রাজউক ও ভূমি অফিস যেন দুর্নীতির শিকড়
রাফায়েল আহমেদ শামীম
প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউক এবং দেশের ভূমি প্রশাসনের পরস্পর-সংযুক্ত আমলাতান্ত্রিক কাঠামো দীর্ঘদিন ধরেই দুর্নীতির এক বহুমাত্রিক পরিখায় পরিণত হয়েছে, যার গভীরতা এতটাই প্রোথিত যে সাধারণ নাগরিকের জন্য এটি একটি অসহনীয় ধাঁধা এবং রাষ্ট্রের জন্য এটি প্রশাসনিক অপারগতায় রূপ নেয়া এক নীরব ট্র্যাজেডি। উন্নয়নের মহিমাময় আখ্যানের অন্তর্গত যে বর্ণিল প্রতিশ্রুতিগুলো প্রতিনিয়ত উচ্চারিত হয়, তা কার্যত এই সমগ্র কাঠামোর ভেতরে সৃষ্টি হওয়া দুর্নীতিগত স্ফীতি, লালফিতার শৃঙ্খল, স্বার্থান্বেষী চক্র, গোপন দালালচক্র ও নেপথ্যের ক্ষমতাকেন্দ্রগুলোর অভ্যন্তরীণ অবক্ষয়কে কোনোভাবেই আড়াল করতে পারে না। রাজউকের অফিস, ভূমি অফিস, সেটেলমেন্ট, পর্চা, নকশা, অনুমোদন- এই সবকিছুই আজ যেন এক অনিবার্য নরকীয় যাত্রাপথ, যেখানে সাধারণ মানুষের অস্তিত্ব ক্রমাগত অবদমিত এবং দুর্বার প্রশাসনিক জটিলতার অজস্র খণ্ড-বিক্ষিপ্ত গোলকধাঁধায় জর্জরিত। নাগরিক যখন রাজউকের দোরগোড়ায় পা রাখে, তখনই সে এক ধরনের অদৃশ্য চাপ অনুভব করে একটি অসহনীয় প্রশাসনিক ভার, একটি শুষে নেওয়া আমলাতান্ত্রিক দমবন্ধ ভাব, যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক অচলাভঙ্গি প্রাচীর। নকশা অনুমোদনের মতো সহজাত নাগরিক অধিকারকে করে তোলা হয় এক বহুস্তর বিশিষ্ট ‘প্রতারণামূলক পদ্ধতি’।
যেখানে নিয়মকানুনের ভাষ্য ব্যবহার করা হয় অস্ত্র হিসেবে, আর আইন ব্যাখ্যার ক্ষমতাকে ব্যবহার করা হয় বাণিজ্যিক লোভের যন্ত্র হিসেবে। ফাইল আটকে রাখা, ফাইল ঘোরানো, অসম্পূর্ণ দেখানোর অভিনয়, অযৌক্তিক আপত্তি উত্থাপন, খুঁত ধরে বারবার সংশোধনের নামে হয়রানি- সবকিছুই যেন এক নিদারুণ প্রশাসনিক প্রহসন। এখানে ‘ঘুষ’ কোনো অপরাধ নয়, এটি যেন একটি অঘোষিত, অথচ বাধ্যতামূলক প্রবেশ ফি- যা না দিলে নাগরিকের সমস্ত কাজ অনির্দিষ্টকালের জন্য আমলাতন্ত্রের অন্ধকার সিন্দুকে আটকে থাকে। অন্যদিকে ভূমি অফিস- যা রাষ্ট্র কাঠামোর সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং জটিল প্রশাসনিক অনুষঙ্গ- এই অফিসগুলোতে দুর্নীতি আজ যান্ত্রিকতার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। পর্চা সংশোধন, নামজারি, খতিয়ান হালনাগাদ, ভূ-রাজস্ব পরিশোধ, দাগ-খতিয়ান দ্বন্দ্ব সমাধান- এসবকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এক প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির ক্যানসার কোষ, যা দিন দিন মাত্রা বদল করে আরও ভয়ংকর আকার ধারণ করছে। সাধারণ মানুষ যখন ভূমি অফিসে প্রবেশ করে, তখন মনে হয় যেন সে কোনো বিচারালয়ের নয়, বরং এক অনন্ত প্রতীক্ষার কক্ষে প্রবেশ করেছে, যেখানে সিদ্ধান্তের উপর প্রভাব বিস্তার করে শুধুমাত্র অফিসের অভ্যন্তরীণ শক্তিকেন্দ্র এবং তাদের সঙ্গে আঁতাত করা গোপন দালালচক্র। এই দালালচক্রগুলো রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়ার এক ধরনের ছায়া-প্রতিষ্ঠান। এরা কোনোদিন আনুষ্ঠানিক পদে নেই, কোনো দায়িত্বও নয়, কিন্তু কার্যত পুরো সিস্টেমের অনানুষ্ঠানিক রেমোট কন্ট্রোল তাদের হাতে। তারা জানে কোন কর্মকর্তাকে কখন ‘নরম’ করা যাবে, কোন ফাইল কোন টেবিলে কীভাবে আটকে রাখতে হয়, কোন দর-কষাকষির পরিমাণ কতটা হওয়া উচিত, কোন আবেদনকারীর দুর্বলতা কোথায় লুকিয়ে আছে। রাষ্ট্রের আইনি কাঠামো যখন মানুষের সাহায্য করার কথা, তখনই এই আইনের দৌরাত্ম্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় মানুষের বিপরীতে। যেন আইন কোনো ন্যায়বিচারের উৎস নয়, বরং দমন-পীড়নের হাতিয়ার।
রাজউক- বাংলাদেশের নগর পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু- আজ সেই পরিকল্পনার ধারক নয়, বরং পরিকল্পনার অবরোধকারী শক্তি হিসেবে বেশি আলোচিত। নকশা অনুমোদনের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা বজায় রাখার যৌক্তিকতা থাকলেও বাস্তবে দেখা যায়, সেই যৌক্তিকতাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দুর্নীতির সোপানে পরিণত করা হয়। ফাইলের জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা, কর্মকর্তার অনুপস্থিতির বানানো নাটক, আর্টিফিশিয়াল জট, ইচ্ছাকৃত আপত্তি উত্থাপন- সব মিলিয়ে রাজউক একটি ‘অবসানহীন দাপ্তরিক যন্ত্রণা’র নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাগরিকরা প্রতিটি ধাপেই এক ধরনের অসহায়ত্ব অনুভব করে, যা প্রায়ই তাদেরকে বাধ্য করে অবৈধ সমাধানের দিকে। অন্যদিকে রাজউকের কর্মকর্তারা, যারা রাষ্ট্রীয় চাকরির শপথ নিয়েছেন, তারা যেন আর কোনো নৈতিক দায় অনুভব করেন না; বরং দাপ্তরিক ক্ষমতার স্ফীতি তাদের মধ্যে গড়ে তোলে এক ধরনের অমানবিক শ্রেণি-শক্তি, যা নাগরিকের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়।
এই দুটি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি শুধু ব্যক্তি পর্যায়ের নয়; এটি এক গভীর কাঠামোগত দুর্নীতি- যা অদৃশ্য শিকড়ের মতো রাষ্ট্রের নানা স্তর ভেদ করে বিস্তৃত। দুর্নীতি এখানে কোনো আচরণগত বিচ্যুতি নয়; বরং এটি পরিণত হয়েছে এক অনিবার্য সাংগঠনিক সংস্কৃতিতে। এমনকি যেসব কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে সৎ থাকতে চান, তারাও এই দুর্নীতিগ্রস্ত কাঠামোর চাপ, ঊর্ধ্বতন অসৎ নেটওয়ার্ক, প্রশাসনিক হুমকি এবং ফাইল-নিয়ন্ত্রণকারী দালালচক্রের কারণে অক্ষম হয়ে পড়েন। ফলে প্রতিষ্ঠানিক সততা এখানে যেন একটি ব্যতিক্রম, আর দুর্নীতি একটি অঘোষিত প্রচলিত নিয়ম। এই দুর্নীতির মূলে রয়েছে আরও কিছু গভীরতর সমস্যা- রাষ্ট্রীয় জবাবদিহির ঘাটতি, দুর্বল প্রশাসনিক নজরদারি, ডিজিটাল প্রক্রিয়ার অসম্পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। ভূমি অফিস কিংবা রাজউকের ভিতরে যে-পর্যায়ে দুর্নীতি বিস্তার লাভ করেছে, তা শুধু ব্যক্তির লোভে অর্জিত নয়; এটি একটি নিষ্ক্রিয় রাষ্ট্র-ব্যবস্থার ফসল। বহু বছর ধরে এসব প্রতিষ্ঠানে গড়ে ওঠা ক্ষমতার কাঠামো এতটাই দৃঢ় হয়ে গেছে যে রাষ্ট্র নিজেই যেন এদের নিয়ন্ত্রণে না রেখে, বরং মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। আর এটাই নাগরিকদের মধ্যে তৈরি করেছে ভয়, হতাশা, অবিশ্বাস ও অনিরাময়যোগ্য ক্ষোভ।
