ঝুঁকিতে বাংলাদেশের পোশাক খাত
এসএম রায়হান মিয়া
প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি যদি কোনো খাতকে বলা যায়, তবে সেটি নিঃসন্দেহে তৈরি পোশাক শিল্প। এই খাতই আমাদের রপ্তানির প্রধান উৎস, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মূল ভিত্তি এবং নারী শ্রমশক্তির অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র। কিন্তু সময়ের প্রবাহে আজ এই খাত এমন এক ক্রান্তিকালে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে বৈশ্বিক রাজনীতি, আন্তর্জাতিক শুল্কনীতি, প্রযুক্তির বিবর্তন এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা মিলে এক অদ্ভুত অনিশ্চিত বাস্তবতা সৃষ্টি করেছে। দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতটি আজ এক গভীর সংকটে, যার উৎস কেবল অর্থনৈতিক নয়- রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং কাঠামোগত ব্যর্থতাও এর পেছনে সমানভাবে দায়ী। একসময় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প বিশ্বে এক অনন্য সফলতার উদাহরণ ছিল। কম মজুরি, প্রাচুর্য শ্রমশক্তি এবং ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে শুল্ক সুবিধা- এই তিনটি উপাদান মিলে বাংলাদেশকে বৈশ্বিক পোশাক সরবরাহ শৃঙ্খলে এক অপরিহার্য অংশে পরিণত করেছিল। কিন্তু গত এক দশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতি ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা আমূল বদলে গেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক-জাতীয়তাবাদ, চীন-আমেরিকা বাণিজ্য যুদ্ধ, কোভিড-পরবর্তী সরবরাহ শৃঙ্খলের পুনর্গঠন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কার্বন ট্যাঙ এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা- সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পোশাক খাতের ওপর নেমে এসেছে এক জটিল চাপের বলয়।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তন বিশ্ব অর্থনীতিতে এক নতুন অস্থিরতার সূচনা করেছে। তার প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি পুনরায় উচ্চহারে শুল্ক আরোপের মাধ্যমে বৈশ্বিক বাণিজ্যকে ঝাঁকুনি দিয়েছে। চীন এই শুল্কনীতির প্রধান লক্ষ্যবস্তু হলেও এর পরোক্ষ অভিঘাত পড়েছে বিশ্বের প্রায় সব দেশের ওপর। ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়া এমনকি মেক্সিকোর মতো দেশগুলো এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের রপ্তানি বৃদ্ধি করেছে। তারা দ্রুত কৌশল পরিবর্তন করে আমেরিকার বাজারে নিজেদের উপস্থিতি জোরদার করেছে। কিস্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন কোনো প্রস্তুতি দেখা যায়নি। সরকার কিংবা রপ্তানিকারক সংগঠন কেউই সেই কূটনৈতিক বাণিজ্যকৌশল প্রয়োগ করতে পারেনি, যা নতুন সুযোগকে বাস্তব সাফল্যে রূপ দিতে পারত। বাংলাদেশের প্রস্তুতির অভাব ছিল বহুমাত্রিক।
প্রথমত, সরকারি পর্যায়ে বাণিজ্য কূটনীতির কোনো সুসংগঠিত কাঠামো নেই। আমাদের দূতাবাসগুলো এখনও পুরনো আমলাতান্ত্রিক কাঠামোয় আবদ্ধ, যেখানে অর্থনৈতিক কূটনীতি কার্যত অনুপস্থিত। দ্বিতীয়ত, ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের পক্ষে লবিং বা থিংকট্যাংক কার্যক্রম পরিচালনার মতো প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা অর্জন করেনি। ফলে, বৈশ্বিক শুল্ক নীতির পরিবর্তনে বাংলাদেশ ছিল একপ্রকার দর্শকের ভূমিকায়। তৃতীয়ত, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভাজন ও প্রশাসনিক অচলাবস্থা ব্যবসায়ী আস্থা নষ্ট করেছে। রপ্তানিকারকেরা জানে না আগামী সপ্তাহে নীতিমালা পরিবর্তন হবে কি না- এই অনিশ্চয়তা দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্যিক পরিকল্পনাকে অসম্ভব করে তুলেছে। অর্থনীতির একটি মৌলিক সত্য হলো- সংকটই নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে। অর্থনীতিবিদ জোসেফ শুম্পেটারের ভাষায়, ‘Creative destruction is the essence of capitalism।’ অর্থাৎ ধ্বংসের মধ্যেই নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন প্রস্তুতি, দূরদৃষ্টি এবং কৌশলগত পরিকল্পনা। বাংলাদেশের পোশাক খাত সেই তিনটিরই ঘাটতিতে ভুগছে। চীন-আমেরিকার শুল্কযুদ্ধের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিপুল শূন্যতা তৈরি হয়েছিল- যা ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া দক্ষতার সঙ্গে পূরণ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সেই সুযোগ হারিয়েছে মূলত নীতি অদক্ষতার কারণে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প এখন এক দ্বিমুখী চাপের মধ্যে রয়েছে- একদিকে বাইরের বাজারের মন্দা ও ক্রেতার সংকোচন, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও উৎপাদন খরচের বৃদ্ধি। বিদ্যুৎ ঘাটতি, গ্যাস সংকট, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও মুদ্রার অবমূল্যায়ন মিলিয়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে প্রায় ১৮ শতাংশ। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রেতারা সেই বাড়তি খরচ মেনে নিতে রাজি নয়। ফলে মুনাফার মার্জিন ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছেন। এ অবস্থায় শিল্প মালিকেরা যেমন হতাশ, শ্রমিকরাও তেমনি অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো- একবার কোনো ক্রেতা অন্য দেশে অর্ডার স্থানান্তর করলে তা পুনরুদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিশ্বাসই সবচেয়ে বড় সম্পদ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, শ্রম অশান্তি এবং বন্দরব্যবস্থার দুর্বলতা এই বিশ্বাসের ভিত্তি নষ্ট করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ক্রেতারা এখন ভিয়েতনাম, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মতো স্থিতিশীল বাজারে ঝুঁকছেন। অথচ এই দেশগুলো একসময় বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও পোশাক শিল্পের সংকটকে গভীরতর করেছে। সরকারের পরিবর্তনের পর প্রশাসনিক কাঠামোতে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তাতে ব্যবসায়ী সমাজ আস্থা হারিয়েছে। বিনিয়োগকারীরা জানেন না নতুন নীতি কবে আসবে, কর কাঠামো কী হবে, বা আমলাতন্ত্র কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে। রাজনীতি যখন স্থিতিশীল থাকে না, তখন অর্থনীতি কখনোই নিরাপদ থাকতে পারে না। বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় শর্ত হলো পূর্বাভাসযোগ্যতা- যা এখন আর বাংলাদেশে নেই। ভিয়েতনাম এই জায়গায় এক অনন্য উদাহরণ। গত দশকে দেশটি নিজেকে ‘কৌশলগত উৎপাদন কেন্দ্র’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তারা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করেছে। এই কূটনৈতিক সক্রিয়তা তাদের রপ্তানিকে বহুগুণে বাড়িয়েছে। কম্বোডিয়াও Preferential Trade Access নীতির সুফল পেয়েছে। ভারত ‘Production Linked Incentive’ (PLI) কর্মসূচির মাধ্যমে প্রযুক্তিনির্ভর পোশাক শিল্প গড়ে তুলছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও একই জায়গায় স্থবির- শ্রমনির্ভর, কম মজুরিনির্ভর এবং অদক্ষ ব্যবস্থাপনায় আবদ্ধ। আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রযুক্তি ও অটোমেশন। বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেছে। রোবোটিক সেলাই, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং ডিজিটাল সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনা ক্রমেই পোশাক উৎপাদনকে শ্রমনির্ভরতা থেকে মুক্ত করছে। ফলে সস্তা শ্রম আর একমাত্র প্রতিযোগিতার উপাদান নয়। বাংলাদেশের পোশাক খাত এখনো যান্ত্রিক ও ম্যানুয়াল উৎপাদন ব্যবস্থায় আটকে আছে। দক্ষ মানবসম্পদের অভাব এবং প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ না থাকার কারণে আমরা বিশ্ববাজারে পিছিয়ে পড়ছি। পরিবেশগত মানদ-ও এখন রপ্তানির প্রধান শর্ত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এরইমধ্যে Carbon Border Adjustment Mechanism (CBAM) চালু করেছে, যার ফলে উচ্চ কার্বন নির্গমনকারী শিল্পপণ্যগুলোতে অতিরিক্ত কর আরোপ হবে। বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর বড় অংশ এখনও সবুজ প্রযুক্তি বা পরিবেশবান্ধব উৎপাদনে পুরোপুরি রূপান্তরিত হয়নি। ভবিষ্যতে এটি একটি বড় প্রতিবন্ধকতায় পরিণত হতে পারে। অন্যদিকে, শ্রমিক ইস্যুও দিন দিন জটিল হচ্ছে। একদিকে কম মজুরি নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনা, অন্যদিকে উৎপাদন হ্রাসের ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি- দুই দিকেই চাপ। শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন, নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত না হলে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো মানবাধিকারভিত্তিক শর্তে চুক্তি নবায়ন করতে অনীহা দেখাতে পারে।
এই সমস্ত সংকটের মূল শিকড় রাজনৈতিক। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া কোনো শিল্পই দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে পারে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন, ‘Political fragmentation breeds economic fragility’- রাজনৈতিক বিভাজন অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা সেই কথাটিরই প্রতিফলন। ক্ষমতার পালাবদল, দলীয় প্রতিহিংসা ও নীতি অদলবদল বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। কিন্তু এই অন্ধকারের মধ্যেও সম্ভাবনার আলো আছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের ভিত্তি এখনও মজবুত- অগণিত অভিজ্ঞ শ্রমিক, বিশাল উৎপাদন অবকাঠামো, এবং বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলোর দীর্ঘ অভিজ্ঞ সম্পর্ক। এই ভিত্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন পথ তৈরি করা সম্ভব। প্রথমত, শিল্পনীতি ও বাণিজ্য কূটনীতি একত্রে পুনর্গঠিত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ ও শ্রমিক দক্ষতা উন্নয়নে জাতীয় কর্মসূচি নিতে হবে। তৃতীয়ত, বৈদেশিক বাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে ব্র্যান্ডিং ও পাবলিক ডিপ্লোমেসি বাড়াতে হবে। চতুর্থত, রাজনৈতিক সমঝোতা ও প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে- কারণ স্থিতিশীল রাষ্ট্রই বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করে। অর্থনীতির ভাষায়, ‘Crisis carries within it the seed of opportunity’ আজকের সংকটও হয়তো আগামীকালের সম্ভাবনার সূচনা। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত যদি এই সংকট থেকে শিক্ষা নেয়, কৌশল পুনর্গঠন করে, এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনে, তবে এই খাত আবারও বৈশ্বিক বাজারে নেতৃত্ব দিতে পারে। কিন্তু যদি আমরা এখনও আত্মতুষ্টির ঘোরে থাকি, নীতি পরিবর্তনে বিলম্ব করি, আর বৈশ্বিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করি, তবে এই শিল্প একদিন ইতিহাসে পরিণত হবে- একসময়ের গৌরব, যা অব্যবস্থাপনার শিকার হয়ে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
আজ প্রয়োজন সাহসী নেতৃত্ব, দূরদৃষ্টি ও নীতির ধারাবাহিকতা। তৈরি পোশাক শিল্প শুধু অর্থনৈতিক খাত নয়, এটি বাংলাদেশের সামাজিক অগ্রগতির প্রতীকও বটে। তাই এই শিল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা মানে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা। এখনই সময় পুনর্বিবেচনার, পুনর্গঠনের, এবং সাহসী সিদ্ধান্তের- না হলে এক সময় যে খাত আমাদের গর্বের কারণ ছিল, সেটিই পরিণত হবে আমাদের অর্থনৈতিক হতাশার প্রতীকে।
এসএম রায়হান মিয়া
সিনিয়র শিক্ষক ও কলাম লেখক, গাইবান্ধা সদও, গাইবান্ধা
