তরুণদের রাতের জীবনধারা : স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সমাধান
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আজকের প্রযুক্তিনির্ভর যুগে তরুণদের জীবনধারায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। দিনভর কর্মব্যস্ততা, পড়াশোনার চাপ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব এবং অনলাইন বিনোদনের সহজলভ্যতা- সব মিলিয়ে রাতের নিস্তব্ধতা এখন আর কেবল বিশ্রামের সময় নয়। বরং অনেক তরুণের জন্য রাত মানে স্বাধীনতা, আনন্দ, যোগাযোগ কিংবা ব্যক্তিগত সময় কাটানোর সুযোগ। কিন্তু এই রাতকেন্দ্রিক জীবনধারা অজান্তেই তরুণদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
রাতের প্রলুব্ধতা : সমস্যা কোথায়- রাতের প্রলুব্ধতা হলো সেই মানসিক প্রবণতা, যখন মানুষ বিশ্রাম না নিয়ে রাতকে কাজে, বিনোদনে বা সামাজিক সংযোগে ব্যয় করে। তরুণদের মধ্যে এই প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। এর কয়েকটি মূল কারণ হলো-
সোশ্যাল মিডিয়ার আকর্ষণ : ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক বা ইউটিউবের অনন্ত স্ক্রলিং ঘুমের সময় কেড়ে নিচ্ছে।
গেমিং ও অনলাইন বিনোদন : আধুনিক গেম ও ওয়েব সিরিজ রাতের নিস্তব্ধ সময়কে বিনোদনের সোনালী সময়ে পরিণত করছে।
মনোভাবগত পরিবর্তন : অনেকেই মনে করেন, রাতই মনোযোগী কাজ বা পড়ার সেরা সময়।
একাকীত্ব ও মানসিক চাপ : কেউ কেউ রাতকে নিজের একান্ত সময় হিসেবে দেখে, যা ধীরে ধীরে অনিদ্রার অভ্যাসে পরিণত হয়। গবেষণায় প্রমাণিত, রাতের জাগরণে শরীরের বায়োলজিক্যাল ক্লক বা সার্কাডিয়ান রিদম ব্যাহত হয়। এটি মানসিক স্থিতিশীলতা, হরমোন নিয়ন্ত্রণ, রোগ প্রতিরোধ এবং বিপাকীয় প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
শারীরিক স্বাস্থ্যঝুঁকি : রাতের জীবনধারার প্রভাব শুধু ক্লান্তিতে সীমাবদ্ধ নয়; এটি শরীরের ভেতরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে নেতিবাচক ছাপ ফেলে।
ঘুমের ঘাটতি ও ক্লান্তি : পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কমে যায়।
হৃদরোগের ঝুঁকি : দীর্ঘদিন রাত জেগে থাকা রক্তচাপ ও হার্টবিটের ভারসাম্য নষ্ট করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
ওজন বৃদ্ধি ও মেদ জমা : রাতে জাঙ্ক ফুড খাওয়া, অনিয়মিত খাবার ও শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা স্থূলতার পথ প্রশস্ত করে।
চোখের সমস্যা : অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম চোখের শুষ্কতা, ঝাপসা দেখা, মাথাব্যথা এমনকি দৃষ্টিশক্তি দুর্বলতার কারণ।
হরমোনের ভারসাম্যহীনতা : ঘুমের অভাবে ‘মেলাটোনিন’ হরমোনের নিঃসরণ কমে যায়, যা ক্ষুধা, বৃদ্ধি ও মুড নিয়ন্ত্রণে প্রভাব ফেলে।
প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বলতা : রাত জেগে থাকা ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করে, ফলে সর্দি-কাশি বা ভাইরাল সংক্রমণ বারবার হয়।
পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা : দেরিতে খাওয়া ও ঘুমের অভাবে হজমে সমস্যা, গ্যাস, অ্যাসিডিটি বা গ্যাস্ট্রিকের ঝুঁকি বাড়ে।
ডায়াবেটিস ও মেটাবলিক ব্যাধি : রাতে জেগে থাকা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বাড়ায়, ফলে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
মানসিক ও আচরণগত প্রভাব : রাতের জীবনধারা তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য এক নীরব বিপদ।
ডিপ্রেশন ও উদ্বেগ : ঘুমের অভাব সেরোটোনিনের মাত্রা কমিয়ে মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে।
মনোযোগ ও শিক্ষণক্ষমতা হ্রাস : ক্লান্ত মন নতুন কিছু শেখা বা মনে রাখার ক্ষেত্রে অক্ষম হয়ে পড়ে।
আত্মসম্মান ও সম্পর্কের টানাপোড়েন : রাত জাগার ক্লান্তি কর্মক্ষমতা কমায়, যা আত্মবিশ্বাস ও সামাজিক সম্পর্ক দুর্বল করে।
আবেগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা : ঘুমহীন মস্তিষ্ক আবেগে বেশি প্রতিক্রিয়াশীল, ফলে রাগ, হতাশা বা বিষণ্ণতা বেড়ে যায়।
সামাজিক বিচ্ছিন্নতা : রাতে জেগে একাকী সময় কাটানো ধীরে ধীরে মানুষকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তোলে।
মানসিক স্বাস্থ্যের এই পরিবর্তন তরুণদের পড়াশোনা, ক্যারিয়ার ও পারিবারিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা অনেক সময় ডিপ্রেশন বা বার্নআউট সিন্ড্রোমে পরিণত হতে পারে।
রাত জাগার মূল কারণ : রাত জাগার প্রবণতা একদিনে তৈরি হয় না; এটি একটি অভ্যাস, যা নানা সামাজিক ও প্রযুক্তিগত কারণের সঙ্গে জড়িত।
