নারী সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

সাদিয়া সুলতানা রিমি

প্রকাশ : ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের গণমাধ্যম খাত গত দুই দশকে ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন, অনলাইন প্ল্যাটফর্মের বিস্তার এবং তরুণদের আগ্রহ মিলিয়ে সাংবাদিকতার ক্ষেত্র আজ অনেক বিস্তৃত। এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারী সাংবাদিকদের অংশগ্রহণও বেড়েছে। তারা মাঠে রিপোর্টিং করছেন, নিউজরুম চালাচ্ছেন, ক্যামেরা হাতে ঘটনাস্থলে ছুটছেন কিংবা অনুসন্ধানী রিপোর্ট করে সমাজের অন্ধকার দিক খুলে দিচ্ছেন। কিন্তু এই অগ্রগতির মধ্যেও তাদের পথ এখনও মসৃণ নয়। নানা সামাজিক, সাংগঠনিক ও মানসিক বাধা নারী সাংবাদিকতার অগ্রযাত্রাকে জটিল করে তোলে। তবুও একইসঙ্গে নতুন নতুন সম্ভাবনার দরজাও খুলছে, যা নারী সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎকে আশাব্যঞ্জক করে তুলেছে।

বাংলাদেশের সমাজ এখনও গভীরভাবে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাধারায় গঠিত। সাংবাদিকতা এমন একটি পেশা যেখানে সময়-পরিকল্পনা নেই, ঝুঁকি রয়েছে প্রচুর, আর মাঠে নেমে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা প্রতিনিয়ত দেখা দেয়। পরিবারের অনেকে মনে করেন এই ধরনের কাজ মেয়েদের জন্য উপযুক্ত নয়। রাতের ডিউটি, দূরবর্তী এলাকায় রিপোর্টিং, রাজনৈতিক কর্মসূচি কাভার করা বা অপরাধের খবর সংগ্রহ করা এসব দায়িত্বকে নারীদের জন্য ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বা ‘অপছন্দনীয়’ হিসেবে দেখা হয়। ফলে অনেক মেধাবী মেয়ে সাংবাদিক হতে চাইলেও পরিবার বা সমাজের চাপের কারণে পেশা থেকে দূরে সরে যান। আবার যারা থেকে যান, তাদেরও প্রায়ই নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করতে হয় বারবার। সমাজের এই মানসিক বাধাগুলো এতটাই সূক্ষ্ম ও গভীর যে তা নারী সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়।

নিউজরুমের অভ্যন্তরীণ কাঠামোতেও চ্যালেঞ্জ কম নয়। অনেক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান নারী-বান্ধব পরিবেশের কথা বললেও বাস্তবে অনেক সময় নারীরা সমান সুযোগ পান না। গুরুত্বপূর্ণ কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্ট পুরুষদের হাতে দিয়ে নারীদের হালকা ধরনের রিপোর্টিংয়ে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। অনেক জায়গায় নারীদের রাজনৈতিক, অপরাধ বা অনুসন্ধানী বিটে পাঠানো হয় না, যদিও এসব ক্ষেত্রেই তাদের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। একই কাজ করেও অনেক সময় বেতন বৈষম্য দেখা যায়, উন্নতির সুযোগও সীমিত থাকে। নেতৃত্বে নারীর সংখ্যা খুবই কম নিউজ এডিটর, চিফ রিপোর্টার বা ম্যানেজমেন্ট পর্যায়ে নারীরা আসতে পারেন না মূলত দীর্ঘদিনের এক ধরনের অদৃশ্য বৈষম্যের কারণে। এই বৈষম্য শুধু নারী সাংবাদিকদের প্রভাবিত করে না, সংবাদমাধ্যমের বহুমাত্রিকতাও সংকুচিত করে। কারণ নারী দৃষ্টিভঙ্গির অভাব মানে সংবাদ কাভারেজের একটি বড় অংশ অসম্পূর্ণ থাকা।

কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নারী সাংবাদিকতার আরেকটি তীব্র চ্যালেঞ্জ। অনেক নারী সাংবাদিক নিউজরুমে বা মাঠে কাজ করার সময় অশোভন মন্তব্য, অনাকাঙ্ক্ষিত দৃষ্টিভঙ্গি, শারীরিক স্পর্শের চেষ্টা কিংবা সিনিয়রদের ক্ষমতার অপব্যবহারের মুখে পড়েন।

দুঃখজনকভাবে বেশিরভাগ সময় ভুক্তভোগী নারী অভিযোগ করতে দ্বিধা করেন, কারণ এতে চাকরি ঝুঁকিতে পড়তে পারে, কর্মস্থলে ‘সমস্যা তৈরি করা মানুষ’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ভয় থাকে, অথবা অভিযোগ নথিভুক্ত হলেও শাস্তি খুব বেশি দেখা যায় না। মাঠে কাজের সময় নারীরা আরেক ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন হন বিশেষ করে রাজনৈতিক সমাবেশ, অপরাধস্থল বা জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় কটূক্তি, ধাক্কাধাক্কি বা শারীরিক হয়রানি হঠাৎ করেই ঘটতে পারে। এ ধরনের ঘটনা নারী সাংবাদিকদের মানসিক চাপ বাড়ায় এবং পেশাগত নিরাপত্তা নিয়ে তাদের আস্থা কমিয়ে দেয়।

