বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক বহিষ্কার : শাস্তি নাকি আশীর্বাদ

নুরুল্লাহ আলম নুর

প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন এক অদ্ভুত প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। শিক্ষক বহিষ্কারের যে ব্যাপারটা, এটাকে এখন আর শাস্তি না বলে বরং একধরনের ‘প্রশাসনিক পুরস্কার’ বলতে হচ্ছে। কেউ হয়তো প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে ধরা পড়ছেন, কেউ নারীসহ আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পড়ছেন, সংবাদমাধ্যমে তুমুল আলোচনা, ফেসবুকে সমালোচনার ঝড়। এসবের কয়েকদিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভা বসে, সিদ্ধান্ত হয় ‘অমুক শিক্ষককে বহিষ্কার করা হলো।’ সংবাদ ছাপা হয়, ছবি প্রকাশিত হয়, অনেকেই প্রশংসা করে মন্তব্য করেন যে, অবশেষে প্রশাসন পদক্ষেপ নিয়েছে! কিন্তু এরপর কী হয়?

যাকে বহিষ্কার করা হয়, তিনি অদ্ভুত এক আরামদায়ক ছুটিতে চলে যান। ক্লাসে যান না, লেকচার দিতে হয় না, অফিসে উপস্থিতি নেই। কিন্তু প্রতি মাসে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নিয়মিত বেতন জমা হচ্ছে, টিএ-ডিএ মিলছে, গবেষণা অনুদান বন্ধ হচ্ছে না, এমনকি কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা বা হোস্টেল বরাদ্দ পর্যন্ত ধরে রাখেন। নামমাত্র ‘বহিষ্কার’, বাস্তবে যেটা ‘ছুটি’। তখনই প্রশ্ন জাগে, এই শাস্তি কাকে দেওয়া হলো? শিক্ষককে, না বিশ্ববিদ্যালয়কে? নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের?

একজন শিক্ষককে বহিষ্কার করার মানে হওয়া উচিত ছিল প্রশাসনিক ও নৈতিকভাবে চাকরি থেকে অপসারণ করা, সকল আর্থিক ও সামাজিক সুবিধা স্থগিত করা। কিন্তু আমাদের বাস্তবতায় সেটা নেই। এমন বহিষ্কারের প্রথা শিক্ষাক্ষেত্রে একধরনের প্রাতিষ্ঠানিক প্রহসন তৈরি করেছে। আমরা ভাবি, অপরাধের বিচার হচ্ছে; কিন্তু আসলে ‘নেতিবাচক প্রচারণা’ থামানোর জন্য প্রশাসন একটি ঘোষণামূলক নাটক মঞ্চস্থ করছে। আর সেই নাটকের মূল চরিত্র হলো বহিষ্কৃত শিক্ষক, যিনি আরামসে ঘরে বসে, বেতন ভোগ করছেন!

একজন শিক্ষক সমাজকে গড়ে তোলেন, এই ধারণাটি আজ অনেকটাই বিমূর্ত হয়ে গেছে। কারণ আজকের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক মানে আর শুধু পাঠদানকারী নয়, বরং প্রশাসন, রাজনীতি, ব্যবসা, গবেষণার পুঁজিবাজারসহ সব মিলিয়ে এক জটিল শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন কোনো শিক্ষক অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়ান, সেটা আর শুধু ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, সেটা পুরো প্রজন্মের নৈতিক বিপর্যয়ের প্রতীকও বটে। কিন্তু আমাদের প্রশাসন তা বুঝেও না বোঝার ভান করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

একজন শিক্ষক যদি নারী শিক্ষার্থীকে হয়রানি করেন, তদন্ত কমিটি মাসের পর মাস ফাইল ঘাঁটে, সিন্ডিকেটের সভা পেছানো হয়, শেষে হয়তো বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত আসে তাও সেটি চূড়ান্ত নয়। কারণ, সংশ্লিষ্ট শিক্ষক হাইকোর্টে রিট করেন, ‘আমার বক্তব্য শোনা হয়নি’ বা ‘প্রমাণ অপর্যাপ্ত’ এমন যুক্তিতে। তারপর, আদালত তদন্ত প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন তখন দায় এড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘আইনের ব্যাপার, আমরা কী করব?’ ফলে শিক্ষক বহিষ্কৃত হয়েও বেতন পান, সুবিধা পান, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে পদোন্নতিও পান যার প্রমাণ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালেই খুঁজে পাওয়া যাবে।