প্রযুক্তির সহজলভ্যতা : স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাব বা গেম কনসোল সবসময় হাতের নাগালে।
সোশ্যাল মিডিয়ার প্রলোভন : নতুন কনটেন্ট, মেসেজ, নোটিফিকেশন ঘুমের রুটিন ভেঙে দেয়।
গেমিং ও অনলাইন বিনোদন : রাতের নিস্তব্ধতা অনেকের কাছে গেম বা ভিডিও দেখার আদর্শ সময়।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস : রাতে অতিরিক্ত কফি, চিপস, সফট ড্রিংক বা ফাস্টফুড ঘুমে বাধা সৃষ্টি করে।
সামাজিক ও শিক্ষাগত চাপ : পরীক্ষা, প্রজেক্ট বা বন্ধুর সঙ্গে অনলাইন যোগাযোগ অনেককে দেরি করে জাগিয়ে রাখে।
পরিবারিক অনিয়ম : পরিবারের দেরিতে খাওয়া বা টিভি দেখা তরুণদের ঘুমের রুটিনেও প্রভাব ফেলে।
পরিবেশগত কারণ : আলো, শব্দ, ঘরের তাপমাত্রা কিংবা আরামহীন পরিবেশ ঘুমকে ব্যাহত করে।
প্রতিরোধ ও সুস্থ জীবনধারা : রাত জাগার অভ্যাস পরিবর্তন কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। কিছু সহজ জীবনধারা পরিবর্তন তরুণদের সুস্থ ঘুম ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ফিরিয়ে দিতে পারে।
নিয়মিত ঘুমের রুটিন : প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমানো ও জাগা শরীরের ঘড়িকে স্থিতিশীল রাখে।
স্ক্রিন টাইম সীমিত করা : ঘুমানোর আগে অন্তত এক ঘণ্টা মোবাইল, ট্যাব বা ল্যাপটপ থেকে দূরে থাকুন।
সক্রিয় জীবনযাপন : দিনে ব্যায়াম, হাঁটাহাঁটি বা খেলাধুলা ঘুমের মান উন্নত করে।
সুষম খাদ্যাভ্যাস : রাতে হালকা ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন; ভারী বা তৈলাক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
মানসিক প্রশান্তি চর্চা : ধ্যান, প্রার্থনা, শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন বা বই পড়া ঘুমের প্রস্তুতি বাড়ায়।
সোশ্যাল মিডিয়ার সচেতন ব্যবহার : অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ ও নোটিফিকেশন বন্ধ রাখুন।
প্রাকৃতিক আলো গ্রহণ : সকালে সূর্যালোক শরীরের মেলাটোনিন উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে।
পরিবার ও বন্ধুদের সহায়তা : পারস্পরিক সহযোগিতা তরুণদের স্বাস্থ্যকর ঘুমের অভ্যাসে উৎসাহ জোগায়।
সৃজনশীল কার্যকলাপ : গান, চিত্রাঙ্কন, লেখালেখি বা হবি মানসিক চাপ হ্রাস করে।
সময় ব্যবস্থাপনা : কাজ ও পড়াশোনার নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে রাতে বিশ্রামের সময় রাখুন।
পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা : রাতের জীবনধারার নেতিবাচক প্রভাব থেকে তরুণদের রক্ষা করতে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
পরিবারের ভূমিকা : অভিভাবকদের উচিত সন্তানের ঘুমের সময়সূচি ও অনলাইন ব্যবহারে নজর রাখা, রাতের খাবার ও বিশ্রামের পরিবেশ নিয়মিত রাখা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা : স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুমের গুরুত্ব, মানসিক স্বাস্থ্য ও ডিজিটাল ভারসাম্য নিয়ে সচেতনতা কর্মসূচি চালু করা দরকার।
সামাজিক সহযোগিতা : তরুণদের জন্য কমিউনিটি প্রোগ্রাম, পরামর্শ কেন্দ্র ও স্বাস্থ্য শিক্ষার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
নীতি ও জনস্বাস্থ্য দৃষ্টিকোণ : রাতের জীবনধারা এখন একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যা নীরবে সমাজে চাপ সৃষ্টি করছে। ঘুমের ঘাটতি তরুণ প্রজন্মের কর্মক্ষমতা, উৎপাদনশীলতা ও মানসিক স্বাস্থ্য নষ্ট করছে। তাই নীতিনির্ধারকদের উচিত- স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ঘুম সচেতনতা সপ্তাহ’ আয়োজন করা। ডিজিটাল ডিটক্স ক্যাম্পেইন চালু করা এবং তরুণদের ঘুম ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপযুক্ত কাউন্সেলিং ব্যবস্থার উন্নয়ন করা।
পরিশেষে বলতে চাই, নীরব রাতের প্রলুব্ধতা আজকের তরুণ সমাজের এক অদৃশ্য শত্রু। প্রযুক্তি ও আধুনিক জীবনধারা যতই সুবিধা এনে দিক না কেন, পর্যাপ্ত ঘুমের বিকল্প নেই। ঘুম শুধু বিশ্রাম নয়, এটি শরীর ও মনের পুনর্জাগরণ। রাতকে বিনোদনের নয়, নিজেকে পুনর্গঠনের সময় হিসেবে দেখাই তরুণদের জন্য সর্বোত্তম পথ।
সচেতনতা, সুষম খাদ্য, নিয়মিত ঘুম ও মানসিক প্রশান্তিই পারে এই প্রজন্মকে এক ভারসাম্যপূর্ণ, সুস্থ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথে নিয়ে যেতে।
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
গবেষক ও জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
