনা জরুরি। পুরুষদের বুঝতে হবে, একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীকে বিয়ে করা শুধু আইনত অপরাধ নয়, এটি ভবিষ্যতের পারিবারিক সংকটেরও মূল কারণ। অল্পবয়সী স্ত্রী ও সন্তানের ভার বহনের কারণে ছেলেদের মধ্যেও আর্থিক চাপ ও মানসিক অস্থিরতা বাড়ে। বাল্যবিবাহের শিকার অনেক মেয়েই শারীরিক ও মানসিক সহিংসতার শিকার হয়। সংসারে অল্প বয়সে প্রবেশ করার কারণে তারা প্রায়ই পরিপক্ব সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।

২০২৫ সালের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জরিপে দেখা গেছে, বাল্যবিবাহে জড়িত ৬২ শতাংশ নারী জীবনের কোনো এক পর্যায়ে গৃহসহিংসতার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই মানসিক বিষণ্ণতায় ভুগছেন, যা সমাজে আরও অস্থিরতা তৈরি করে। বর্তমান আইনে শাস্তির ব্যবস্থা থাকলেও তা প্রয়োগে শিথিলতা রয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসন, পরিবার ও সমাজের সহযোগিতা ছাড়া এ আইন কার্যকর হয় না। সরকারকে এখন এমন নীতি প্রণয়ন করতে হবে, যেন কোনো অবস্থাতেই ১৮ বছরের নিচে বিয়ে বৈধ না হয়। আদালত, উপজেলা প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত উদ্যোগে এই প্রথা রোধ করা সম্ভব। প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের কারণে বর্তমানে অনলাইনে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে এবং তা অল্প বয়সে বিয়েতে গড়াচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ভুল পরিচয়ে বা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে কিশোর-কিশোরীদের প্রলুব্ধ করা হচ্ছে। সাইবার প্রতারণা এবং সোশ্যাল মিডিয়ার চাপও বাল্যবিবাহের ঘটনাকে ত্বরান্বিত করছে। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই ডিজিটাল নিরাপত্তা ও অনলাইন সম্পর্ক বিষয়ে তরুণদের সচেতন করতে হবে।

