বিদেশে পাড়ি দেওয়া তরুণদের সংকট

আরিফুল ইসলাম রাফি

প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের এক বড় অংশ এখন দেশের মাটিতে নয়, বিদেশের প্রবাসে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখছে। কেউ উচ্চশিক্ষার জন্য, কেউ উন্নত জীবনের আশায়, আবার শুধুই বেঁচে থাকার পথ খুঁজতে দেশ ছাড়ছে প্রতিদিন শত শত তরুণ। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে রেকর্ডসংখ্যক তরুণ বিদেশে যায়; কেউ মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক হিসেবে, কেউ ইউরোপে পড়াশোনার নামে কাজের সন্ধানে, আবার কেউ দালালের ফাঁদে পড়ে অবৈধ পথে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই পাড়ি দেওয়া তরুণরা আদৌ কতটা সফল? তাদের স্বপ্নের দেশে পৌঁছেও যে অনিশ্চয়তা, হতাশা ও মানসিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যে পড়ে তারা, সে গল্প হয়তো দেশে থাকা আত্মীয়রা শোনেন না। বিদেশে পাড়ি দেওয়া মানেই সুখ নয়, বরং শুরু হয় এক নতুন সংগ্রাম, এক নতুন সংকট। বাংলাদেশের তরুণদের বিদেশমুখী হওয়ার মূল কারণ অর্থনৈতিক। দেশে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের বেকারত্বের হার আশঙ্কাজনক। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেও অনেকেই চাকরির নিশ্চয়তা পান না। প্রতিযোগিতা, স্বজনপ্রীতি, এবং দক্ষতার অপ্রয়োগ; সব মিলিয়ে এক ধরনের হতাশা কাজ করে। এই হতাশাই তরুণদের চোখে বিদেশকে স্বপ্নের দেশ বানিয়ে তোলে। কেউ ভাবে, ইউরোপে গেলেই জীবন বদলে যাবে, কেউ ভাবে, কানাডায় থাকলেই মান-সম্মান আসবে। কিন্তু এই স্বপ্নের আড়ালে থাকে এক কঠিন বাস্তবতা, যেখানে শুরুর জীবন মানে অস্থিরতা, একাকিত্ব আর প্রতিদিনের হিসাব-নিকাশ। কাজের বাজারে অনিশ্চয়তা, ভিসা-সংকট, ভাষাগত বাধা, সাংস্কৃতিক পার্থক্য; সব মিলিয়ে অনেকেই ভেঙে পড়েন। কেউ কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন, কেউ আবার দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেও, সমাজের ‘ব্যর্থ’ তকমা এড়াতে পারেন না।

বিদেশে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা অনেক সময় তরুণদের অন্ধ করে দেয়। এই সুযোগে বেড়ে উঠেছে দালালচক্র, যারা; স্বপ্ন বিক্রেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ। কেউ বলে, এক লাখ টাকায় ইতালি পাঠিয়ে দেবে; কেউ বলে, মালয়েশিয়ায় মোটা বেতনের চাকরি নিশ্চিত। বাস্তবে সেই পথ শেষ হয় মৃত্যুতে, মধ্য সাগরে ডুবে যাওয়া নৌকা, মরুভূমিতে আটকে থাকা তরুণদের ক্ষুধার্ত দেহ কিংবা বিদেশের জেলে বছরের পর বছর বন্দিদশা। বাংলাদেশের শত শত পরিবার আজ এমন শোকের ভারে নুয়ে আছে। দালালরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখের সামনেই রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র হয়তো কখনও-কখনও অভিযান চালায়, কিন্তু মূল চক্র অক্ষত থাকে। কারণ, তরুণের স্বপ্নের সঙ্গে যখন ব্যবসা মিশে যায়, তখন তা শুধু অপরাধ নয় একটি সামাজিক ট্র্যাজেডিতে পরিণত হয়। যেসব তরুণ বৈধ পথে বিদেশে গিয়েও কাজ পাচ্ছেন না, তাদের সংকটও কম নয়। অনেকেই উচ্চশিক্ষার জন্য গেছেন, কিন্তু জীবিকার তাগিদে ফুলটাইম কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া বা জাপান; প্রতিটি দেশে এখন আন্তর্জাতিক ছাত্রদের জীবন কঠিন হয়ে উঠেছে। ভিসার নিয়ম কঠোর, ভাড়ার খরচ আকাশছোঁয়া আর মানসিক চাপ অবর্ণনীয়। কেউ কেউ পড়াশোনা শেষ করতে না পেরে দেশেও ফিরতে পারছেন না, আবার দেশে ফিরে লজ্জায় পড়ছেন সমাজের চোখে।

অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শ্রমবাজারে কাজ করা তরুণদের জীবন অনেক সময় করুণ। গরম মরুভূমির নিচে কাজ, পর্যাপ্ত বিশ্রাম বা বেতন নেই, পাসপোর্ট নিয়েছে মালিক, দেশে টাকা পাঠানোই একমাত্র লক্ষ্য। তারা দেশে ফিরে দাঁড়ালে কারও চোখে নায়ক, কিন্তু বাস্তবে তারা নিঃস্ব। ‘আমার ছেলেও এখন বিদেশে’ এই একটি বাক্য এখন মধ্যবিত্ত পরিবারের অহংকারের প্রতীক হয়ে উঠেছে। সমাজের এই মানসিক চাপ তরুণদের অনেক সময় বাধ্য করে দেশ ছাড়তে। অনেকে উচ্চশিক্ষা বা চাকরির নামে বিদেশ যান শুধুমাত্র পারিবারিক ‘প্রেস্টিজ’ রক্ষার জন্য। অথচ অনেক পরিবারই বোঝে না, বিদেশ মানেই আর্থিক সচ্ছলতা নয়। প্রবাসজীবন মানে ঘরে ফিরে নিজের তৈরি রান্না, একাকিত্বে কাটানো উৎসবের দিন, দেশের খবর শুনে চোখ ভিজে যাওয়া রাত। এই বাস্তবতাকে সমাজ কখনও বোঝে না। বরং তরুণদের সফলতা মাপা হয় ডলারের অঙ্কে, না যে মানসিক বা মানবিক অবস্থায় তারা আছে। যে তরুণরা বিদেশে পড়তে যান এবং সেখানেই থেকে যান, তাদের অনেকে হয়তো বড় অর্জন করেন। কিন্তু এই অর্জনের বিপরীতে বাংলাদেশ হারায় তার মূল্যবান মানবসম্পদ। ডাক্তার, প্রকৌশলী, গবেষক, তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ; দেশের যে তরুণরা বিদেশে থেকে যান, তাদের জায়গায় দেশে তৈরি হয় শূন্যতা। মেধাপাচার আজ এক ভয়াবহ সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকটে রূপ নিচ্ছে। রাষ্ট্র তরুণদের জন্য পর্যাপ্ত গবেষণার সুযোগ, কর্মক্ষেত্রে সৃজনশীল স্বাধীনতা বা নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। ফলে, মেধাবীরা দেশের মাটিতে নিজেদের মূল্য খুঁজে পান না। তারা যখন বিদেশে থেকে যান, তখন লাভবান হয় অন্য রাষ্ট্র, ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশ। বিদেশে একা থাকা তরুণদের মধ্যে মানসিক চাপ, হতাশা ও ডিপ্রেশনের হার দ্রুত বাড়ছে। পরিচিত কেউ নেই, পরিবার দূরে, প্রতিদিনের জীবনে সময়ের হিসাব নেই; এই পরিস্থিতি মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে। বেশ কিছু দেশে বাংলাদেশি তরুণদের আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েছে। একাকিত্ব, আর্থিক চাপ, কাজের চাপে মানসিক অবসাদ; এসব কারণেই এমন মর্মান্তিক সিদ্ধান্ত নেয় কেউ কেউ। দুঃখজনক হলো, বাংলাদেশের সমাজ এখনও মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব বোঝে না। তরুণদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা এক অর্থে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার প্রতিফলন। শিক্ষা ব্যবস্থার অনিশ্চয়তা, কর্মসংস্থানের অভাব, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা; সব মিলিয়ে দেশে তরুণদের ভবিষ্যৎ দেখা কঠিন হয়ে পড়েছে।

আরিফুল ইসলাম রাফি

শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়