ডিজিটাল যুগ নারী সাংবাদিকদের সামনে নতুন সুযোগ তৈরি করেছে ঠিকই, তবে একইসঙ্গে নতুন ঝুঁকিও বাড়িয়েছে। নারীদের বিরুদ্ধে অনলাইন হয়রানি আজ একটি গুরুতর সমস্যা। রাজনৈতিক রিপোর্ট, মানবাধিকার সংক্রান্ত লেখা, নারী নির্যাতন নিয়ে প্রতিবেদন এসব বিষয় কাভার করার পর বিশেষ করে নারী সাংবাদিকরা লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে অপমানজনক মন্তব্য, চরিত্র হনন, ইনবক্সে অশ্লীল বার্তা পাঠানো বা ছবি বিকৃতি এসব খুব সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এতে অনেক নারী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয়তা কমিয়ে দেন বা নিজেকে গুটিয়ে নেন। ডিজিটাল হয়রানি যদিও শারীরিক নয়, কিন্তু এর প্রভাব গভীর এবং দীর্ঘমেয়াদি, যা পেশাগত আত্মবিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্ত করে।

অন্যদিকে স্বাস্থ্যগত ও মানসিক চাপ নারী সাংবাদিকদের জন্য একটি বড় বাস্তবতা। সাংবাদিকতার ডেডলাইন-নির্ভর কাজ, অনিয়মিত সময়সূচি, ভ্রমণ, রাতের ডিউটি এসব চ্যালেঞ্জ পুরুষের মতো নারীর জন্যও সমান। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে এতে যোগ হয় পরিবার সামলানোর অতিরিক্ত চাপ, যা ‘ডাবল বার্ডেন’ বা দ্বৈত দায় হিসেবে পরিচিত। অনেক নারী নিজেকে প্রমাণ করতে গিয়ে অতিরিক্ত পরিশ্রম করেন, কিন্তু তাতেও ‘উচ্চাভিলাষী’ বলে সমালোচিত হন। আবার নিজের সুবিধা অনুযায়ী কাজ সামঞ্জস্য করলে ‘অনুপযুক্ত’ হিসেবে অভিহিত হন। এই দ্বৈত মূল্যায়ন নারী সাংবাদিকদের মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুতরভাবে প্রভাবিত করে।

সব ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যেও নারী সাংবাদিকতার সামনে এখন এক নতুন দিগন্ত তৈরি হচ্ছে। সমাজে নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে সচেতনতা আগের তুলনায় অনেক বেশি। পরিবারগুলো মেয়েদের কর্মজীবনে উৎসাহ দিচ্ছে, আর মিডিয়া হাউসগুলোও নারীর অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দিচ্ছে। মেয়েরা এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিষয়ে পড়ছে, প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, স্কলারশিপ পাচ্ছে, আন্তর্জাতিক সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। এতে নারীদের দক্ষতা, আত্মবিশ্বাস এবং ক্যারিয়ার পরিকল্পনা শক্ত হচ্ছে।

গণমাধ্যমের বিভিন্ন স্তরে এখন একটি উপলব্ধি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নারী ছাড়া সংবাদ অসম্পূর্ণ। নারীর দৃষ্টিভঙ্গি, সংবেদনশীলতা এবং মানবিক বোঝাপড়া সংবাদকে আরও গভীর করে। নারী বিষয়ক রিপোর্ট, শিশু, স্বাস্থ্য, পরিবার, মানবাধিকার এসব বিষয়ে নারীরা স্বাভাবিকভাবেই বেশি সংযুক্ত, তবে আজ নারীরা অর্থনীতি, রাজনীতি, বিজ্ঞান, পরিবেশ, ক্রাইম সব ক্ষেত্রেই যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। অনেক নিউজরুমে এখন বিশেষভাবে নারী রিপোর্টার নিয়োগের প্রবণতা দেখা যায়। এটি সাংবাদিকতার বৈচিত্র্যই নয়, সামগ্রিক বিশ্বাসযোগ্যতাও বাড়ায়।

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নারীদের জন্য নতুন এক বিশ্ব তৈরি করেছে। অনলাইন নিউজপোর্টাল, ইউটিউব, ফেসবুক পেইজ, পডকাস্ট এসবের মাধ্যমে নারীরা নিজস্ব জায়গা তৈরি করতে পারছেন। যারা মাঠে বেশি কাজ করতে পারেন না বা চান না, তারাও ডকুমেন্টারি, ডেটা জার্নালিজম, মন্তব্যধর্মী রিপোর্ট বা বিশ্লেষণমূলক লেখা করে শক্তিশালী প্রভাব তৈরি করছেন। তরুণ নারী সাংবাদিকদের একটি স্বাধীন ও বিকল্প প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে, যা পুরনো ধ্যান ধারণা ভেঙে দিচ্ছে।

এছাড়া নারী সাংবাদিকদের জন্য এখন নানা আন্তর্জাতিক ফেলোশিপ, লিডারশিপ প্রশিক্ষণ, সেফটি ট্রেনিংয়ের সুযোগ বাড়ছে।

সাদিয়া সুলতানা রিমি

শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