বিশ্ববিদ্যালয় মানে শুধু জ্ঞানচর্চা নয়, এটা নৈতিকতার বিদ্যালয়ও। শিক্ষার্থীরা এখানে শুধু পাঠ্যবই শেখে না, তারা শেখে চিন্তা করে, মতামত দেয়, সত্য-মিথ্যা আলাদা করে। যখন তারা দেখে একজন শিক্ষক নারী হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে বহিষ্কৃত হয়েছেন; কিন্তু বেতন পাচ্ছেন, আরেকজন গবেষণার তথ্য জাল করেও বিদেশ সফরের অনুমোদন পাচ্ছেন, তখন তারা শেখে ‘ভুল করলে কিছু হয় না, সিস্টেম তোমাকে রক্ষা করবে’ এবং এই বার্তাই প্রজন্মের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। এভাবে নৈতিকতা যদি প্রতিষ্ঠান থেকেই উধাও হয়, তবে শিক্ষার্থীদের কাছে নীতি শুধু ক্লাসের স্লাইডের একটা শব্দ। তখন শিক্ষক আর অনুকরণীয় ব্যক্তি থাকেন না, তিনি হয়ে যান সততার ব্যর্থ মডেল। আর সমাজের জন্য এর ফলাফল দীর্ঘমেয়াদি, কারণ শিক্ষার্থীরা যেভাবে তাদের শিক্ষকদের দেখবে, ভবিষ্যতে তেমন ভাবেই তারা রাষ্ট্র, প্রশাসন ও ন্যায়বিচারকে বিচার করবে, এটাই স্বাভাবিক।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রায়ই বলে, ‘আমরা চাইলে কাউকে একদিনেই বহিষ্কার করতে পারি না; আইন আছে, নিয়ম আছে।’ ঠিক আছে, আইন আছে অবশ্যই। কিন্তু সেই আইন যদি এমন হয়, যে অপরাধীর বেতন বন্ধ করা যায় না, তবে সেটা আইন না, প্রহসন বলা যেতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগে শিক্ষক সংগঠনগুলো বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত ঠেকাতে চাপ সৃষ্টি করে। সিন্ডিকেটের সদস্যরা নিজেরাও কোনো না কোনো শিক্ষক সংগঠনের পদধারী। ফলে বিচার হয় ঠিকই; কিন্তু ন্যায় হয় না।

এই অচলায়তন ভাঙতে হলে শুধু প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, নৈতিক সংস্কৃতিও প্রয়োজন। বহিষ্কার মানে শাস্তি, এই বার্তা প্রতিষ্ঠানগতভাবে প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নৈতিক ধ্বংসের পথে আরও এগোবে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি টাকাই জনগণের করের টাকা। অর্থাৎ, বহিষ্কৃত শিক্ষক বেতন পাচ্ছেন মানে একজন রিকশাচালক, দোকানদার, কৃষক তাঁর ঘামের টাকায় সেই অন্যায়ের মূল্য দিচ্ছেন। এটা নৈতিক ও প্রশাসনিক উভয় অর্থেই একধরনের রাষ্ট্রীয় অপমান।

বহিষ্কৃত শিক্ষক হয়তো কিছুদিন সমালোচনার মুখে থাকেন; কিন্তু বেতন পান, সময় পান, চাপহীন জীবন পান। যে শিক্ষক আগে সকালে ক্লাস নিতেন, মিটিং করতেন, প্রশাসনিক কাজ করতেন, এখন সেসব থেকে মুক্ত। অথচ প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা চলে আসে। অন্যদিকে, যে শিক্ষক নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছেন, গবেষণা করছেন, নৈতিকভাবে পরিষ্কার, তাকে একই বেতনে আরও বেশি কাজ করতে হচ্ছে। ফলে ‘বহিষ্কার’ হয়ে দাঁড়ায় শাস্তির বদলে একধরনের বিশ্রামের আশীর্বাদ। যেটা শুধু শিক্ষাব্যবস্থার নয়, রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচারেরও অবমাননা।

এসব সমস্যা সমাধানে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে-

প্রথমত, ‘বহিষ্কার’ শব্দটির আইনি কাঠামো স্পষ্ট করতে হবে। তদন্তাধীন অবস্থায়ও আর্থিক সুবিধা স্থগিত করা যেতে পারে, যদি প্রাথমিক প্রমাণ শক্তিশালী হয়।

দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয় আইন এমনভাবে সংশোধন করতে হবে, যাতে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত আদালতে আটকে গেলেও আর্থিক সুবিধা বন্ধ থাকে, যতোদিন না কেউ নির্দোষ প্রমাণিত হন।

তৃতীয়ত, শিক্ষকদের নৈতিকতা নিরীক্ষণের জন্য একটা কমিশন গঠন করা দরকার, যারা প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত থেকে প্রমাণ যাচাই করবেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, শিক্ষক সংগঠনগুলোর অপ্রতিরোধ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা ভাঙতে হবে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈতিক শৃঙ্খলা যতোদিন রাজনীতির ছায়ায় বন্দি থাকবে, ততোদিন পর্যন্ত বহিষ্কারের মানে শাস্তি হবে না, এটা হবে প্রশাসনিক পুরষ্কার।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অন্যায়ের বিচার হলেও, ন্যায়বিচার না মিললে, সেটা জাতির জন্য নিঃসন্দেহে অপমানজনক। তাই বহিষ্কারের নামে ‘দেখানো শাস্তি’ নয়, প্রয়োজন সত্যিকারের দায়বদ্ধতা তৈরি করা। এমন শাস্তি, যা অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিয়ে থামিয়ে দেবে। না হলে বিশ্ববিদ্যালয় একদিন জ্ঞানের জায়গার পরিবর্তে নৈতিকতার শ্মশানে পরিণত হবে।

নুরুল্লাহ আলম নুর

শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়