প্রযুক্তিকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে, এটি যেন নতুন ঝুঁকির কারণ না হয়, সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি। গণমাধ্যমের শক্তি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে হবে। ২০২৫ সালে সেভ দ্য চিলড্রেনের রিপোর্টে দেখা যায়, গণমাধ্যমের প্রচারণা থাকা অঞ্চলে বাল্যবিবাহের হার ২২ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও নদীভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোও বাল্যবিবাহকে ত্বরান্বিত করছে। দুর্যোগের কারণে পরিবারগুলো যখন বাসস্থান ও জীবিকা হারায়, তখন তারা মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসন এবং নিরাপত্তাহীনতা মেয়েদের ঝুঁকি বাড়ায়। বাল্যবিবাহের কারণে দেশের মানবসম্পদের অপচয় হচ্ছে। একজন শিক্ষিত ও স্বাস্থ্যবান নারী শুধু তার পরিবারের নয়, দেশের অর্থনীতিতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। অল্প বয়সে বিয়ে ও মাতৃত্বের কারণে মেয়েদের মধ্যে যে সুপ্ত নেতৃত্বের দক্ষতা, সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা থাকে, তা অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে যায়। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি বাংলাদেশের নারীদের পূর্ণ কর্মদক্ষতাকে ব্যবহার করা যেত, তবে জাতীয় উৎপাদনশীলতা আরও ৫ শতাংশ বাড়ানো যেত। বাল্যবিবাহ বন্ধ করা মানে দেশের ভবিষ্যৎ মানবসম্পদে বিনিয়োগ করা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বাল্যবিবাহের কুফল নিয়ে আলোচনার সুযোগ বাড়ানো জরুরি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্ব ও আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার পাশাপাশি তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। বিদ্যালয় পর্যায়ে নিয়মিত আলোচনা, নাটক, বিতর্ক প্রতিযোগিতা এবং সমাজবিজ্ঞান পাঠ্যসূচিতে বাল্যবিবাহবিরোধী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা গেলে সচেতনতা আরও বাড়বে। বাল্যবিবাহের শিকার পরিবারগুলোর জন্য আইনি সহায়তা প্রক্রিয়া এখনও অনেক জটিল। অনেকেই জানেন না কোথায় এবং কীভাবে অভিযোগ করতে হয়। মামলা দায়ের হলেও বিচার প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতা এবং সামাজিক চাপ বা হুমকি অনেক ভুক্তভোগীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। সরকারকে অবশ্যই প্রত্যেক উপজেলায় বাল্যবিবাহ নিরোধক টাস্কফোর্স গঠন করে আইনি প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুত ও সহজ করতে হবে। দরিদ্র ও প্রান্তিক নারীদের জন্য বিনামূল্যে আইনি সহায়তা এবং সুরক্ষিত আশ্রয় নিশ্চিত করা অপরিহার্য। বাংলাদেশে ধর্মীয় নেতাদের প্রভাব সমাজে ব্যাপক। তাই ইমাম, পুরোহিত, পাদ্রি বা স্থানীয় সমাজপ্রধানদেও বাল্যবিবাহবিরোধী প্রচারণায় যুক্ত করতে হবে। তাদের মাধ্যমে জনগণকে বোঝানো সম্ভব যে অল্প বয়সে বিয়ে শুধু ধর্মবিরুদ্ধ নয়, বরং মানবিক অপরাধও। ধর্মীয় আলোচনায় নারীর সম্মান ও শিক্ষার গুরুত্ব বাড়ালে সমাজে নতুন চিন্তার জন্ম হবে। বাংলাদেশ সরকারকে এই ইস্যুকে জাতীয় উন্নয়ন কৌশলের অংশ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। জাতিসংঘ, ইউএনএফপিএ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এরই মধ্যে বাল্যবিবাহ নির্মূলে সহায়তা দিচ্ছে।

২০২৫ সালে ঘোষিত জাতীয় কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহের হার ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দৃঢ়তা এবং সামাজিক অংশগ্রহণ অপরিহার্য। বাল্যবিবাহ শুধু একটি সামাজিক সমস্যা নয়, এটি একটি জাতীয় সংকট। মেয়ে শিশুরা আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের অন্ধকার জীবনের পরিবর্তে আলোর পথে আনতে হলে শিক্ষা, সচেতনতা এবং আইনের কঠোর প্রয়োগের বিকল্প নেই। প্রতিটি পরিবারের, প্রতিটি সমাজের দায়িত্ব হলো মেয়েদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করা। যতদিন না বাল্যবিবাহ পুরোপুরি নির্মূল হচ্ছে, ততদিন বাংলাদেশ তার প্রকৃত উন্নয়ন অর্জন করতে পারবে না।

বাল্যবিবাহ বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এক গুরুতর বাধা। ৪৮ শতাংশের মতো উচ্চ বাল্যবিবাহের হার একদিকে যেমন মাতৃমৃত্যু ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে নারী শিক্ষা ও কর্মদক্ষতা নষ্ট করে দেশের মানবসম্পদের অপচয় করছে।

এই প্রথা বন্ধ করতে শুধু আইনের কঠোর প্রয়োগ নয়, প্রয়োজন দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং সামাজিক মানসিকতায় পরিবর্তন আনা। বাল্যবিবাহ নির্মূল করা শুধু মেয়েদের অধিকার রক্ষা নয়, এটি জাতীয় জিডিপি বৃদ্ধি এবং সুস্থ প্রজন্ম তৈরির জন্য অপরিহার্য।

মো. নূর হামজা পিয়াস

কলামিস্ট ও সমাজকল্যাণ বিশ্লেষক এবং শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