কারাবন্দিদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা
প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

কারাগার, জেলখানা বা কয়েদখানা এমন এক ‘আলাদা দুনিয়া’, যেইখানে সুবিশাল আকাশও যেন ঠিকঠাকভাবে দেখা যায় না। বলা হইয়া থাকে, যাহারা কখনও জেলে যায় নাই, জেল খাটে নাই, তাহারা কোনোভাবেই উপলব্ধি করিতে পারিবে না যে, কারাগার কী জিনিস! বাইর হইতে শুধু উঁচু উঁচু দেওয়াল চোখে পড়ে, কিন্তু ইহার ভেতরে প্রবেশ করিলে দেখা যায়, জেলের ভেতরে রহিয়াছে আরেক জেলখানা, আর রহিয়াছে অজস্র সমস্যাসংকট। যদিও কারাসংশ্লিষ্টরা দাবি করিয়া থাকেন যে, কারাগার শাস্তির জায়গা নহে, ইহা পুনর্বাসনের জায়গা। কারাফটকগুলোর সম্মুখেও বড় বড় হরফে লেখা থাকে, ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ।’
গত মাসে সিলেট বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজনস) তাহার এক বক্তব্যে বলিয়াছিলেন, ‘কারাগার শুধু শাস্তির জায়গা নহে, এইখানে সংশোধন ও পুনর্বাসনও হয়।’ কারা কর্তৃপক্ষ বন্দিদের মানবিক দৃষ্টিতে দেখেন- দাবি করিয়া তিনি আশান্বিত করিয়াছিলেন এই বলিয়া যে, কারা কর্মকর্তাদের দায়িত্বশীলতা, নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের মাধ্যমেই কারাব্যবস্থাকে আধুনিক ও মানবিক করিয়া গড়িয়া তোলা সম্ভব। প্রশ্ন হইল, আমাদের কারাগারগুলোর অবস্থা কী, সেইখানকার পরিবেশ কতটা মানসম্পন্ন কিংবা সেইখানে বন্দিরা কী অবস্থায় দিন যাপন করেন? তাহারা কি প্রতিশ্রুত ও কাঙ্ক্ষিত সুযোগ-সুবিধা পান বা পাইতেছেন?
গতকাল গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে কারাবন্দিদের স্বাস্থ্যঝুঁকির চিত্রটি আমাদের নজরে আসিয়াছে। এই কারাগারের পানিতে ক্ষতিকর জীবাণু, মলমূত্র ও কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গিয়াছে, যাহা রীতিমতো বিপর্যয়কর। কারা সূত্র জানাইয়াছে, সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রসের একটি টিমের সহায়তায় কারাগারের ১১টি সাবমার্সিবল পাম্পের মধ্যে ১০টি পাম্পের পানির নমুনা পরীক্ষা করা হয় ঢাকার একটি ল্যাবে। ল্যাব রিপোর্টে উঠিয়া আসিয়াছে, পাঁচটি সাবমার্সিবল পাম্পের পানিতে জীবাণুর উপস্থিতি-তিনটির পানিতে মিলিয়াছে ক্ষতিকর ‘কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া’।
জানা যায়, কারাগারটিতে বর্তমানে প্রায় ৬ হাজার বন্দি রহিয়াছেন, যাহারা প্রতিদিন এই পানি ব্যবহারের পাশাপাশি পানও করিয়া থাকেন। অধিকন্তু, এই পানি ব্যবহার হইয়া থাকে বন্দিদের রান্না, গোসল, পয়োনিষ্কাশনসহ সকল ধরনের কাজে। কারা কর্মকর্তাদের ধারণা, কারাগারের পয়োনিষ্কাশন (স্যুয়ারেজ) এবং পানির সংযোগ একাকার হইবার কারণে এই ব্যাকটেরিয়া পানিতে মিশিয়াছে। পরিতাপের বিষয় হইল, ইহা জানিবার পরও পানিসংকটের অজুহাতে কারাবন্দিরা এই পানি পান ও ব্যবহার অব্যাহত রাখিতে বাধ্য হইতেছেন- ইহা কেমন কথা! শুধু চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার নহে, দেশের প্রায় প্রতিটি কারাগারের পরিবেশগত অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ বন্দি লইয়া চলিতেছে দেশের ৬৮টি কারাগার, যেইখানে বর্তমানে প্রায় ৮০ হাজার কারাবন্দি রহিয়াছেন। অথচ এই সকল কারাগারের বেশির ভাগই নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত।
মনে রাখা দরকার, যাহারা কারাবরণ করেন কিংবা দীর্ঘকাল কারাবন্দি থাকেন, স্বাভাবিকভাবেই তাহাদের মানসিক অবস্থা ভালো থাকে না। সেই সঙ্গে অধিক পরিমাণে গাদাগাদি করিয়া থাকিবার ফলে তাহাদের স্বাস্থ্য আরও ভাঙিয়া পড়ে। সর্বোপরি, সমস্যাসংকুল পরিস্থিতিতে তাহারা হইয়া পড়েন ‘ভালনারেবল’। ঠিক এমন একটি পরিস্থিতিতে বন্দিদের থাকাণ্ডখাওয়ার পরিবেশ বিরূপ হইয়া উঠিলে তাহারা যে অবর্ণনীয় ভোগান্তির মধ্যে পড়িয়া যান, সেই কথার বলাইবাহুল্য। অথচ সঠিক পরিচর্যা ও সুযোগ-সুবিধা পাওয়া বন্দিদের আইনগত অধিকার। এমতাবস্থায়, চট্টগ্রাম কারাগারে উদ্ভুত উপর্যুক্ত সমস্যাসহ দেশের অন্যান্য কারাগারগুলোতে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক ভূমিকা পালন করিতে হইবে। কারাগারগুলোতে নানা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার অভিযোগ নতুন নহে। সুতরাং, অন্ততপক্ষে কারাবন্দিদের স্বাস্থ্যগত দিকটির কথা বিবেচনায় রাখিয়া তাহাদের জন্য সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করা হোক।