নাগরিকের জমি, বাড়ি, নকশা- এগুলো একজন মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদই নয়, এটি তার নিরাপত্তা, তার ভবিষ্যৎ, তার সামাজিক অবস্থান এবং তার আর্থিক অস্তিত্বের গভীর প্রতিফলন। যখন এই সংবেদনশীল বিষয়গুলো নিয়েই দুর্নীতির জাল বিস্তার লাভ করে, তখন মানুষের জীবন অনিবার্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জমি সংক্রান্ত বিরোধ দেশে যেসব হত্যাকাণ্ড, সহিংসতা বা মামলা-মোকদ্দমার জন্ম দেয়, তার মূলেও রয়েছে ভূমি প্রশাসনের অদক্ষতা ও দুর্নীতিজনিত অস্থিরতা। অপরদিকে, অবৈধ নির্মাণ, ভবন ধস, ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণের মতো বিপর্যয়গুলোর পেছনে রাজউকের দুর্নীতিজাত উদাসীনতা ও অনুমোদন দুর্বৃত্তায়নের অবদান অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো- রাষ্ট্র এই দুর্নীতিকে যেন নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা তদন্তের নামে বছরের পর বছর ঝুলে থাকে; শাস্তি হয় খুব অল্পই, আর যারা দোষী তারা অধিকাংশ সময় আরও ক্ষমতাশালী পদের দিকে অগ্রসর হন।
ফলে একটি বিপজ্জনক বার্তা ছড়িয়ে পড়ে: দুর্নীতি করলে সুযোগ বাড়ে, সততা ধরে রাখলে বাধা বাড়ে। এই মনস্তত্ত্বই প্রশাসনিক কাঠামোর আগামী প্রজন্মকে দুর্নীতির দিকে আরও তীব্রভাবে ধাবিত করে।
রাষ্ট্র যদি সত্যিকার অর্থে এই অবক্ষয়কে রোধ করতে চায়, তবে প্রথমেই প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা- যে সদিচ্ছা দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন অবস্থান গ্রহণ করবে। প্রয়োজন শক্তিশালী ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনা, স্বয়ংক্রিয় নকশা অনুমোদন ব্যবস্থা, আমলাদের কঠোর জবাবদিহি, দুর্নীতিবিরোধী বিশেষ আদালত এবং দালালচক্রকে আইনের আওতায় আনার সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া। তাছাড়া নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিও জরুরি- যাতে তারা দালালদের মাধ্যমে নয়, নিজ অধিকার অনুযায়ী সেবা আদায়ে সক্ষম হন। তবে প্রশ্ন রয়ে যায়- রাষ্ট্র কি সত্যিই এই সমস্যাকে সমাধান করতে চায়? নাকি এই দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা কোনোভাবে রাষ্ট্রীয় শক্তিকেন্দ্রগুলোর উপকারে আসে?
কারণ যতোদিন পর্যন্ত শিকড় গোঁড়া দুর্নীতি রাজউক ও ভূমি অফিসে অটুট থাকবে, ততোদিন নাগরিকের যন্ত্রণা, উন্নয়নের ব্যর্থতা, রাষ্ট্রের অক্ষমতা এবং প্রশাসনের নৈতিক পতন একই বৃত্তে ঘুরতে থাকবে। রাজউক ও ভূমি অফিসের দুর্নীতি কেবল কিছু কর্মকর্তার লোভ নয়- এটি রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার এক ঐতিহাসিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত ব্যর্থতা। মানুষের জমি, স্বপ্ন, ঘর, ভবিষ্যৎ- সবকিছুই এই দুর্নীতির কাছে প্রতিদিন পরাভূত হচ্ছে। রাষ্ট্র যদি এখনই চোখ না খোলে, তবে শাসনব্যবস্থার এই নীরব পচন একদিন এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে, যেখানে নাগরিক শুধু প্রশাসনের ওপর আস্থা হারাবেই না- রাষ্ট্রের ওপরও বিশ্বাস হারাবে। আর রাষ্ট্রের জন্য তারচেয়ে বড় বিপর্যয় আর কিছু নেই।
রাফায়েল আহমেদ শামীম
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কলাম লেখক গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা
