ইংরেজি ভাষা শিক্ষার হালহকিকত

মাছুম বিল্লাহ

প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বর্তমান বিশ্বে সফলতার জন্য ইংরেজি ভাষায় যোগাযোগ দক্ষতার বিকল্প নেই। নিজের ভাবনা ও বক্তব্য স্পষ্ট ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রকাশ করতে পারা আজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের শিক্ষায় এটি এখনও অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এখানে পরীক্ষাকেন্দ্রিক সবকিছু অথচ পরীক্ষায় এসব নেই, আছে শুধু মুখস্থ তথ্য লেখার পদ্ধতি। তাও বৃহৎ অংশ শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে সেটি সাজিয়ে লেখার গুণ একেবারেই অনুপস্থিত। শুধু বিবেচনা আর ভুল এড়িয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে তারা পেয়ে যাচ্ছে গ্রেড। ফলে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখানোর যে ১২ বছরের রাষ্ট্রীয় প্রজেক্ট, সেটি আসলে তেমন কোনো কাজে আসছে না। তারপরও রাষ্ট্রকে সেটি এবং তার সঙ্গে সবাইকে যেমন প্রায় তিন লাখ ইংরেজি শিক্ষককে (প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক) প্রতিপালন করতে হচ্ছে এবং হবে। তাদের বেতন-ভাতাদি এবং থেমে থেমে জীবনব্যাপী প্রশিক্ষণ। শিক্ষার্থীদের জন্য বই। তারা পাসও করছে কিন্তু নিজেদের ব্যবহারের জন্য যে ইংরেজি দরকার, সেটি অর্জন করছে না। বলতে গেলে কেউই অন্তত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কমিউনিকেট করছে, তবে সেটি হয় পরিবার থেকে, না হয় আধুনিক সোশ্যাল মিডিয়া থেকে; নয়তো প্রয়োজনের তাগিদে শিখে নিচ্ছে।

শিক্ষার্থীরা বাধ্যতামূলক ইংরেজি শেখার পরও কোনো ধরনের কমিউকেট করতে পারছে না। তারা বাস্তবজীবনে গিয়ে ইংরেজি শেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ফলে ইংরেজি শেখার জন্য ভর্তি হয় কোচিং সেন্টারে। সেন্টারগুলো যেন এই ভাষা শেখানোর দায়িত্ব নিয়েছে। তারা আসলে কী করছে? কিছু সিচুয়েশনাল ডায়ালগ শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করাচ্ছে এবং সেগুলো আবার বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরছে। আসলে ভাষা শেখানোর এটি কোনো পদ্ধতি নয়। কারণ, যে সিচুয়েশনগুলো তারা মুখস্থ করাচ্ছে, সেগুলো সব জায়গায়ই যে একইভাবে হবে, তা নয়। সিচুয়েশন পরিবর্তন হলে এ ধরনের শিক্ষার্থীরা কিছু বলতে পারবে না, কারণ সেই ভোকাব্যিয়ুলারি নেই, বাক্য গঠন এবং নতুন পরিস্থিতি ফেস করার জন্য ন্যাচারাল প্র্যাকটিস তাদের নেই। সেটি অর্জন করতে হয় ইংরেজি পরিবেশে বিভিন্ন অ্যাকটিভিটির মাধ্যমে এবং ওই ভাষার দক্ষতা মনের অজান্তে সাব-কনশাসলি আয়ত্তে চলে আসে। ফলে, যেকোনো পরিস্থিতি শিক্ষার্থীরা মোকাবিলা করতে পারে, কিছু ট্রান্সলেশন মুখস্থ করে নয়। আবার অনেকে কিছু ট্রান্সলেশনের বই বের করেছে, অনেকে ভেবেছে এ ট্রান্সলেশন করলেই বোধহয় ভালো একজন কমিউনিকেটর হওয়া যাবে, বিষয়টি তাও নয়। এ ধরনের ট্রান্সলেশন শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে সারাজীবন করেছে। মূলত তেমন কোনো কাজে লাগে না। কথা বলার সময় বা লেখার সময় সব ধরনের সিচুয়েশন একত্রে ঘটে। আমাদের নিজ ভাষা থেকেই তা আমরা দেখতে পাই, ইংরেজি আমরা সেভাবে শেখার বা শেখানোর চেষ্টা করি না।

আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের পাস করা অর্থাৎ, পার করিয়ে দেওয়ার একটি মাধ্যম। এটি কখনও শিক্ষার্থীদের ইংরেজি দক্ষতা অর্জিত হয়েছে কি না, সেটি দেখার অ্যাসেসমেন্ট নয়। নির্দিষ্ট কিছু চ্যাপ্টারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি দক্ষতা শেখানো ও পরীক্ষা কর হয়। আর এ পদ্ধতিতে লিসেনিং ও স্পিকিং তো নেই-ই। রাইটিংয়ে যেসব আইটেম পরীক্ষায় আসে, সেগুলো বাজারের গাইড বা টেস্ট পেপারস খুলে কয়েকটি নামকরা স্কুল বা কলেজের প্রশ্ন বিগত দুই-তিন বছরের বোর্ডের প্রশ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া করলেই শুধু পাস নয়, উচ্চতর গ্রেড নিশ্চিত। এখানে আরেকটি ঘটনা ঘটে, তা হচ্ছে একটি শ্রেণিতে বা পরীক্ষার হলে দু-চারজন যখন এগুলো পারে, বাকিরা তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে নিয়ে তারাও একই ধরনের গ্রেড পেয়ে যায়। আর বোর্ড পরীক্ষায় উদারভাবে খাতা মূল্যায়ন এবং ভুল-ত্রুটি এড়িয়ে যাওয়ার কালচার তৈরি হয়েছে বহু আগে থেকেই। কাজেই প্রকৃত অ্যাসেসমেন্ট হচ্ছে না। এ তো গেল শুধু রাইটিং প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে, বাকি যে দুটো গুরুত্বপূর্ণ স্কিল সেটি পরীক্ষায় না থাকলেও শিক্ষকরা করাতে পারেন কিন্তু কাদের করাবেন, কীভাবে করাবেন? শিক্ষার্থীরা তো ক্লাসে নিয়মিত আসে না। কারণ, পাসের জন্য ক্লাস করার দরকার নেই, এমনকি ভালো গ্রেড পাওয়ার জন্যও ক্লাস করার দরকার নেই। এখানে আমাদের কাজ করা দরকার। কিন্তু করবেটা কে?

একটি বড় সমস্যা হচ্ছে বাণিজ্যিক প্রকাশকদের সহজতর থেকে সহজতম ইংরেজি নোট ও গাইড বের করা। সরকারি এবং ইংরেজি শিক্ষক কমিউনিটির দুর্বলতার সুযোগে এসব প্রকাশক প্রতিটি ওয়ার্ডের বাংলায় লেখা উচ্চারণ, প্রতিটি ওয়ার্ড ও লাইনের বাংলা অর্থ দিয়ে বাজারে বই ছাড়ছেন। শিক্ষার্থীরা বুঝতেই পারে না যে তারা ক ইংরেজি শিখছে না বাংলা। বিষয়টি ইংরেজি শিক্ষকদের প্রথমে বাধা দেওয়া দরকার ছিল কিন্তু প্রকাশকরা বলেন বাংলা লেখা না থাকলে ইংরেজি শিক্ষকরা সেই বই নিজেরা পড়েন না এবং শিক্ষার্থীদেরও কিনতে বলেন না। অথচ এভাবে বাংলায় ইংরেজি পড়লে একদিকে যেমন তাদের প্রাকৃতিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং অ্যাবেলিটি এবং ভাষাগত দক্ষতা দুটোই মারাত্মভাবে দুর্বল হয়ে যায়। আর ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জনের বিষয়টি চলে যায় হিবারনেশনে কিংবা বনবাসে। কেউ কেউ শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শেখানোর জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি করে ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাব প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছেন। মনে হয়, শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ছাড়া কি অন্য কোনো বিষয় আর নেই যে, সব ইনভেস্টমেন্ট ইংরেজি শেখার জন্যই করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সরকারকে তো সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে কোটি কোটি টাকার ল্যাব বানাতে হবে। তৃতীয়ত, এ ধরনের বুদ্ধি কি সরকারে যারা আছেন তাদের নেই? সর্বশেষ হচ্ছে, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব আছে কিন্তু সেগুলো অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে, ধুলোয় ভরে আছে। কোটি কোটি ডলার লোন করে ইংরেজি ল্যাব বানালে ওই একই অবস্থা হবে।

ইংরেজি শেখানোর জন্য শিক্ষকদের ইংরেজি প্রশিক্ষণের কথা আমরা অহরহ শুনছি, প্রশিক্ষণ হচ্ছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। কারণ, প্রশিক্ষণ, বাস্তবতা, শ্রেণিকক্ষ, মূল্যায়ন এগুলোর প্রতিটির মধ্যে রয়েছে বিশাল গ্যাপ। সেই গ্যাপ নিয়ে কেউ কথা বলছি না, বোঝার চেষ্টা করছি না। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, মাধ্যমিক শিক্ষকদের ইংরেজি পড়ানোর জন্য কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দ্বারা প্রশিক্ষণ করানো হচ্ছে। তার মানে হচ্ছে, ওপরের যেসব গ্যাপের কথা বললাম, সেই গ্যাপ আরও বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বিষয়টি এমন নিউইয়র্ক কিংবা লন্ডন সিটির কিছু অধিবাসীকে ডাকা হচ্ছে বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও কিংবা ঝালকাঠি শহরের সমস্যাবলি দূর করতে এবং উন্নতমানের শহর তৈরি করতে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করা। নিউইয়র্ক সিটি বা লন্ডন সিটির ব্যবস্থাপনা, নাগরিক সুবিধা, অর্থনৈতিক অবস্থা, সমস্যাবলি, সমাধানের পথ, ম্যানেজমেন্ট কোনোটির সঙ্গেই ঠাকুরগাঁও কিংবা ঝালকাঠির মিল হবে না। ঢাকার সঙ্গেই হয় না, ঠাকুরগাঁও তো দূরের কথা! তাদের দ্বারা বাংলাদেশের ছোট শহরের কনটেস্ট জানা এবং সমাধান দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু অনেকে এটি না ভেবে অর্থ খরচ করেই চলেছেন আর ইংরেজি শেখানোর ক্ষেত্রে ফারাক বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হচ্ছে!

আমাদের প্রাথমিক থেকে ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত দৈনন্দিন বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় স্পিকিং, ফ্রিহ্যান্ড রাইটিং, এক্সটেম্পর স্পিচ ও ক্লাস প্রেজেন্টেশনের ব্যবস্থা যদি করা যায়; তাহলে ধীরে ধীরে অবস্থার কিছুটা হলেও পরিবর্তন আশা করা যায়। প্রচলিত পদ্ধতিতে যা চলছে তার কোনেটিই যে কার্যকরী নয়, তার প্রমাণ আমরা পদে পদে পাচ্ছি। এগুলো করার জন্য ইংরেজি শিক্ষকদের নিজেদের দক্ষ করে তুলতে হবে।

মাছুম বিল্লাহ

শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক